leadT1ad

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন

নির্বাচিত সরকার ছাড়া কাটবে না ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক জট

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ৩৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এক সংকটপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লি ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের বাইরে বিক্ষোভ হয়। এরপর ঢাকা ওই মিশনগুলোতে ভিসা ও কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ নেতা শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর জের ধরে ভারতও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ভিসা আবেদন কেন্দ্রে তাদের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করেছে।

৩২ বছর বয়সী হাদি ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের’ তীব্র সমালোচক ছিলেন। হাদি ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সেই অভ্যুত্থানেই তৎকালীন আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।

গত ১২ ডিসেম্বর মাথায় গুলি লাগার পর ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হাদি। শুরুতে যা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, হামলার কয়েক দিনের মধ্যে ও বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুর পর তা আরও সুদূরপ্রসারী রূপ নেয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর ঘটনাটি নতুন মাত্রা পায়।

হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে যুবক গুলি চালিয়েছে, সে আওয়ামী লীগের কর্মী এবং পালিয়ে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। হাদির মৃত্যুর খবরে ১৮ ডিসেম্বর রাতে ক্ষুব্ধ জনতা দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক— প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা চালায়। তারা প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটেও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে। হামলাকারীদের অভিযোগ, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের সঙ্গে যুক্ত ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থক।

ঢাকায় ভারতীয় স্থাপনায় বিক্ষোভ আর ভারতে বাংলাদেশি মিশনের বাইরের বিক্ষোভকে এক করে দেখছে বাংলাদেশ। ভারত কঠোরভাবে এই তুলনার বিরোধিতা করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর ভারত কড়া নজর রাখছে। আমাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে আমরা তাদের কাছে আমাদের তীব্র উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। দিপু দাসের বর্বরোচিতভাবে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছি আমরা।’

উত্তেজনা বাড়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের ওপর এর সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো ভিসা সেবা বন্ধ হওয়া। ভারত প্রতিদিন বাংলাদেশিদের প্রায় এক হাজার ৫০০ ভিসা দিচ্ছিল। তারা চিকিৎসা ও জরুরি ভিসাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছিল। ভিসা সেবা বন্ধ হওয়ায় রোগীদের পুরো প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে যাদের নতুন ভিসা, ফলো-আপ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন, তারা বেশি সমস্যায় পড়েছেন।

তবে এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শেখ হাসিনার পতনের পর নিরাপত্তার কারণে সারা দেশে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল।

জটিল পারস্পরিক নির্ভরতা

বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কূটনীতিকরা জোর দিয়ে বলছেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের এই ফাটল বেশ গুরুতর।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভিসা বন্ধের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক, স্থায়ী নয়। কৌশলগত বিচ্ছেদের চেয়ে এটি বরং তাৎক্ষণিক বা কৌশলগত পদক্ষেপ।’

ভরদ্বাজ বলেন, ‘ভারতবিরোধী প্রচারণা কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ভারত তাদের চট্টগ্রাম ভিসা অফিস বন্ধ করেছে। অন্যদিকে ভারতে ভিসা কার্যক্রম বন্ধের যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিয়েছে, তা পুরোটাই প্রতিশোধমূলক। দেশের মানুষকে শান্ত রাখতেই তারা এমনটা করেছে।’

ভরদ্বাজের মতে, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এক জটিল পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক রয়েছে। বাণিজ্য, ট্রানজিট বা যোগাযোগ—যেকোনো ক্ষেত্রেই ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না।’

ভরদ্বাজ আরও বলেন, ‘ভিসা নিয়ে এই অচলাবস্থা সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তিতে ফেলছে ঠিকই। তবে এতে বৃহত্তর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বা বাণিজ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইনচ্যুত হবে না। দুই পক্ষই ঝুঁকির বিষয় বোঝে। এই স্থবিরতা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু সম্পর্কের মূল ভিত্তি নষ্ট করছে না।’

চিকিৎসা ভ্রমণে প্রভাব

শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই গত এক বছর ধরে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। সাম্প্রতিক এই ঘটনা সেই তিক্ততা আরও বাড়াল। বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারত ক্রমশ উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। অন্যদিকে ঢাকা একে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে ও এর বিরোধিতা করছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভারতের ভিসা বন্ধের সিদ্ধান্ত ছিল সাময়িক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আমাদের মিশন ও ভিসা কেন্দ্রগুলোর ওপর বিশ্বাসযোগ্য হুমকির কারণেই এমনটা করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম ছাড়া সব জায়গায় সেবা আবার চালু হয়েছে। কারণ চট্টগ্রামে এখনো হুমকি রয়ে গেছে।’

চক্রবর্তীও মনে করেন, বাংলাদেশের পদক্ষেপ শুধুই প্রতিশোধ। তিনি বলেন, ‘তারা ভারতে তাদের মিশনের বিপদ নিয়ে মিথ্যা তুলনা টানার চেষ্টা করছে। এটি দেশের মানুষের জন্য বানানো গল্প। এর সঙ্গে বাস্তব নিরাপত্তা উদ্বেগের কোনো মিল নেই।’

চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘হ্যাঁ, উদ্বেগ জানাতে হাইকমিশনারদের তলব করা সাধারণ কূটনৈতিক প্রথা। কিন্তু বৈধ নিরাপত্তা হুমকি আর রাজনৈতিক চালবাজির মধ্যে পার্থক্য আছে।’

জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বর্তমান সংকট কয়েক দিনের মধ্যেই কমে আসবে। তবে ঢাকায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।

দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক আখ্যান বা বয়ান হাইজ্যাক করেছে। এটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব নয়।’

দত্ত আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা অভ্যন্তরীণ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা চরম অযোগ্যতা অথবা অসৎ উদ্দেশ্যের পরিচয় দেয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে কর্তৃপক্ষের খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।’

দত্ত বলেন, ‘অচলাবস্থা স্পষ্ট। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের বৈধতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। অন্যদিকে ভারত একজন নির্ভরযোগ্য অংশীদারের অপেক্ষায় আছে। ঢাকা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আন্তরিক ইচ্ছা না দেখানো পর্যন্ত নয়াদিল্লি নড়বে না।’

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সহিংসতার জন্য উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। তারা হামলার সম্পূর্ণ বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তবে সরকারি ও কূটনৈতিক উভয় স্তরেই একে অপরকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে খারাপ করেছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, সম্পর্ক এখন স্পষ্টতই সংকটে। ভিসা সেবা বন্ধ, দূতদের তলব, কূটনৈতিক মিশনে বিক্ষোভ ও দৈনন্দিন সহযোগিতায় ফাটল—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল।

বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় দূত রিভা গাঙ্গুলি দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও ভিসা স্থগিতের ঘটনায় ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও ভারতীয় ভিসা অফিসগুলোর ওপর হুমকির বিবেচনায় অফিস বন্ধ রাখাই একমাত্র বিকল্প বলে মনে হচ্ছে।

দাস বলেন, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর। বলা যায় প্রায় অরাজকতার পর্যায়ে। ভারতের বিক্ষোভের সঙ্গে বাংলাদেশের সহিংসতার তুলনা করা ঢাকার জন্য একেবারেই কপটতা। তাছাড়া স্ববিরোধিতাগুলোও খুব স্পষ্ট।’

গাঙ্গুলি দাস আরও বলেন, ‘তরুণ নেতা হাদি হত্যার পর পুলিশ দাবি করছে খুনিরা দেশেই থাকতে পারে। অথচ সরকারের অন্য কর্মকর্তারা একই সঙ্গে অভিযোগ করছেন যে তারা ভারতে পালিয়ে গেছে।’

বর্তমান তিক্ততা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই এই সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে পরিষ্কার পথ।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ১৭ বছর নির্বাসনে থাকার পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরার মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বিষিয়ে তোলা ও মেরুকরণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু মহলের ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা রয়েছে। তবে তারেক রহমানের ফেরা স্থিতিশীলতার জন্য জোরালো চাপ সৃষ্টি করতে পারে ও নির্বাচন যথাসময়ে হতে সহায়তা করতে পারে।

~ জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে থেকে অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত