leadT1ad

দ্য গার্ডিয়ান/গৃহযুদ্ধের মাঝে কেন নির্বাচন করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩: ০৮
মিয়ানমারের মান্দালয়ে সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণার বিলবোর্ড। ছবি: এএফপি।

২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তবে সাবেক নেত্রী কারাবন্দী। দেশের সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আবার দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা এখনো বিরোধপূর্ণ বা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। এসব কারণে সামরিক জান্তার ঘোষিত ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হবে—এমন দাবিতে খুব কম মানুষই আস্থা রাখছেন।

নিজেদের ক্ষমতা দখলের বৈধতা নিশ্চিত করতেই জান্তা নির্বাচনে যাচ্ছে বলে তাদের মত। সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর দেশ ছেড়ে পালানো ২৫ বছর বয়সী পাই বলেন, এই নির্বাচন জনগণের জন্য নয়। তাঁর ভাষায়, ‘এটা তারা নিজেদের জন্য করছে। তারা যে সংকটে পড়েছে, সেখান থেকে বের হওয়ার একটি পথ খুঁজছে।’ তাঁর মতে, এই ভোট মূলত জান্তার আত্মরক্ষার কৌশল।

আগামী রোববার (২৮ ডিসেম্বর ২০২৫) ভোটগ্রহণ শুরু হলে প্রায় পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হবে দেশটি। সামরিক শাসকেরা আশা করছেন, এই নির্বাচন তাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে যে তারা একঘরে হয়ে পড়েছে, সেই ভাবমূর্তি বদলানোর সুযোগও এতে তৈরি হবে।

তবে সামরিক সরকার এসব সমালোচনা নাকচ করেছে। জান্তার দাবি, এই নির্বাচন কোনো ধরনের জবরদস্তি ছাড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তারা বলছে, জনগণের সমর্থন তাদের পক্ষে রয়েছে। জান্তার মুখপাত্র জ জ মিন তুন বলেন, ‘এই নির্বাচন মিয়ানমারের জনগণের জন্য। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্তুষ্ট হলো কি না, তা আমাদের কাছে গুরুত্বহীন।’

অন্যদিকে, বহু পশ্চিমা দেশ ও জাতিসংঘ এই নির্বাচনকে প্রহসন বলে অভিহিত করেছে। তবে জান্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র চীন এই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে জান্তা চরম চাপে পড়লে চীন তাদের সহায়তা করেছে। তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনকে চীন মিয়ানমারের স্থিতিশীলতায় ফেরার একটি সম্ভাব্য পথ হিসেবে দেখছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

তবে বাস্তব চিত্র বলছে, সংঘাত কমেনি। বরং গত এক বছরে সহিংসতা আরও বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা অ্যাকলেডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর বিমান ও ড্রোন হামলা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই স্কুল ও চিকিৎসাকেন্দ্রের মতো বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে।

চলতি মাসে রাখাইন রাজ্যে একটি হাসপাতালে সামরিক হামলায় বহু মানুষ নিহত হন। ওই এলাকা মূলত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যারা সামরিক সরকারের বিরোধী শক্তি।

এ ছাড়া বাধ্যতামূলক সেনা নিয়োগকে ঘিরে অপহরণের ঘটনাও বেড়েছে। ২০২৪ সালের তুলনায় এ ধরনের ঘটনা ২৬ শতাংশ বেশি। সেনাবাহিনী রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর থেকে মানুষ তুলে নিয়ে জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করছে। কমে আসা সেনাসদস্যের সংখ্যা পূরণ করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এই পরিস্থিতিতে যেসব তরুণের পক্ষে সম্ভব, তারা সামরিক নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের মতো শহর থেকে তরুণেরা বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রধান ভয়—যে কোনো সময় জোর করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হতে পারে।

‘ভুয়া নির্বাচন’ ও দমন-পীড়ন

মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা ঘিরে প্রবল আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। এই আতঙ্ক থেকেই নতুন একটি ‘নির্বাচন সুরক্ষা আইন’ পাস করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় নির্বাচনের সমালোচনা করলে ন্যূনতম তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হতে পারে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। গত জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনের সমালোচনামূলক পোস্টে ‘লাইক’ দেওয়ার কারণেও অনেকে আটক হয়েছেন।

ইয়াঙ্গুনসহ বিভিন্ন শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ভোট দিতে নির্দেশ দিচ্ছে। অধিকারকর্মীদের মতে, সাধারণ মানুষের সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই। বাধ্য হয়েই তাদের এসব নির্দেশ মানতে হচ্ছে।

প্রবাসে থাকা গণতন্ত্রপন্থী কর্মী খিন ওমার বলেন, এই সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা সবার জানা। তাঁর মতে, যারা জান্তার এই ‘ভুয়া নির্বাচন’-এর বিরোধিতা করছে বা অসন্তোষ প্রকাশ করছে, তারা গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, দমনমূলক আইন ব্যবহার করে নির্বাচনের সমালোচকদের নিয়মিত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

রোববারের নির্বাচনে মোট ৫৭টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এর বেশির ভাগ দলই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত বা তাদের ওপর নির্ভরশীল। এসব দল প্রকৃত বিরোধী শক্তি নয়। এগুলো কেবল ভোটের মাঠে একটি ভুয়া বিকল্পের চেহারা তৈরি করছে।

জাতীয় পর্যায়ে মাত্র ছয়টি দল প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে সামরিক সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সবচেয়ে বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। বহু আসনে তারা কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে।

অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এই নির্বাচনে নেই। ২০২০ সালের নির্বাচনে এই দল বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। তবে জান্তাসমর্থিত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন করতে অস্বীকৃতি জানানোয় দলটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। একইভাবে বহু জাতিগত রাজনৈতিক দলকেও বিলুপ্ত করা হয়েছে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা আনফ্রেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৫৭ শতাংশ দলের এখন আর অস্তিত্বই নেই। অথচ এসব দল মিলে সে সময় ৭০ শতাংশের বেশি ভোট এবং প্রায় ৯০ শতাংশ আসন পেয়েছিল।

এবারের নির্বাচনে দেশের বিশাল অংশকে ভোটের বাইরে রাখা হচ্ছে। এতে অভ্যুত্থানের পর জান্তা কতটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, তার স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে ৫৬টিতে ভোট হবে না। এ ছাড়া আরও ৩ হাজার ওয়ার্ড ও গ্রামাঞ্চলে ভোট বাতিল করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ভোটের আওতার বাইরে থাকবে।

এই সব এলাকাতেই মূলত তীব্র সংঘাত চলছে। অনেক জায়গা বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকেই মিয়ানমার ভয়াবহ সংঘাতে জড়িয়ে আছে। সে সময় সামরিক বাহিনী অং সান সু চিকে কারাবন্দী করে। গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়।

পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে নিয়ে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ গঠন করে। তারা সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও আক্রমণ জোরদার করে। এতে সামরিক বাহিনী ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সামরিক বাহিনীর বিমান হামলা ও সহিংসতাকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন। এসব হামলা সত্ত্বেও জান্তা সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ হারায়। একসময় অনেকে ধারণা করতে শুরু করেন, সামরিক শাসনের পতনও সম্ভব হতে পারে।

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে চীনের সমর্থন সামরিক বাহিনীকে নতুন করে শক্তি যোগায়। জান্তার পতনে আরও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে—এই আশঙ্কায় বেইজিং উত্তর শান রাজ্যে জান্তার শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের জন্য সীমান্তপথে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে দুটি বড় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী—টিএনএলএ ও এমএনডিএএ—তাদের দখল করা কিছু এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

চাপ কিছুটা কমায় সামরিক বাহিনী তাদের কৌশলেও পরিবর্তন আনে। বাধ্যতামূলক সেনা নিয়োগ কার্যকর করা হয়। ড্রোন ব্যবহারের মাত্রা বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে কমান্ড কাঠামো ঢেলে সাজানো হয়, যাতে দ্রুত বিমান হামলা চালানো যায়।

নির্বাচনের আগে জান্তা বোমাবর্ষণ আরও জোরদার করেছে। যেসব এলাকায় ভোট আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে, সেসব জায়গায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করাই এর লক্ষ্য। ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সি বলেন, ভোটের পরেও এই সহিংসতা কমার সম্ভাবনা কম।

তাঁর মতে, নির্বাচনের পর জান্তা কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে যেতে পারে। তবে এসব চুক্তি হবে কৌশলগত। নির্দিষ্ট এলাকায় সাময়িক স্বস্তি পেয়ে অন্য এলাকায় সামরিক অভিযান জোরদার করাই হবে এর উদ্দেশ্য।

রিচার্ড হর্সি বলেন, সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের পর হারানো যতটা সম্ভব এলাকা পুনর্দখলের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর ভাষায়, ‘এটি কোনো নতুন বেসামরিক সরকারের সূচনা নয়। এখানে নমনীয় নীতিতে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত