leadT1ad

খালেদা জিয়া: গণতন্ত্রের সাধিকা, মহাকাব্যের বীরের মতো একা

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮: ১১
স্ট্রিম গ্রাফিক

ব্রিটিশ পণ্ডিত সামুয়েল জনসনের উক্তিটি ভুল প্রমাণ করেছেন খালেদা জিয়া। জনসন বলতেন, দেশপ্রেম হলো ইতর লোকের শেষ আশ্রয়। খালেদা জিয়ার জীবন ও প্রয়াণ এই সত্যই প্রতিষ্ঠা করে যে, তাঁর রাজনৈতিক-পারিবারিক ও রাষ্ট্রনির্মাতা জীবনের প্রধান সত্য হলো দেশপ্রেম। তাঁর জীবনের এই তিন দিকেই ওই সত্য দেখা যাবে: নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম। উপনিবেশবাদী জনসনের চোখে, কিংবা আধিপত্যবাদীদের চোখে মজলুমের দেশপ্রেম একটা অসহ্য গুণাবলী হতে পারে, কিন্তু পরাধীনতার হুমকিতে থাকা দেশের জন্য সেটাই রক্তের লোহিত কণা।

বঙ্কিমের আনন্দমঠ সাম্প্রদায়িক উপন্যাস হলেও এখানে সন্ন্যাসী ও ভক্তের কথোপকথনে ওই সত্যটা আছে। সন্ন্যাসী ভক্তকে বলছে, দেশের জন্য তুমি কী দিতে পারো। ভক্তসন্তান বলছে, আমি জীবন দিতে রাজি। সন্ন্যাসী তখন বলছে, জীবন তো অনেকেই দিতে পারে, তারচেয়েও বড় ব্যাপার আছে। সেটা হলো—ভক্তি। আপনি যদি দেশকে মন থেকে ভক্তি না করেন তাহলে আপনি দেশের জন্য কেন কষ্ট নেবেন? আপনি যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার বাসনায় জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন। নেতা হওয়ার জন্য, প্রতিপত্তি বাড়াবার জন্য বেজায় বড় বিপদ ডেকে আনতে পারেন। কিন্তু এসবকে নিঃস্বার্থ বলা যায় না। নিঃস্বার্থ অবদান সেটাই, যেখানে আপনার কষ্টভোগ, আপনার আপসহীনতা, আপনার নিজের ও সন্তানের জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্য কেবল একটাই—নিজের চেয়ে পরিবারের চেয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে বড় ভাবা। এই উচ্চনৈতিকতা দেশপ্রেমের মূল চালিকাশক্তি। এর জোরেই খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের পরে সবচেয়ে বড় দেশভক্ত। তাঁর জীবন নতুন নতুন প্রজন্মকে দেশকে ভালবাসতে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শেখাবে।

১/১১ এর লক্ষ্যই ছিল বিএনপি ও জিয়া পরিবারকে মাইনাস করা। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে হাসিনা গেলেন বিদেশে। খালেদা দেশ ছাড়লেন না বিধায় হাসিনাকেও ফিরে আসতে হলো। এভাবে তিনি হাসিনার জন্যও সুযোগ সৃষ্টি করলেন। বিএনপির পক্ষে সম্ভব ছিল সে-যাত্রায় ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের সঙ্গে মিলে হাসিনা-মাইনাসে রাজি হওয়া। কিন্ত তিনি তা করেননি।

এই খালেদাই জেল-নির্যাতন, সন্তানহারানো, মেডিকেল হত্যাকাণ্ডের হুমকি মাথায় নিয়েও বলতে পারেন, ‘আমার দেশ ছাড়া অন্য কোথাও কোনো ঠিকানা নেই। স্বজনহীন, পরিবারহীন জীবনে জনগণই আমার পরিবার।’

এমন বলার দেশপ্রেমিক সত্যসাহস হাসিনার কখনোই ছিল না। এ কারণেই দেশের মাটিতে হাসিনার কবর হওয়া কঠিন, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু খালেদা জিয়া স্বামীর কবরের পাশে শায়িত হবেন মহাগরিমা নিয়ে, জনগণের রাণীমাতার মর্যাদায়।

তিনি সবসময়ই ছিলেন মহাকাব্যের বীরের মতো একা। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে স্বামীকে হারালেন। এর আগে একাত্তরের ৯ মাসের দুঃসহ বন্দিত্ব। ১৯৮১ সালে যখন দলের হাল ধরলেন, সেই দলটি তখন তাদের প্রধান নেতার ট্র্যাজিক হত্যাকাণ্ডে বিপর্যস্ত। তাছাড়া জিয়াও কি সেইভাবে পেরেছিলেন বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতো সমজাতীয় ব্যক্তি ও আদর্শের ঢালাইয়ে গড়ে দিতে? রাষ্ট্রনির্মাণের কাজে থাকায় দল গুছানোর সেই সময় তিনি পাননি। তিনি আদতে বিভিন্ন ঘরানার জাতীয়তাবাদী, মাওবাদী ও মুসলিম পরিচয়ের ব্যক্তিদের এক সামিয়ানার তলে আনতে পেরেছিলেন।

এক সামিয়ানায় আসা মানেই অভিন্ন দলীয় চরিত্রে আসা নয়, নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ততা নয়। এই কাজটি করতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। বলা হয়, নেতার চরিত্রে দলের চরিত্র দাঁড়ায়। সেই অর্থে এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই খালেদা জিয়া বিএনপিকে একতাবদ্ধ লড়াকু ও আপসহীন দলে পরিণত করেন।

বদরুদ্দীন উমর যেমন বলেন, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ে না, লড়তে লড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়। তেমনি লড়াইয়ের ময়দানেই খালেদা জিয়া চিনে নিলেন কে দোস্ত আর কে দুশমন। এই শিক্ষা ৮৬-তে এরশাদ শাহীকে বৈধতা দেওয়ার পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার বেইমানি থেকেও পেলেন। ৮৬-র সেই রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতার মধ্যে তাঁকে বীরের মতো একাই গণতন্ত্রের সংগ্রাম চালিয়ে নিতে হয়।

আপসহীন এই নেত্রী কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে অসম্ভব নমনীয় হয়েছেন। তাঁর আমলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে জায়গা পেয়েছে। তিনিই বিরোধী দলের আপত্তির মুখে ইয়াজউদ্দীনের নেতৃত্বে নিয়মরক্ষার তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেছেন, আবার পদত্যাগ করেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুলে দেন।

সেই একই কারণে স্বাধীনতা ও সার্বভৗমত্বের প্রশ্নে তিনি এমন নির্বাচনী সমঝোতা জামায়াতের সঙ্গে করেন, যার মূলে ক্ষমতার মোহ ছিল না, ছিল আধিপত্যবাদ মোকাবিলার প্রয়োজন। কিন্তু এই ঘটনাই দুনিয়াব্যাপী চলা ওয়ার অন টেররের কালে অশুভ পরাশক্তিগুলির নিশানায় পড়ে যায়। মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলামপন্থীদের নিয়ে ক্ষমতায় থাকা সেসময়ে সম্ভব ছিল না।

আমরা দেখতে পাব, সে সময়ে দেশি-বিদেশি আয়োজন চলে চারদলীয় জোটকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়ার। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে একটানা চলে খালেদা জিয়া ও তাঁর দলকে ‘জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক বলে দেখানোর শিকারি সাংবাদিকতা। এই সাংবাদিকতা কেবল ওয়ান ইলেভেনের বিপর্যয়কেই ডেকে আনেনি, ফ্যাসিবাদের ১৮টি বছর এই সাংবাদিকতা খালেদা জিয়া, তাঁর সন্তানদ্বয় এবং বিএনিপসহ সহযাত্রী দলগুলোর বিরুদ্ধে লাগাতার চলেছে। গিলগামেশ মহাকাব্যের ভাষায় বলতে হয়, ‘তিনি জেনেছেন গোপন বিষয়, উন্মোচন করেছেন লুকায়িতকে…তিনি চলেছেন দীর্ঘ ও দূরতম সফরে, নিজেকে নিয়ে গেছেন ক্লান্তির শেষ সীমানায়, তারপর পৌঁছালেন শান্তির সমীপে। তিনি পাথরফলকে খোদাই করে গেছেন সেই দীর্ঘ ও কষ্টদীর্ণ যাত্রাপথের কথা।’

এই যাত্রাপথ কেবল ৪১ বছরের রাজনৈতিক জীবনের নয়। কী সইতে হয়নি তাঁকে? শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের এমপিরা সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় কী জঘন্য ভাষা আর ভঙ্গিমায় তাঁকে কলংকিত করেছেন! স্পিকার বলতে দিয়েছেন, আলোকিত পত্রিকাগুলো সেসব প্রকাশও করেছে।

মহাকাব্যের বীর বিজয়ের জন্যই বীর নন। দীর্ঘ পথপরিক্রমার জন্যই কারও জীবনকে মহাকাব্য বলা যায় না। বীরকে বীর করে তোলে প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বালিয়েও দুঃখের শেষ না-দেখার আবেগই কারো জীবনকে মহাকাব্যিক করে তোলে, মহীয়ান করে তোলে। মহাকাব্যের বীরেরা এজন্যই একা ও ট্র্যাজিক। খালেদা জিয়ার বিজয় যেমন অতুলনীয়, তেমনি দুঃখযন্ত্রণাতেও তিনি অতুলনীয়।

সংগ্রাম আর সংকল্পে খালেদা জিয়া তাঁর সময়ের সবাইকে ছাপিয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মাথা ভুল-সঠিকের মেঘমালার ঊর্ধ্বে উঠে আসে, কেননা তিনি বারবার লঙ্ঘন করেন অশুভ নিয়তির নির্দেশ। এই উপলব্ধি তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়। নিজেকে আরও শক্তিমান হিসেবে ঘোষণার বদলে তিনি অন্তরালে চলে যান জীবনের শেষ পর্বে—মহাকাব্যের বীরের মতোই।

কিন্তু তিনি ক্লান্ত হন না, পথ হারান না, ভেঙ্গে পড়েন না। স্বামীকে হারিয়ে, মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ কারাবাস সয়ে, সন্তানকে হারিয়ে, বাড়ি হারিয়ে, স্বাধীনতা হারিয়েও তিনি দমে যাননি। তাঁর এই আপসহীন সাহসিকতাকেই ধারণ করেছে জুলাইয়ের সন্তানেরা।

সহস্রাব্দের যুগে দুনিয়াজুড়েই ত্যাগী, সংগ্রামী, অটল ব্যক্তিত্বের কিংবদন্তির জন্ম দেওয়া নেতারা হারিয়ে যাচ্ছেন। নেতা এখানে পপুলিস্ট অথবা করপোরেট অথবা জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট ও যুদ্ধবাজ কিংবা দুর্নীতির সর্দার। এরকম সময়ে জাতির ইতিহাসের অন্তত তিনটা যুগকে এককভাবে প্রভাবিত করে যাওয়ার মতো আর কেউ আছে কি? নাই।

দম্ভ দিয়ে নয়, ঘৃণার ফুলকি ছুটিয়ে নয়, দাপট দেখিয়ে নয়, এই অর্জন তাঁর হয়েছে দেশপ্রেমের সাধনাবলে। এজন্যই তিনি অন্তিমে হয়ে ওঠেন গণতন্ত্রের সাধ্বী নারী। অন্ধকার দিগন্তে যিনি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, তিনি আর মানুষ নন তিনি বাতিঘর। প্রয়াণের পরেও তিনি সেভাবেই পথ দেখিয়ে চলবেন। বিদায় নিঃসঙ্গ বাতিঘর।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের মহাপরিচালক

Ad 300x250

সম্পর্কিত