leadT1ad

বিশ্ব এইডস দিবস

খুলনা অঞ্চলে এইডস শনাক্ত বাড়ছে, এক বছরে মৃত্যু ২৩

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
খুলনা

খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি)। স্ট্রিম ছবি

খুলনা অঞ্চলে প্রতি বছর এইচআইভি পজিটিভ বা এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। গত এক বছরে এ অঞ্চলে শনাক্ত ও মৃত্যু—উভয় সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। চিকিৎসকরা বলছেন, এখনই সচেতন না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন পরীক্ষা করাতে আসেন। কাউকে পজিটিভ পাওয়া গেলে নিয়মিত কাউন্সেলিং ও বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৫৮ জন এইচআইভি-পজিটিভ রোগী নিয়ে এই এআরটি সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হয়। খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, পিরোজপুর, ঝালকাঠিসহ আশপাশের জেলা থেকেও রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও (এনজিও) খুলনা অঞ্চলে এইচআইভি-পজিটিভ রোগীদের নিয়ে কাজ করছে।

এআরটি সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৯ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ১০০ জনকে নতুন করে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন শিশু। এ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ১৭ জন, নারী ৬ জন। মৃতদের মধ্যে যশোরে ৭, খুলনায় ৪, নড়াইলে ৪, সাতক্ষীরায় ৪, বাগেরহাটে ২ এবং পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে ১ জন করে ছিলেন।

২০২৪ সালে ১ হাজার ৫৪৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছিল ৮৫ জন, মৃত্যু হয়েছিল ২০ জনের। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে।

নতুন শনাক্তদের মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠী ৫৬ জন, সমকামী ৩৭ জন এবং রক্তের মাধ্যমে সংক্রমিত ৭ জন। জেলাভিত্তিক শনাক্তে খুলনায় ৪৯, বাগেরহাটে ১৬, নড়াইলে ১১, সাতক্ষীরায় ১১, যশোরে ৬, গোপালগঞ্জে ৩, পিরোজপুরে ২, কুষ্টিয়ায় ১ এবং রাজবাড়ীতে ১ জন পাওয়া গেছে। লিঙ্গ অনুযায়ী পুরুষ ৩৫, নারী ১৪ জন।

খুলনা জেনারেল হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৯ জনের শরীরে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮ জন পুরুষ। এদের অনেকে জানান, অনিরাপদ যৌনসম্পর্কই সংক্রমণের কারণ।

খুলনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম গাজী বলেন, আক্রান্তদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। অনিরাপদ যৌনসম্পর্কই প্রধান কারণ। স্ক্রিনিংবিহীন রক্ত গ্রহণ করেও সংক্রমণ ছড়ায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশে শনাক্তের হার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিলেন ৬৫৮ জন, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৩৮-এ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ২৫–৪৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকসেবীদের ইনজেকশনের পুনর্ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণ, অভিবাসীদের মাধ্যমে ভাইরাস আগমন এবং পর্যাপ্ত পরীক্ষা না হওয়ার মতো কারণে দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে ১৪টি সেন্টারে প্রায় ৮ হাজার ২৪৫ রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেন, এইচআইভি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য না হলেও এখন নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে। অরক্ষিত যৌনসম্পর্কের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে।

এআরটি সেন্টারের ফোকাল পারসন ডা. ইকবাল হোসাইন বলেন, সীমান্তঘেঁষা জেলা হওয়ায় খুলনায় ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। সমুদ্র ও স্থলসীমান্ত দিয়ে প্রবেশকারী ব্যক্তিদের রক্ত পরীক্ষা না হওয়া, নিষিদ্ধপল্লী ও ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা না থাকা এবং যৌনসম্পর্কে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অনীহা পরিস্থিতিকে জটিল করছে।

তিনি বলেন, নারী-পুরুষ হোক বা পুরুষ-পুরুষ—অরক্ষিত যৌনসম্পর্কই সংক্রমণের সবচেয়ে বড় কারণ। গর্ভকালীন সময়, সন্তান জন্ম এবং দুধ পান করানোর মাধ্যমেও মা-শিশুর মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। প্রতিবার যৌনসম্পর্কের সময় কনডম ব্যবহার, একাধিক সঙ্গী এড়িয়ে চলা, রক্ত বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আগে পরীক্ষা করানো এবং ব্যবহৃত সুচ ব্যবহার না করাই প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

তিনি আরও জানান, অনলাইনভিত্তিক অ্যাপে সমকামী ব্যক্তিদের যোগাযোগ বাড়ছে, যা ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে। আক্রান্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, অনেকে আত্মহননের কথাও ভাবেন। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের নিয়মিত সহযোগিতা দেওয়া হয়।

এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দিবেশ ওঝা বলেন, বর্তমানে আইডিভুক্ত রোগী ৮৮৭ জন। তাঁদের মধ্যে পুরুষ ৫৪২, নারী ৩৩৮, হিজড়া ১৭ জন। নিয়মিত ওষুধ নিচ্ছেন ৫৫০ জন। বাকিদের কেউ মারা গেছেন, কেউ অন্য সেন্টারে গিয়েছেন।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে খুলনা অঞ্চলে এইচআইভি পজিটিভ ছিলেন ৩৬ জন, মারা যান ৭ জন। ২০২১ সালে শনাক্ত ২৮, মৃত্যু ৫। ২০২২ সালে শনাক্ত ৬৫, মৃত্যু ৮। ২০২৩ সালে শনাক্ত ৬৫, মৃত্যু ১৯। ২০২৪ সালে শনাক্ত ৮৫, মৃত্যু ২০ জন।

সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, এক কিশোরসহ চারজন পরীক্ষা করাতে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন তৃতীয় লিঙ্গের। সবাই এইচআইভি নেগেটিভ শনাক্ত হন।

একজন আক্রান্ত ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোগটি জানার পর মনে হয়েছিল সব শেষ। খুমেকে কাউন্সেলিংয়ে এসে বুঝেছেন, নিয়মিত ওষুধ খেলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর দিবেশ ওঝা আরও জানান, কাউন্সেলিংয়ে কয়েকজন রোগী জানিয়েছেন তাঁরা পুরুষ-পুরুষ যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত। চিকিৎসকেরা সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করেই এটি নির্ধারণ করেছেন। আলাদা কোনো পরীক্ষা এটি জানার উপায় নেই।

খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মাহফুজা খাতুন বলেন, শনাক্ত যত বাড়বে, নিয়ন্ত্রণ তত সহজ হবে। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। খুমেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, কিন্তু সামাজিক কারণে অনেকেই চিকিৎসা নিতে অনীহা দেখান।

Ad 300x250

সম্পর্কিত