leadT1ad

পাঁচটি ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ খেলাপি, ‘ট্রুথ কমিশন’ গঠনের দাবি

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৪৫
আরআই চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৩৫ শতাংশই এখন খেলাপি। বিশেষ করে পাঁচটি ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। সংকট মোকাবিলায় এই রুগ্‌ণ ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে নতুন একটি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে শুধু একীভূত করলেই ব্যাংক খাত পুনর্গঠন হবে না, প্রয়োজন আরও অনেক সংস্কার—যা পরবর্তী সরকারকে করতে হবে। এ জন্য একটি ‘ট্রুথ ও রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত ‘ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা ও রেজল্যুশনে উদ্যোগ এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল সভায় বক্তারা এসব অভিমত তুলে ধরেন। পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

সভায় জায়েদি সাত্তার বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের রক্তক্ষরণ থেমে এসেছে এবং কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। আমি আশা করি, আগামী বছর প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। এ জন্য আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটি সুন্দর, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জাতির জন্য এক বড় উপহার হবে বলে আমি মনে করি।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে লুৎফে সিদ্দিকী বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে পরিস্থিতি আগের মতোই চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। অর্থনৈতিক অপরাধ ও খেলাপি ঋণের কারণ উদ্ঘাটনে তিনি ‘ট্রুথ ও রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের সুপারিশ করেন।

লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর আমি যখন কাজে যোগ দেই, তখন প্রথমেই যে বিষয়গুলো দেখতে হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল তৈরি পোশাক খাত। অনেক মালিক আগের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং শ্রমিকেরা বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় ছিলেন। আমাদের তখন টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হয়েছিল কোম্পানিগুলোর নিজস্ব টাকা আছে কি না।’

একাধিকবার ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সভা করার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কোম্পানিগুলোর ঋণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তারা জবাবে ২২ হাজার থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকার তথ্য দেয়। অর্থাৎ ৪ হাজার কোটি টাকার হিসাব নেই। কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল? অর্ধেক প্রতিষ্ঠান তো কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিতই নয়। তার মানে আমরা জানি না কোন সত্তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে একটি “ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন” থাকা জরুরি। এটি কেবল নীতি বা আইন দিয়ে হবে না, মাইক্রো লেভেলের আচরণ এবং কন্ডাক্ট সংশোধনের মাধ্যমে হতে হবে।’

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে পিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং রেজল্যুশন অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের জন্য এখন প্রয়োজন কার্যকর প্রক্রিয়া, পদ্ধতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় বিনিয়োগ। সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাংকগুলোর সমস্যার সমাধান করা, সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা এবং আমানতকারীদের সুরক্ষার সক্ষমতা না থাকলে এই অধ্যাদেশ কাগুজে প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তিনি আর্থিক অপরাধ তদারকিতে পৃথক ইউনিট গঠন, পেশাদার সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন ও আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার ওপর জোর দেন।

মুক্ত আলোচনায় প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের অর্থনীতিতে ফেরার কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না, তাদের নতুন করে কোনো অর্থায়ন করা যাবে না। পরিচালক হতে ২ শতাংশ শেয়ারের সীমা বাতিল করে পরিবারের শেয়ারের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আখতার হোসেন বলেন, উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, যা মুদ্রানীতি প্রণয়নে সমস্যা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে যেভাবে পাঁচ ব্যাংক একীভূত হচ্ছে, পৃথিবীর কোথাও এভাবে ব্যাংক উদ্ধার হয়নি। এসব ব্যাংকের ৯০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে গেছে, যা নজিরবিহীন। পরবর্তীতে আরও ব্যাংক একীভূতকরণের আওতায় আসবে। ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও একইভাবে রেজল্যুশনের আওতায় আসছে।’

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে কোনো ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা সঠিক। অতীতে অনেক খারাপ ব্যাংক এখন ভালো ব্যাংক হিসেবে গড়ে উঠেছে।’

ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ রশিদ বলেন, ‘একীভূত ব্যাংকের গ্রাহকরা কত শতাংশ টাকা ফেরত পাবেন ও কত শতাংশ গ্রাহক শেয়ার পাবেন, তার ওপর নির্ভর করছে এই প্রক্রিয়ার সাফল্য। পুরো খাতের প্রকৃত খেলাপি ঋণ হিসাবে আনা দরকার।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত