leadT1ad

আল-জাজিরার প্রতিবেদন

তারেক রহমানের দেশে ফেরা কেন গুরুত্বপূর্ণ

আল জাজিরা
আল জাজিরা

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ২৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

ঢাকার উপকণ্ঠে জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছেন, ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান, ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি (দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য আমার একটি পরিকল্পনা আছে)।’

এই পরিকল্পনা তৈরি হতে সময় লেগেছে ১৭ বছর। গত বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে লন্ডন থেকে ঢাকায় অবতরণ করেন তারেক রহমান। তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজারো সমর্থক জড়ো হন।

তারেক রহমান বলেন, ‘এ দেশে পাহাড়ের, সমতলের, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই আছে। আমরা নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলাদেশে একজন নারী, পুরুষ, শিশু যেই হোক না কেন নিরাপদে ঘর থেকে বের হলে, যেন নিরাপদে ফিরতে পারে।’

তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন এমন সময়ে ঘটল যখন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা তুঙ্গে।

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপিকে এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা দল হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম প্রধান দাবিদার মনে করা হচ্ছে।

হাদির হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে সহিংসতা বেড়ে যায়। এর জের ধরে দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। অন্য আরেক ঘটনায় এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা (লিঞ্চিং) করা হয়। এসব ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে আগামী নির্বাচন বানচাল হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ও তাঁর বক্তব্য দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করতে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের গতিকে জোরদার করতে সহায়তা করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলেন, ‘তাঁর (তারেক রহমান) আগমন সুযোগের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমি মনে করি এর ফলে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা হ্রাস হবে ও দেশে যে স্থিতিশীলতা খোঁজা হচ্ছে তা তৈরিতে সহায়তা করবে।’

অথচ কয়েক দিন আগেও এর কোনোটিই নিশ্চিত ছিল না।

অনিশ্চয়তা থেকে স্থিতিশীলতা

তারেক রহমানের মা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তাঁর বাবা জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সালে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাই দীর্ঘদিন ধরেই আশা করা হচ্ছিল, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাবনা তৈরিতে তারেক রহমানই মূল ভূমিকা রাখবেন। তবে কিছুদিন আগ পর্যন্ত তাঁর নির্বাসন থেকে দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল।

তারেক রহমান নিজেও ফেরার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলেন, তারেক রহমানের আগমন অনিশ্চয়তা দূর করেছে ঠিকই, কিন্তু রহমান তিনি কি সত্যিই নেতৃত্ব দিতে পারবেন? এমন প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে।

অধ্যাপক শাহানের মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে তারেক রহমানকে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, তাঁকে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে যে তিনি তাদের উদ্বেগ বোঝেন এবং একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবেন। এছাড়া দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। পাশাপাশি দলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি দেশ শাসনে প্রস্তুত। এসব করতে পারলেই পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, তারেক রহমান যদি স্পষ্ট বার্তা দিতে ব্যর্থ হন, তবে ‘পরিস্থিতির অবনতি হবে’।

ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (এইচএডিআরআই) অ্যাডজাঙ্কট গবেষক মুবাশার হাসান বলেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ঘিরে বৃহস্পতিবার যে জনউচ্ছ্বাস দেখা গেছে, তা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি হয়তো বিএনপির ঐতিহ্যবাহী ভোটার ঘাঁটির বাইরে থেকেও সমর্থন পেতে পারেন।

মুবাশার হাসানের মতে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে আগ্রহ ও প্রতিক্রিয়া কেবল বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং তা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর গত ১৬ মাস ধরে দেশে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তার প্রেক্ষাপটে অনেকেই বিএনপিকে একটি স্থিতিশীলকারী শক্তি হিসেবে মনে করছেন। হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে এই সরকার এখন ক্রমশ সমালোচনার মুখে পড়ছে।

হাসান বলেন, তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে সমর্থকদের বিশাল সমাবেশ বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তিকেও প্রদর্শন করেছে।

মুবাশার হাসান মনে করেন, আরও একটি বিষয় তারেক রহমানের পক্ষে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনেকেরই বিশ্বাস, খালেদা জিয়ার ছেলের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তাদের ধারণা, তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ওই সময়েই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আনা হয়। পরবর্তীতে তাঁর অনুপস্থিতিতেই এসব মামলার কয়েকটিতে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়।

পুত্রের প্রত্যাবর্তন

২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর, রাজনৈতিক স্রোত তারেক রহমানের প্রতিকূলে চলে গিয়েছিল। তিনি হত্যা থেকে শুরু করে দুর্নীতি পর্যন্ত একাধিক মামলায় দণ্ডিত হন এবং শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে তাঁর ‘কথিত অপকর্মে’র গল্প ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল।

তা সত্ত্বেও, তারেক রহমান দলের ওপর তাঁর শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ও ঐক্য বজায় রাখতে সফল হন। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান তাঁকে দ্বিতীয় সুযোগ এনে দেয়। গত দেড় বছরে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং দণ্ডাদেশ স্থগিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশি ভূ-রাজনৈতিক কলামিস্ট শাফকাত রাব্বি বলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে তারেক রহমানের মূল বৈশিষ্ট্য হবে নীতি বা পলিসির ওপর গুরুত্ব দেওয়া। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি একজন নীতি বিশ্লেষক হিসেবেই পরিচিত। আজ লাখো সমর্থকের সামনে দেওয়া ভাষণেও তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর একটি পরিকল্পনা আছে।

তারেক রহমানের পরিকল্পনার মূল দিক যা পুরো দক্ষিণ এশিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, তা হলো ভারতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি।

‘দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব ব্যক্তিত্ব’

ঐতিহাসিকভাবে, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল অনেকটাই শীতল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারত কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখলেও, অধিকাংশ সময় তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে অংশীদার হিসেবে তারা হাসিনা ও আওয়ামী লীগকেই পছন্দ করে।

দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল হলো জামায়াতে ইসলামী। দলটির সঙ্গে বিএনপির জোট ছিল কয়েক দশকের পুরোনো। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই জোট কোনো সহায়তা করেনি। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবেই দলটি ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পক্ষপাতী ছিল।

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, বাংলাদেশে হাসিনা-বিরোধী মনোভাবের কারণে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী থেকে তীব্র ভারত-বিরোধিতা দেখা গেলেও, বিএনপি তুলনামূলকভাবে সংযত অবস্থান বজায় রেখেছে।

দলটি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে ও নিজেদের একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। দৃশ্যত তারা আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া রাজনৈতিক স্থানটি দখল করতে আগ্রহী।

যদিও তারেক রহমান ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ স্লোগান গ্রহণ করেছেন, তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন তিনি উগ্র ভারত-বিরোধী রাজনীতিবিদ হবেন না।

রাব্বি বলেন, ‘তারেক বাংলাদেশে ফিরে আসায় ভারতের জন্য প্রাথমিক ধারণা হবে যে, ভারতীয়রা অবশেষে আলোচনার জন্য এমন একজন পরিপক্ব ব্যক্তিকে (এডাল্ট ইন দ্য রুম) পাবে যার হাতে গুরুতর রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে।’

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক জরিপগুলো দেখাচ্ছে, নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার এখনও সিদ্ধান্তহীন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রেও রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপিকে সাহায্য করবে।

অধ্যাপক শাহান বলেন, ‘তারেক রহমানের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই দলের তৃণমূলকে উজ্জীবিত করবে ও সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের বিএনপির দিকে ঝুঁকতে উৎসাহিত করবে। তিনি যদি ভালো করতে পারেন, তবে আমরা ‘গণজোয়ারের’ নির্বাচন দেখতে পারি যেখানে বিএনপি ধস নামানো জয় পেতে পারে।’

তবে শাহান বলেন, সেটা ঘটতে হলে তারেক রহমানকে দেখাতে হবে, ‘তিনি মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন, তাদের আশ্বস্ত করতে পারেন এবং সংস্কার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য স্পষ্ট পথ দেখাতে পারেন।’

~ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদন। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত