স্ট্রিম ডেস্ক

বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে ফরেন ইনফরমেশন ম্যানিপুলেশন অ্যান্ড ইন্টারফারেন্স (এফআইএমআই) তথা বিদেশি অপপ্রচার ও তথ্য-হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি। মানবাধিকার দিবস পালনের সময় বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে।
এ অবস্থায় বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ নিয়ে নতুন এক সতর্কবার্তা দিয়েছে ইলেকশন ইন্টেগ্রিটি টাস্ক ফোর্স (ইআইটিএফ)। এটি নির্বাচন সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত একটি ফোরাম।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর ২০২৫) প্রকাশিত ইআইটিএফের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতির ওপর বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে আঞ্চলিক শক্তিগুলো দেশের বিভক্ত গণমাধ্যম পরিবেশকে ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অভ্যন্তরীণ মেরুকরণ এবং অতিরিক্ত চাপের তথ্য–পরিবেশ বিদেশি তথ্য-হস্তক্ষেপের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এই নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম নির্বাচন। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করেছে। তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বিভিন্ন বিরোধী বয়ান পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
বিদেশি গণমাধ্যম নেটওয়ার্কের সম্পৃক্ততা
রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান তাকে বহিরাগত প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে স্পর্শকাতর করে তুলেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার তত্ত্বাবধান করছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েন, পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন ঘনিষ্ঠতা এবং চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ—এসব ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বিদেশি অপপ্রচার ও তথ্য-হস্তক্ষেপের জন্য উর্বর পরিবেশ তৈরি করেছে। ৭ কোটি ৭০ লাখ অনলাইন ব্যবহারকারীর তুলনামূলক কম মিডিয়া সাক্ষরতা এবং ফেসবুক (৬ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারী) ও টিকটকের (৪ কোটি ৬৫ লাখ ব্যবহারকারী) মতো প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক প্রভাব দেশকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
প্রতিবেদনে ভারত, পাকিস্তান এবং চীনের বিভিন্ন গণমাধ্যম নেটওয়ার্ককে বাংলাদেশের অস্থির তথ্য পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক প্রভাবক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মূল অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম সাম্প্রতিক তথ্য-বিকৃতি ও অপপ্রচারে বড় ভূমিকা রাখছে। রিপাবলিক বাংলা, জি ২৪ ঘণ্টা, এএনআই ও আইএএনএস—এসব প্রতিষ্ঠান অনেক সময় যাচাইবাছাই ছাড়াই খবর ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘হিন্দু গণহত্যা’ প্রসঙ্গ বা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘সরকার পরিবর্তন’ হয়েছে, এমন দাবি।
#BangladeshHindusGenocide এবং #TMD (Total Malaun Death)-এর মতো হ্যাশট্যাগ এক্স প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক ছড়িয়েছে, যার পেছনে সমন্বিত বট ও টাকার বিনিময়ে কাজ করা প্রচারকরা সক্রিয় ছিল।
পাকিস্তান-সংযুক্ত প্রতিরক্ষা ফোরাম এবং নবগঠিত সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলগুলো নির্বাচিত ইতিহাস পুনর্ব্যাখ্যা, ইসলামপন্থী গোষ্ঠী সম্পর্কিত মন্তব্য এবং বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে প্রভাব গঠনের মতো সামগ্রী প্রচার করছে।
সিজিটিএন, সিএমজি, শিনহুয়া এবং সিআরআই-এর মতো চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সাধারণত স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং ‘বহিরাগত হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে সতর্কতার বার্তা প্রচার করছে। এগুলো সরাসরি বিভ্রান্তিকর না হলেও চীনের কৌশলগত স্বার্থ প্রতিফলিত করে।
মানবাধিকার দিবসে সরকারবিরোধী প্রচারণা
প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর) উপলক্ষে প্রকাশিত হওয়ায় এর সময়টিও বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। ইআইটিএফ মনে করে, দিনটিকে বিভিন্ন পক্ষ প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারে। দিনটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সামাজিকমাধ্যমে মানবাধিকার ইস্যুতে স্বাভাবিক আলোচনার পাশাপাশি সূক্ষ্ম প্রচারণাও চলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু ওয়েবিনার এবং পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে অস্থিরতার চিত্র তৈরি করা হয়েছে, যা জনগণের আস্থা দুর্বল করার কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এক্স-এর একটি পোস্টে অভিযোগ করা হয় যে ভারত নাকি ইউনূস প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উসকে দিতে ‘কয়েক বিলিয়ন ডলার’ ব্যয় করছে।
অন্য কিছু পোস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মানবাধিকার দিবসের বার্তায় দ্বৈত মানসিকতার অভিযোগ তোলা হয়। তবে ইআইটিএফ জানায়, এদিন কোনো ব্যাপক সমন্বিত প্রচারণার লক্ষণ পাওয়া যায়নি। অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৪-এ বট কার্যক্রম ২১৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার যে নজির ছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা
ইআইটিএফ বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বিশেষ করে বাংলা ভাষায় উন্নত ও নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং এবং প্ল্যাটফর্ম পর্যবেক্ষণ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিদেশি প্রভাবশালী পক্ষগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ছবি এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে একযোগে প্রচারের মতো কৌশল ব্যবহার করছে। এগুলো সমাজকে আরও বিভক্ত করতে এবং অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে পারে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশই ১৫–২৯ বছর বয়সী তরুণ, যারা মূলত সামাজিকমাধ্যম থেকে খবর সংগ্রহ করে। আবার প্রচলিত টেলিভিশনের ওপরও ৬৫ শতাংশ মানুষ আস্থা রাখে, যদিও মালিকানা কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০২১ সালে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও দেখিয়েছে যে অনলাইন বিভ্রান্তি কীভাবে বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখনো প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানায়নি। নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ডিজিটাল নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই। ফলে প্রাথমিকভাবে হুমকি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে সামনে রেখে ইআইটিএফ প্রতি দুই সপ্তাহে বুলেটিন ও প্রয়োজন অনুযায়ী সতর্কবার্তা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে। কারণ বিদেশি অপপ্রচার ও প্রভাব বিস্তারের আরেকটি উপলক্ষ্য হতে পারে বিজয় দিবস। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো গণমাধ্যম-সাক্ষরতা বাড়াতে বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ের আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি প্রচারণার প্রভাব কমাতে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে প্রার্থী ঘোষণা এবং বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘিরে যে বয়ানের পরিবর্তন ঘটছে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাচন সময় মতো হবে কিনা তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের মধ্যেই এ পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। ইআইটিএফ-এর প্রাথমিক বিশ্লেষণে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ নির্বাচনের সম্ভাবনা ধরা হলেও ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্যে নমনীয়তার ইঙ্গিত মিলেছে। সংস্কারের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন ২০২৬ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে। বিএনপির মতো বিরোধী দলগুলো সতর্ক করেছে যে দীর্ঘ বিলম্ব অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে। এতে বিদেশি প্রভাব বিস্তারের আরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ কী, কেন তা বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য হুমকি
বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ (এফআইএমআই) বলতে বোঝায় এমন সমন্বিত প্রচেষ্টা, যেখানে বিদেশি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র-সমর্থিত পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া তথ্য বা বিকৃত তথ্য প্রচার করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। এ ধরনের প্রচারণা সাধারণত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়। এটি সাধারণ ভুয়া তথ্যের মতো এলোমেলো নয়; বরং কৌশলগত। এখানে বট, ভুয়া অ্যাকাউন্ট, নকল তথ্য বা ছবি ব্যবহার করে বিভাজন সৃষ্টি করা, আস্থা দুর্বল করা বা নির্বাচনের কাঙ্ক্ষিত ফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়।
বাংলাদেশের তথ্যব্যবস্থঅপনা দুর্বল হওয়ায় সহজেই এই প্রচারণা চালানো যায়। দেশে ১৮ কোটি ৫০ লাখ মোবাইল সংযোগ রয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যত একটি ‘জনসমাগমস্থলে’ পরিণত হয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মে বিভাজনমূলক সামগ্রী সহজেই বিস্তার লাভ করে।
ইআইটিএফ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আচরণভিত্তিক কাঠামো অনুসরণ করে। এতে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় উৎস (বিদেশি সম্পৃক্ততা), কৌশল (নেটওয়ার্কভিত্তিক প্রচার), এবং উদ্দেশ্য (গণতন্ত্র দুর্বল করা) চিহ্নিত করার ওপর। ইআইটিএফ এর এবিসিডিই মডেলে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে—
এ=অ্যাক্টরস: যারা প্রচারণা চালায়। মূলত ভারতীয় নেটওয়ার্ক, বিশেষত কিছু বিজেপিপন্থী মাধ্যম, যারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদার করছে। পাশাপাশি পাকিস্তান ও চীনের প্রভাবও বাড়ছে। কিছু স্থানীয় প্রক্সি, যেমন নির্বাসিত আওয়ামী লীগপন্থীরা, এসব প্রচারণাকে আরও জোরদার করে।
বি=বিহেভিওর: প্রচারণার ধরন। সমন্বিত হ্যাশট্যাগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ডিপফেক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ছবি ও জাল নথি প্রচার, গুজব বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে পুনর্ব্যবহার করে ইউটিউব আলোচনায় রূপান্তর, অপরিচিত ওয়েবসাইটে ঘোস্ট-রাইটার দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ এবং যাচাইহীন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মূলধারার মাধ্যমে পুনরায় প্রচার এবং গুজবকে সংবাদ আকারে ‘ধুয়ে-মুছে’ পরিবেশনের মতো কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে।
সি=কনটেন্ট: কী ধরনের তথ্য প্রচার করা হয়। ইউনূসকে অকার্যকর বা ‘যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের প্রার্থী’ আখ্যা দেওয়া, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানো (‘হিন্দু গণহত্যা’), কিংবা পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মতো ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো এতে অন্তর্ভুক্ত।
ডি=ডিগ্রি/ডিস্ট্রিবিউশন: টার্গেট অডিয়েন্স বা দর্শক-শ্রোতা। বিভিন্ন দর্শকের জন্য পৃথক বার্তা তৈরি হয়। দেশীয় ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে বাংলায় ভীতি সৃষ্টি করা হয়। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য করে ইংরেজি সামগ্রী পরিবেশিত হয়। ফেসবুক বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে পৌঁছায়, আর এক্স নীতিগত আলোচনার পরিসরে প্রভাব ফেলে।
ই=ইফেক্ট: কী প্রভাব পড়ে। সমাজে বিভাজন গভীর হয়। সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ে। দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা বিনিয়োগকারী বা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
ইআইটিএফ বলেছে, প্রতিরোধের জন্য আগাম উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৫০টি ফ্যাক্ট-চেক বা সত্য-যাচাই উদ্যোগ রয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। গণমাধ্যম-সাক্ষরতা বৃদ্ধি, প্ল্যাটফর্মগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং শক্তিশালী ফ্যাক্ট-চেকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
ইআইটিএফ-এর চলমান পর্যবেক্ষণ একটি আগাম-সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে সমন্বিত সহযোগিতার ওপর। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের পথে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ মোকাবিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইআইটিএফ সামনের দিনে নতুন অপপ্রচারের সম্ভাব্য বয়ানের কাঠামোর উদারহণ দিয়ে বলেছে:
দাবি উঠতে পারে যে আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়লে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন স্বাধীন, নিরপেক্ষ বা বৈধ হবে না।
কিছু বয়ানে বলা হতে পারে যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি সত্যিকারের স্বাধীন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।
এমন মতও প্রচারিত হতে পারে যে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচনের পর গঠিত সরকার বাংলাদেশকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেবে অথবা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে।
নির্বাসিত গোষ্ঠী এবং ডানপন্থী নেটওয়ার্কগুলো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগ জোরালো করতে পারে। তারা গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশকে সহযোগী হিসেবেও তুলে ধরতে পারে।
ইলেকশন ইন্টিগ্রিটি টাস্ক ফোর্স (ইআইটিএফ) একটি দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা। এর লক্ষ্য হলো নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি তথ্য বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ এবং অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় অংশীজনদের সহায়তা করা। এই সহায়তা নির্বাচনের আগে, চলাকালে এবং পরবর্তী সময়েও দেওয়া হয়।
ইআইটিএফ কানাডা সরকারের অনুদানে পরিচালিত একটি উদ্যোগ। এটি কয়েকটি স্বাধীন এনজিও তথা গ্লোবাল মিডিয়া রেজিস্ট্রি (জিএমআর), ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস) এবং ফঁদাসিওঁ ইরোন্ডেল এর যৌথ বাস্তবায়নে পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশে একটি স্থানীয় দলও এ উদ্যোগে কাজ করছে।
আগামী কয়েক সপ্তাহ এবং নির্বাচনের পরের এক মাসে ইআইটিএফ নিয়মিত বুলেটিন, সতর্কবার্তা এবং সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ প্রকাশ করবে। এসব নথিতে তথ্য পরিবেশনের প্রধান প্রবণতা ও ধরণগুলো তুলে ধরা হবে।

বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে ফরেন ইনফরমেশন ম্যানিপুলেশন অ্যান্ড ইন্টারফারেন্স (এফআইএমআই) তথা বিদেশি অপপ্রচার ও তথ্য-হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি। মানবাধিকার দিবস পালনের সময় বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে।
এ অবস্থায় বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ নিয়ে নতুন এক সতর্কবার্তা দিয়েছে ইলেকশন ইন্টেগ্রিটি টাস্ক ফোর্স (ইআইটিএফ)। এটি নির্বাচন সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত একটি ফোরাম।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর ২০২৫) প্রকাশিত ইআইটিএফের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতির ওপর বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে আঞ্চলিক শক্তিগুলো দেশের বিভক্ত গণমাধ্যম পরিবেশকে ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অভ্যন্তরীণ মেরুকরণ এবং অতিরিক্ত চাপের তথ্য–পরিবেশ বিদেশি তথ্য-হস্তক্ষেপের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এই নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম নির্বাচন। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করেছে। তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বিভিন্ন বিরোধী বয়ান পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
বিদেশি গণমাধ্যম নেটওয়ার্কের সম্পৃক্ততা
রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান তাকে বহিরাগত প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে স্পর্শকাতর করে তুলেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার তত্ত্বাবধান করছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েন, পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন ঘনিষ্ঠতা এবং চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ—এসব ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বিদেশি অপপ্রচার ও তথ্য-হস্তক্ষেপের জন্য উর্বর পরিবেশ তৈরি করেছে। ৭ কোটি ৭০ লাখ অনলাইন ব্যবহারকারীর তুলনামূলক কম মিডিয়া সাক্ষরতা এবং ফেসবুক (৬ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারী) ও টিকটকের (৪ কোটি ৬৫ লাখ ব্যবহারকারী) মতো প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক প্রভাব দেশকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
প্রতিবেদনে ভারত, পাকিস্তান এবং চীনের বিভিন্ন গণমাধ্যম নেটওয়ার্ককে বাংলাদেশের অস্থির তথ্য পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক প্রভাবক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মূল অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম সাম্প্রতিক তথ্য-বিকৃতি ও অপপ্রচারে বড় ভূমিকা রাখছে। রিপাবলিক বাংলা, জি ২৪ ঘণ্টা, এএনআই ও আইএএনএস—এসব প্রতিষ্ঠান অনেক সময় যাচাইবাছাই ছাড়াই খবর ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘হিন্দু গণহত্যা’ প্রসঙ্গ বা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘সরকার পরিবর্তন’ হয়েছে, এমন দাবি।
#BangladeshHindusGenocide এবং #TMD (Total Malaun Death)-এর মতো হ্যাশট্যাগ এক্স প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক ছড়িয়েছে, যার পেছনে সমন্বিত বট ও টাকার বিনিময়ে কাজ করা প্রচারকরা সক্রিয় ছিল।
পাকিস্তান-সংযুক্ত প্রতিরক্ষা ফোরাম এবং নবগঠিত সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলগুলো নির্বাচিত ইতিহাস পুনর্ব্যাখ্যা, ইসলামপন্থী গোষ্ঠী সম্পর্কিত মন্তব্য এবং বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে প্রভাব গঠনের মতো সামগ্রী প্রচার করছে।
সিজিটিএন, সিএমজি, শিনহুয়া এবং সিআরআই-এর মতো চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সাধারণত স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং ‘বহিরাগত হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে সতর্কতার বার্তা প্রচার করছে। এগুলো সরাসরি বিভ্রান্তিকর না হলেও চীনের কৌশলগত স্বার্থ প্রতিফলিত করে।
মানবাধিকার দিবসে সরকারবিরোধী প্রচারণা
প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর) উপলক্ষে প্রকাশিত হওয়ায় এর সময়টিও বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। ইআইটিএফ মনে করে, দিনটিকে বিভিন্ন পক্ষ প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারে। দিনটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সামাজিকমাধ্যমে মানবাধিকার ইস্যুতে স্বাভাবিক আলোচনার পাশাপাশি সূক্ষ্ম প্রচারণাও চলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু ওয়েবিনার এবং পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে অস্থিরতার চিত্র তৈরি করা হয়েছে, যা জনগণের আস্থা দুর্বল করার কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এক্স-এর একটি পোস্টে অভিযোগ করা হয় যে ভারত নাকি ইউনূস প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উসকে দিতে ‘কয়েক বিলিয়ন ডলার’ ব্যয় করছে।
অন্য কিছু পোস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মানবাধিকার দিবসের বার্তায় দ্বৈত মানসিকতার অভিযোগ তোলা হয়। তবে ইআইটিএফ জানায়, এদিন কোনো ব্যাপক সমন্বিত প্রচারণার লক্ষণ পাওয়া যায়নি। অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৪-এ বট কার্যক্রম ২১৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার যে নজির ছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা
ইআইটিএফ বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বিশেষ করে বাংলা ভাষায় উন্নত ও নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং এবং প্ল্যাটফর্ম পর্যবেক্ষণ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিদেশি প্রভাবশালী পক্ষগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ছবি এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে একযোগে প্রচারের মতো কৌশল ব্যবহার করছে। এগুলো সমাজকে আরও বিভক্ত করতে এবং অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে পারে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশই ১৫–২৯ বছর বয়সী তরুণ, যারা মূলত সামাজিকমাধ্যম থেকে খবর সংগ্রহ করে। আবার প্রচলিত টেলিভিশনের ওপরও ৬৫ শতাংশ মানুষ আস্থা রাখে, যদিও মালিকানা কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০২১ সালে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও দেখিয়েছে যে অনলাইন বিভ্রান্তি কীভাবে বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখনো প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানায়নি। নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ডিজিটাল নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই। ফলে প্রাথমিকভাবে হুমকি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে সামনে রেখে ইআইটিএফ প্রতি দুই সপ্তাহে বুলেটিন ও প্রয়োজন অনুযায়ী সতর্কবার্তা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে। কারণ বিদেশি অপপ্রচার ও প্রভাব বিস্তারের আরেকটি উপলক্ষ্য হতে পারে বিজয় দিবস। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো গণমাধ্যম-সাক্ষরতা বাড়াতে বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ের আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি প্রচারণার প্রভাব কমাতে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে প্রার্থী ঘোষণা এবং বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘিরে যে বয়ানের পরিবর্তন ঘটছে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাচন সময় মতো হবে কিনা তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের মধ্যেই এ পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। ইআইটিএফ-এর প্রাথমিক বিশ্লেষণে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ নির্বাচনের সম্ভাবনা ধরা হলেও ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্যে নমনীয়তার ইঙ্গিত মিলেছে। সংস্কারের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন ২০২৬ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে। বিএনপির মতো বিরোধী দলগুলো সতর্ক করেছে যে দীর্ঘ বিলম্ব অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে। এতে বিদেশি প্রভাব বিস্তারের আরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ কী, কেন তা বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য হুমকি
বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ (এফআইএমআই) বলতে বোঝায় এমন সমন্বিত প্রচেষ্টা, যেখানে বিদেশি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র-সমর্থিত পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া তথ্য বা বিকৃত তথ্য প্রচার করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। এ ধরনের প্রচারণা সাধারণত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়। এটি সাধারণ ভুয়া তথ্যের মতো এলোমেলো নয়; বরং কৌশলগত। এখানে বট, ভুয়া অ্যাকাউন্ট, নকল তথ্য বা ছবি ব্যবহার করে বিভাজন সৃষ্টি করা, আস্থা দুর্বল করা বা নির্বাচনের কাঙ্ক্ষিত ফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়।
বাংলাদেশের তথ্যব্যবস্থঅপনা দুর্বল হওয়ায় সহজেই এই প্রচারণা চালানো যায়। দেশে ১৮ কোটি ৫০ লাখ মোবাইল সংযোগ রয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যত একটি ‘জনসমাগমস্থলে’ পরিণত হয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মে বিভাজনমূলক সামগ্রী সহজেই বিস্তার লাভ করে।
ইআইটিএফ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আচরণভিত্তিক কাঠামো অনুসরণ করে। এতে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় উৎস (বিদেশি সম্পৃক্ততা), কৌশল (নেটওয়ার্কভিত্তিক প্রচার), এবং উদ্দেশ্য (গণতন্ত্র দুর্বল করা) চিহ্নিত করার ওপর। ইআইটিএফ এর এবিসিডিই মডেলে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে—
এ=অ্যাক্টরস: যারা প্রচারণা চালায়। মূলত ভারতীয় নেটওয়ার্ক, বিশেষত কিছু বিজেপিপন্থী মাধ্যম, যারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদার করছে। পাশাপাশি পাকিস্তান ও চীনের প্রভাবও বাড়ছে। কিছু স্থানীয় প্রক্সি, যেমন নির্বাসিত আওয়ামী লীগপন্থীরা, এসব প্রচারণাকে আরও জোরদার করে।
বি=বিহেভিওর: প্রচারণার ধরন। সমন্বিত হ্যাশট্যাগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ডিপফেক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ছবি ও জাল নথি প্রচার, গুজব বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে পুনর্ব্যবহার করে ইউটিউব আলোচনায় রূপান্তর, অপরিচিত ওয়েবসাইটে ঘোস্ট-রাইটার দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ এবং যাচাইহীন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মূলধারার মাধ্যমে পুনরায় প্রচার এবং গুজবকে সংবাদ আকারে ‘ধুয়ে-মুছে’ পরিবেশনের মতো কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে।
সি=কনটেন্ট: কী ধরনের তথ্য প্রচার করা হয়। ইউনূসকে অকার্যকর বা ‘যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের প্রার্থী’ আখ্যা দেওয়া, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানো (‘হিন্দু গণহত্যা’), কিংবা পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মতো ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো এতে অন্তর্ভুক্ত।
ডি=ডিগ্রি/ডিস্ট্রিবিউশন: টার্গেট অডিয়েন্স বা দর্শক-শ্রোতা। বিভিন্ন দর্শকের জন্য পৃথক বার্তা তৈরি হয়। দেশীয় ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে বাংলায় ভীতি সৃষ্টি করা হয়। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য করে ইংরেজি সামগ্রী পরিবেশিত হয়। ফেসবুক বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে পৌঁছায়, আর এক্স নীতিগত আলোচনার পরিসরে প্রভাব ফেলে।
ই=ইফেক্ট: কী প্রভাব পড়ে। সমাজে বিভাজন গভীর হয়। সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ে। দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা বিনিয়োগকারী বা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
ইআইটিএফ বলেছে, প্রতিরোধের জন্য আগাম উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৫০টি ফ্যাক্ট-চেক বা সত্য-যাচাই উদ্যোগ রয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। গণমাধ্যম-সাক্ষরতা বৃদ্ধি, প্ল্যাটফর্মগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং শক্তিশালী ফ্যাক্ট-চেকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
ইআইটিএফ-এর চলমান পর্যবেক্ষণ একটি আগাম-সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে সমন্বিত সহযোগিতার ওপর। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের পথে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিদেশি তথ্য-বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ মোকাবিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইআইটিএফ সামনের দিনে নতুন অপপ্রচারের সম্ভাব্য বয়ানের কাঠামোর উদারহণ দিয়ে বলেছে:
দাবি উঠতে পারে যে আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়লে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন স্বাধীন, নিরপেক্ষ বা বৈধ হবে না।
কিছু বয়ানে বলা হতে পারে যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি সত্যিকারের স্বাধীন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।
এমন মতও প্রচারিত হতে পারে যে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচনের পর গঠিত সরকার বাংলাদেশকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেবে অথবা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে।
নির্বাসিত গোষ্ঠী এবং ডানপন্থী নেটওয়ার্কগুলো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগ জোরালো করতে পারে। তারা গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশকে সহযোগী হিসেবেও তুলে ধরতে পারে।
ইলেকশন ইন্টিগ্রিটি টাস্ক ফোর্স (ইআইটিএফ) একটি দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা। এর লক্ষ্য হলো নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি তথ্য বিকৃতি ও হস্তক্ষেপ এবং অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় অংশীজনদের সহায়তা করা। এই সহায়তা নির্বাচনের আগে, চলাকালে এবং পরবর্তী সময়েও দেওয়া হয়।
ইআইটিএফ কানাডা সরকারের অনুদানে পরিচালিত একটি উদ্যোগ। এটি কয়েকটি স্বাধীন এনজিও তথা গ্লোবাল মিডিয়া রেজিস্ট্রি (জিএমআর), ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস) এবং ফঁদাসিওঁ ইরোন্ডেল এর যৌথ বাস্তবায়নে পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশে একটি স্থানীয় দলও এ উদ্যোগে কাজ করছে।
আগামী কয়েক সপ্তাহ এবং নির্বাচনের পরের এক মাসে ইআইটিএফ নিয়মিত বুলেটিন, সতর্কবার্তা এবং সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ প্রকাশ করবে। এসব নথিতে তথ্য পরিবেশনের প্রধান প্রবণতা ও ধরণগুলো তুলে ধরা হবে।

চুয়াডাঙ্গায় পুলিশের বাৎসরিক ফায়ারিংয়ের অনুশীলনের পাশের সড়কে এক মোটরসাইলচালক (বাইক) গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জেলার জাফরপুর বিজিবি ক্যাম্পে পুলিশের মাস্কেট্রি ফায়ারিং চলা অবস্থায় এ ঘটনা ঘটে।
৪১ মিনিট আগে
মোহাম্মদপুরে মা লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে (১৫) হত্যার ঘটনায় ‘ক্লুলেস’ অবস্থায় শুরু হয়েছিল তদন্ত। গৃহকর্মী আয়েশার কোনো ছবি, এনআইডি, মোবাইল নম্বর; কিছুই না থাকায় এটি ছিল পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ
২ ঘণ্টা আগে
বিশেষ করে তরুণ, নারী ও অনগ্রসর অঞ্চলের ভোটারদের হ্যাঁ ও না ভোটের বিষয়টি সহজভাবে বোঝাতে হবে। কারণ, এই বিষয়টির সঙ্গে তারা পরিচিত নন।
২ ঘণ্টা আগে
রংপুরের তারাগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় ও তাঁর স্ত্রী সুর্বণা রায়কে নিজ বাড়িতে হত্যার চার দিন পেরিয়ে গেলেও আসামি শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) বেলা ১১টার দিকে উপজেলা চত্বর সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।
২ ঘণ্টা আগে