leadT1ad

‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণা ভারতের বহুত্ববাদের জন্য চূড়ান্ত সতর্কবার্তা

গোলাম মুনতাকা
গোলাম মুনতাকা

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৩০
স্ট্রিম গ্রাফিক

গত ২১ ডিসেম্বর কলকাতায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে সংগঠনের প্রধান মোহন ভাগবত ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিচয় নিয়ে এমন এক বক্তব্য দিয়েছেন, যা দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক আদর্শের চিত্র স্পষ্ট করে তোলে। তিনি দাবি করেন, ভারত নতুন করে হিন্দু রাষ্ট্র হবে না, বরং আগে থেকেই ‘হিন্দু রাষ্ট্র’।

‘১০০ ব্যাখ্যান মালা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে ভাগবত বলেন, ‘সূর্য পূর্ব দিক থেকেই ওঠে। এর জন্য যেমন কোনো সাংবিধানিক অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না, তেমনি ভারত যে হিন্দু রাষ্ট্র, তার জন্যও কোনো স্বীকৃতির দরকার নেই।’ তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি ভারতকে মাতৃভূমি মনে করে এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষদের গৌরবকে ধারণ করে, তিনিই এই রাষ্ট্রের অংশ। তাঁর মতে, যতদিন এমন একজনও ভারতে থাকবে, ততদিন ভারত হিন্দু রাষ্ট্রই থাকবে। এটিই আরএসএসের মূল আদর্শ।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রতি তাঁর সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করে ভাগবত বলেন, সংবিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ শব্দটি যোগ করা হলো কি না, তাতে আরএসএসের কিছু আসে যায় না। যদিও আরএসএস নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও হিসেবে দাবি করে, বাস্তবতা হলো সংগঠন এখনো অনিবন্ধিত ও অতীতে একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছে। তিনি সরাসরি বলেন, ‘সংসদ আইন পরিবর্তন করুক বা না করুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা ওই শব্দের তোয়াক্কা করি না। কারণ, আমরা হিন্দু ও আমাদের দেশ হিন্দু রাষ্ট্র। এটাই সত্য।’

ভাগবতের এই মন্তব্য ভারতের সংবিধানের প্রতি তাঁর চরম অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্পষ্ট করে বলা আছে রাষ্ট্র ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হবে, অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো একক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদেও সব নাগরিকের জন্য আইনের চোখে সমানাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ভাগবতের এই বক্তব্যকে কেন শুধু আদর্শিক বুলি হিসেবে দেখা উচিত নয়? কারণ, এ ধরনের মন্তব্য নিছক মতামত নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে থাকে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আর ইতিহাস সাক্ষী, উদ্দেশ্যের পথ ধরেই আসে পদক্ষেপ।

সংবিধানিক বহুত্ববাদের অবক্ষয়

আরএসএস নেতারা যখন ভারতের গত ৭৬ বছরের সাংবিধানিক অগ্রগতিকে অস্বীকার করে ভারতকে জন্মগতভাবেই ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করেন, তখন তা আর কেবল মত প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর মাধ্যমে তারা বহুত্ববাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক পরিসরকে সংকুচিত করে ফেলেন। তাদের এই বক্তব্য অ-হিন্দু নাগরিকদের মনে সত্যিকারের ভয়ের জন্ম দেয়। এই ভয় মোটেও অমূলক বা কাল্পনিক নয়।

সম্প্রতি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে বড়দিনের সময় এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। ১৯৯৮ ও ৯৯ সালের দিকে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ কিংবা ছত্তিশগড়ের মতো কিছু রাজ্যে এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু এখন তা পুরো দেশে সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কেবল এই বছরেই উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অনেক জায়গায় এমন হামলার খবর পাওয়া গেছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ খ্রিষ্টান হলেও তারা এখন ক্রমাগত চাপের মুখে থাকা ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।

ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে খ্রিস্টানদের ওপর হামলা বেড়েছে প্রায় আট গুণ। আরএসএস ঘনিষ্ঠ শক্তির রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে এই হামলা বাড়ার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

রাষ্ট্রীয় মদদে বৈষম্য

সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের ধরন এখন আর কেবল বিক্ষিপ্ত গণপিটুনির মধ্যে আটকে নেই। বর্তমানে তাদের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের মুখ্যমন্ত্রীরা, বিশেষ করে আসামের হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ও উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এই পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিচ্ছেন। নেতাদের এমন বক্তব্যের পরপরই পুলিশ ও পৌর কর্তৃপক্ষের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো নড়েচড়ে বসে। তারা আইনের বাছবিচারহীন প্রয়োগ শুরু করে ও সংখ্যালঘু নাগরিকদের লক্ষ্য করে উচ্ছেদ অভিযান চালায় । এসব ঘটনার বিরুদ্ধে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোনো ব্যবস্থাই নেয় না। যা প্রমাণ করে, এই বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা খোদ ওপরমহল থেকেই অনুমোদিত।

নির্বাচনী কৌশল হিসেবে মেরুকরণ

২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই ধর্মীয় মেরুকরণকে প্রচারের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, মার্চ মাসে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হওয়ার পর মোদি মোট ১৭৩টি ভাষণের ১১০টিতেই ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য রেখেছেন। বিষয়টিকে কোনোভাবেই অনিচ্ছাকৃত ভুল বলা যাবে না, বরং এটি তাঁর সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল।

এরপর গত ৩ নভেম্বর বিহারের নির্বাচনে মোদি এই ধারা আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। কাটিহারে এক জনসভায় তিনি আরজেডি ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করে বলেন, সীমাঞ্চল এলাকায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য বিরোধীরা বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র করছে। বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্যকে ঘৃণামূলক ভাষণ হিসেবে অভিহিত করেছে। ধর্মীয় জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগ তোলা এখন মোদির নিয়মিত রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়েছে।

ভারতের চরিত্র বদল ও ইতিহাস পুনর্লিখন

সরকারের উদ্দেশ্য এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তারা ভারতকে বহুত্ববাদী বা সবার রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং মৌলিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন আইন প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বদলে ফেলার চেষ্টা ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় কোনো মুসলিম মন্ত্রী না রাখা—এসবই সেই লক্ষ্যের দিকে ইঙ্গিত করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলমান। আর সব মিলিয়ে জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশই ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভাগবতরা সংখ্যালঘুদের বুঝিয়ে দেন, তাঁরা এ দেশের কেউ নন।

কূটনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট

ভারতের এই কট্টর আদর্শিক অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশটির ভাবমূর্তি দুর্বল করছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি দুইজন হিন্দু নাগরিককে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যখন অভ্যন্তরীণ ইসলামপন্থী চাপ ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে, তখন ভারতের উপদেশ দেওয়াটা বেমানান দেখায়। ভারত যদি বাংলাদেশকে সব ধর্মের মানুষের প্রতি উদার বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে বলে, তবে সবার আগে নিজেদের আচরণে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।

নিজেকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশকে উপদেশ দেওয়ার কোনো নৈতিক অধিকার ভারতের নেই। এতে বরং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ে। বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দেওয়া ও ২০১৮ সালে অমিত শাহের বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ বলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের মনোভাব আসলে কতটা নেতিবাচক। ভারতের এমন আচরণ প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবিকে উল্টো দুর্বল করে দেয়।

আরএসএসের সাংগঠনিক জাল ও প্রভাব

মোহন ভাগবতের বক্তব্যের আসল গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে আরএসএসের ক্ষমতার কাঠামো বোঝা জরুরি। আরএসএসের মূল আদর্শিক ভিত্তি থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর অসংখ্য সহযোগী সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বজরং দল বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) মতো সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে স্বীকার করে, তারা সংঘের হয়েই কাজ করে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একসময় আরএসএসের প্রচারক ছিলেন। শুধু তিনি নন, তাঁর মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালরাও এই একই পটভূমি থেকে উঠে এসেছেন। তাই আরএসএস কোনো সমান্তরাল শক্তি বা আন্দোলন নয়; বরং বর্তমান ভারতীয় শাসনব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি।

ভারতের সংবিধানে যে বহুত্ববাদের সুরক্ষা রয়েছে, তা সরাসরি সংবিধান সংশোধন করে বদলানো হচ্ছে না। বরং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, গণপিটুনির মতো সহিংসতা, আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ ও সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত অবৈধ বা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে তা ধ্বংস করা হচ্ছে। ভাগবতের বক্তব্য এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনাও দেয়।

আরএসএস প্রধানের কথাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাঁর এই বক্তব্য কেবল ‘ভারত হিন্দুদের জন্য’—এই পুরনো স্লোগানের পুনরাবৃত্তি নয়; এর ইঙ্গিত আরও ভয়াবহ। এর মূল লক্ষ্য হলো, যারা সংঘের মতাদর্শের সঙ্গে একমত নয়, তাদের জনপরিসর বা পাবলিক স্পেস থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া। বাস্তব জীবনে প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করে ভারতের অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা থেকে তাদের বিতাড়িত করাই এই বক্তব্যের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য।

~ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার অবলম্বনে

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত