leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সূচকে এখনো ‘বি’ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ

ইমরান নাফিস
ইমরান নাফিস

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়। ছবি: গুগল স্ট্রিট ভিউ থেকে নেওয়া

মানবাধিকার সুরক্ষায় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও স্বাধীনতার বিচারে বাংলাদেশ এখনো নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অব ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনসের (জিএএনএইচআরআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। গত ৪ ডিসেম্বর এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ১০ ডিসেম্বর সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ ২০০৯ সালে একটি কমিশন গঠন করলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সেটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিশন পরিণত হয়েছে এক ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ প্রতিষ্ঠানে।

দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে বাংলাদেশ

জিএএনএইচআরআইয়ের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালেরও নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। এমনকি পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব তিমুরও রয়েছে বাংলাদেশের ওপরে।

১৯৯৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সূচক প্রণয়ন করে আসছে জিএএনএইচআরআই। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন শুরু হয় এবং তখন থেকেই কমিশনটি ‘বি’ ক্যাটাগরিতে আটকে আছে। ২০১৫ সালে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হওয়ার আবেদন করা হলেও ‘প্যারিস নীতিমালা’র শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তা খারিজ হয়ে যায়।

কমিশনের দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থা ও অবনমন সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, প্যারিস নীতিমালার শর্ত পূরণ না হওয়ায় বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। এর পেছনে কমিশনের নিজস্ব ভবন না থাকা ও আর্থিক স্বাধীনতার অভাব অন্যতম কারিগরি কারণ। তবে মূল সংকট ছিল আইনি ও কাঠামোগত।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আগের আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি তদন্ত করার কোনো এখতিয়ার কমিশনের ছিল না। কমিশন কেবল সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারত, যা মানতে সরকার বাধ্য ছিল না। কমিশনের হাতে কোনো নির্বাহী বা বিচারিক ক্ষমতাও ছিল না।’

তবে কারিগরি দিকের চেয়ে রাজনৈতিক ও কাঠামোগত কারণকে প্রধান মনে করেন মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের মানদণ্ডে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ কমিশন সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব।’

নেপাল কীভাবে ‘এ’ শ্রেণিতে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নেপালে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচন করে এবং প্রার্থীদের সংসদে বক্তব্য দিতে হয়। স্বচ্ছতার এই প্রক্রিয়াই তাদের এগিয়ে রেখেছে, যা বাংলাদেশে অনুপস্থিত।’

দেড় দশকের ভয়ের সংস্কৃতি ও গুম–খুন

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর দীর্ঘমেয়াদি তথ্য বিশ্লেষণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমকে রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চিত্র উঠে এসেছে। ২০০৯ সালে দিনবদলের সনদে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও ওই বছরেই ১৫৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় নিহত হন ১৯২ জন এবং গুম হন ৬৪ জন।

২০১৭ সাল ছিল ‘আয়নাঘর’ সংস্কৃতির বিস্তারের সময়, যখন ৮৬ জন গুমের শিকার হন। ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে সর্বোচ্চ ৪৬৬ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়। তবে ২০২১ সালে র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এই সংখ্যা কমে আসে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ৮৭৫ জন (ভিন্নমতে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি) নিহত হন। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি এবং ‘শ্যুট টু কিল’ পলিসির মতো ঘটনা ঘটে।

পটপরিবর্তন: গুম শূন্য, তবে উদ্বেগ কাটেনি

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গুমের সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং অধিকারের ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময়ে গুমের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়।

অধিকারের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর তাসকিন ফাহমিনা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সিক্রেট ডিটেনশন সেল বা আয়নাঘরগুলোর ভয়াবহতা সবাই দেখেছে। বর্তমান সরকার গুমসংক্রান্ত জাতিসংঘের কনভেনশন (আইসিপিপিইডি) অনুস্বাক্ষর এবং গুম প্রতিরোধ অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।’

তবে গুম কমলেও ২০২৫ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে। আসকের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ৩৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযানেই মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। এ ছাড়া পুলিশি হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ১২ জনের মৃত্যু এবং ৫ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

তাসকিন ফাহমিনা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নাজুক। ক্রসফায়ার বা গুম না হলেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এবং রাজনৈতিক কোন্দলে সহিংসতা বাড়ছে।’

থামেনি সীমান্ত হত্যা

সরকার বদল হলেও সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসন ও হত্যা থামেনি। আসকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৯ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছেন। অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দেড় দশকে ২৫ জনের বেশি শিশুকে সীমান্তে হত্যা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে তাসকিন ফাহমিনা বলেন, ‘বিগত সরকারের নতজানু নীতির কারণে ফেলানীসহ অসংখ্য হত্যার বিচার হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও এ নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে এবং ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।’

কমিশন কি পারবে ‘বি ক্যাটাগরি’ থেকে উত্তরণ ঘটাতে

কমিশনের ‘বি’ ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে কমিশনের ওই কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক অধ্যাদেশে কমিশনের ক্ষমতা কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্যারিস নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তদন্ত করার সুযোগ এবং আপিল বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে।

তবে নতুন অধ্যাদেশের কার্যকারিতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি বলেন, ‘অধ্যাদেশে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া ইতিবাচক, কিন্তু বাস্তবে কাজ করাতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই প্রক্রিয়া মেনে চলার মানসিকতা থাকতে হবে।’

কমিশন সদস্য নির্বাচনের মানদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘নতুন অধ্যাদেশে সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানবাধিকার বিষয়ে স্পষ্ট অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়নি। বিচারক বা সাংবাদিক হলেই তিনি মানবাধিকার বুঝবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। নিয়োগের আগেই তাঁদের এ বিষয়ে পেশাগত প্রস্তুতি থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।’

বর্তমানে কমিশন কার্যত অভিভাবকহীন। গত ৭ নভেম্বর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদত্যাগের পর এখনো নতুন কমিশন গঠিত হয়নি। মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, ‘একটি মানবাধিকার কমিশনকে এভাবে অকার্যকর অবস্থায় ফেলে রাখা নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ কমে গেছে, যা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে শুধু নতুন আইন যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তাসকিন ফাহমিনা। তিনি বলেন, ‘নতুন কমিশনাররা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশ আগামীতে ‘বি’ ক্যাটাগরি থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হতে পারবে কি না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত