leadT1ad

খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমে কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না: অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ও আপসহীনতা তাঁকে পরিণত করেছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় নেত্রীতে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির অভাবনীয় জয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন এবং ১/১১ পরবর্তী সময়ে তাঁর ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সাফল্য এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ৩২
খালেদা জিয়া। সংগৃহীত ছবি

ঢাকা স্ট্রিম: বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ তাঁর অপরিসীম দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, জনগণের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার এবং দেশের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ—এসবের জন্যই তিনি জনপ্রিয়। খালেদা জিয়া কোনো ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির লোক ছিলেন না। স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি রাজনীতিতে আসেন। তখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল একটা নেতৃত্বহীন অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। দলে বিভিন্ন ধরনের কোন্দল দেখা দিয়েছিল। সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে তিনি রাজনীতিতে আসেন দলের সঙ্গে যাঁরা জড়িত সবার অনুরোধের প্রেক্ষিতে। এবং অল্প দিনের মধ্যেই তিনি দলের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

ঢাকা স্ট্রিম: আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সময় তাঁর ভূমিকা কেমন ছিল?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: তিনি সেই সময় এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেন। এবং এই সময় বিএনপি খুব অসংগঠিত দল ছিল। তাছাড়া জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর কেউ কেউ দল থেকে চলে যায়। এই অবস্থায় দলের হাল ধরার একটা কঠিন দায়িত্ব ছিল। খালেদা জিয়া সেই দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। তিনি এরশাদের বিরুদ্ধে বিরামহীনভাবে, আপোষহীনভাবে লড়াই করে গেছেন। ১৯৮৬ সালে যখন এরশাদ নির্বাচন করল, তখন তিনি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। এর পাশাপাশি আমরা দেখলাম, আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, তার নেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের জনসভায় বললেন যে “এই নির্বাচন যারা করবে তারা হবে জাতীয় বেইমান।” কিন্তু ঢাকায় এসেই তিনি অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ নিয়ে নানা মহলে নানা কথা প্রচলিত আছে। এবং আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে গেলেন না। তিনি তাঁর লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখলেন। এবং এই অব্যাহতভাবেই তিনি লড়াই করে গেছেন ১৯৯০ পর্যন্ত। তাঁর এই আপোষহীন সংগ্রাম দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করে, তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তরুণ সমাজ উদ্বুদ্ধ হওয়ার ফলেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটা বড় ছাত্রসংগঠনে পরিণত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়।

ঢাকা স্ট্রিম: ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের শক্তিশালী সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিএনপির বিজয়ের নেপথ্যে কী কারণ ছিল বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সেই সময় আরও অন্যান্য সব দল অংশগ্রহণ করেছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেটা সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না, কিন্তু সব দলের সম্মতির ভিত্তিতেই সেটা একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পরিণত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে অনেকের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হবে। এবং সেই রকম একটা আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল বেগম জিয়ার দল অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এবং এর কারণ ছিল, আমি আগে যেটা বলেছি, তাঁর এই জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোষহীনতা।

তিনি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, “ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা।” এই যে ঘোষণা, এই যে বক্তব্য, এটা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যদিকে, তিনি রাজনৈতিক বক্তব্যে কখনোই অশালীন ভাষা প্রয়োগ করেন নাই। এবং সেই দিক থেকে বলা যায় যে, আমরা প্রায়শই বলি যে গণতন্ত্রের জন্য উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দরকার, সেই ধরনের উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা উনি করেছেন।
নির্বাচনের আগে ৯১ সালে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনের ভাষণে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে উক্তি করেছিলেন যে, “জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একজন অজ্ঞাত মেজর। সেই অজ্ঞাত মেজরের বাঁশির হুইসেলে দেশের স্বাধীনতা আসেনি।” জনগণ তাঁর এই বক্তব্য পছন্দ করে নাই। এটাকে অশালীন মনে করেছে। এটাও একটা কারণ যে বেশ কিছু ভোটার এতে অখুশি হয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী দলের দিকেই ঝুঁকেছে।

ঢাকা স্ট্রিম: প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা খাতে তাঁর উল্লেখযোগ্য সংস্কার বা পদক্ষেপগুলো কী ছিল?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দেশের অর্থনীতি গড়ে তোলা, দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সংস্কার আনা, একটা গতিপ্রবাহ সৃষ্টি করা—এটা তিনি করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সময়েই কর ব্যবস্থার সংস্কার করে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট প্রবর্তিত হয়। এর ফলে রাজস্ব ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়। এ ছাড়া তিনি আরেকটি জিনিস করেন সেটা হচ্ছে—শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি। এই কর্মসূচি প্রবর্তন করার ফলে গ্রাম এলাকায় গরিব মানুষের সন্তানেরা ব্যাপকভাবে স্কুলে যেতে উদ্বুদ্ধ হয়। এবং বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে স্কুলে ভর্তির সংখ্যায় বিরাট পরিবর্তন হয় এবং বিরাট উন্নতি হয়। এবং সেই সময় দেখার মতো একটা দৃশ্য ছিল যে—গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা কীভাবে সারিবদ্ধ হয়ে স্কুলে যাচ্ছে স্কুল ড্রেস পরে। তো এইটা একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এই দেশে, বিশেষ করে নারীদের মুক্তির ক্ষেত্রে।
সেসময় আরেকটা জিনিস হয়েছিল, সেটা হলো এরশাদের আমলে আমাদের দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ১৬ আনাই (শতভাগ) নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে এই পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে শতকরা ৫০ শতাংশ অর্থায়ন জাতীয় সম্পদ থেকে করা সম্ভব হয়। তো এটাও দেশের আত্মনির্ভরশীলতার পথে একটা বিরাট অগ্রগতি এবং বিরাট একটা দৃষ্টান্ত। এবং এই দৃষ্টান্ত উনি সৃষ্টি করেছিলেন।

ঢাকা স্ট্রিম: ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন এবং পরবর্তীতে বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: শেখ হাসিনা এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না। এবং সত্যিই সারা দেশে একটা ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এবং আন্দোলনটা করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। সেই আন্দোলনের মুখে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি সংবিধানের বাইরে একচুলও যাবেন না। কিন্তু বাস্তবতাকেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি একটা বিতর্কিত নির্বাচন হলেও, সেই নির্বাচন করে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
এরপরে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে তাঁর দল বিরোধী দল হিসেবে সংসদে অবতীর্ণ হয় এবং ১১৬টি আসন লাভ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ১১৬ আসন নিয়ে একটা বিরোধী দলের অবস্থান, সেটা একেবারে নজিরবিহীন। তারপরেও তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে, শেখ হাসিনার জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তিনি ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিরুদ্ধে সেই সময় আন্দোলন করেছেন। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছেন। সেইসব আন্দোলন যে যুক্তিসংগত ছিল, সেটা আমরা আজকে দেশবাসীর মন-মানসিকতা দেখলে উপলব্ধি করতে পারি।

ঢাকা স্ট্রিম: ২০০১ সালের পরবর্তী শাসনামল এবং ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় তাঁর অবস্থান কেমন ছিল?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: বেগম খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে অর্থাৎ ২০০১ সাল পরবর্তী সময়ে, সেই সময়ে তিনি আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। তিনি ইচ্ছা করলে সংবিধান পরিবর্তন করতে পারতেন, কিন্তু সেই পথে তিনি যান নাই। এবং তিনি সংসদে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতার অপব্যবহার করেন নাই। বিরোধী দলের ওপরও দমননীতি চালানো, সেই নীতিও তিনি অনুসরণ করেন নাই। ফলে আর যা-ই হোক, তাঁকে একজন স্বৈরতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে কেউ চিহ্নিত করতে পারে না।

বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দেশপ্রেমের জন্য এবং দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্যই প্রচুর কষ্টভোগ করেছেন, হেনস্থার শিকার হয়েছেন। ১/১১-এর সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। তাঁকে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্যও চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তিনি অনড় ছিলেন, দেশ ছাড়বেন না। এবং বারবার তিনি বলতেন, “বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। বাংলাদেশই আমার শেষ ঠিকানা। আমি এখানেই থেকে যাব।” এবং তিনি বাংলাদেশেই থেকে গিয়েছেন, অন্য কোথাও যান নাই, অন্য অনেকের মতো। এবং বাংলাদেশকে তিনি যে ভালোবাসতেন গভীরভাবে এটাই তার প্রমাণ।

ঢাকা স্ট্রিম: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাঁর ওপর যে নির্যাতন হয়েছে এবং বর্তমানে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: শেখ হাসিনার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ব্যাপী স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদী শাসন—সেই সময়ে তাঁকে ঠুনকো মামলায়, বলা যেতে পারে একেবারে এক ধরনের ঠুনকো অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়, মামলা দেওয়া হয় এবং তিনি আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁকে যেভাবে কারাগারে রাখা হয়, সেটা কোনো সভ্য দেশে এভাবে কেউ কাউকে কারারুদ্ধ করে না। তাঁকে পরিত্যক্ত ঢাকা পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয় একটা প্রকোষ্ঠে এবং স্যাঁতসেঁতে অবস্থায়, অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। এবং একেবারে একক একজন প্রিজনার পুরো এত বড় একটা পরিত্যক্ত কারাগারের মধ্যে। সেখানেই তিনি আজকে যে গুরুতর অসুস্থ, সেই অবস্থাটা তখনই সৃষ্টি হয়।
তারপরে তাঁকে তাঁর অসুস্থতার কারণে কারামুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়। এক পর্যায়ে হাসিনা সরকার তাঁকে বাড়িতে থেকে কারাভোগ করার সুযোগ দেয়। কিন্তু তাঁর যখন রোগ কঠিন আকার ধারণ করেছে, তখন বিদেশে চিকিৎসার যে দাবি, সেই দাবি সেই সরকার মানেনি। বলা যেতে পারে প্রচণ্ড নিষ্ঠুর আচরণ তাঁর প্রতি করা হয়েছে। যে কারণে অনেকে সন্দেহ করেন, আজকে তাঁর যে শারীরিক অবস্থা—এই বয়সে এতটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এতটা খারাপ হয়েছে, যেটা সন্দেহ করা হয়, সেটা হচ্ছে—তাঁকে খাদ্যের মধ্য দিয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। যে কারণে তাঁর লিভারের ক্ষতি হয় এবং শরীরের অন্যান্য অর্গানের ক্ষতিগুলো হয়।

ঢাকা স্ট্রিম: বাংলাদেশের রাজনীতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বেগম খালেদা জিয়ার সামগ্রিক অবদানকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: বেগম খালেদা জিয়ার অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে। হয়তো উনি অনেক কাজ আরও ভালোভাবে করতে পারতেন। কিন্তু একটা জিনিস তিনি করেন নাই। সেটা হচ্ছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে তিনি কখনোই নতি স্বীকার করেন নাই। এই প্রশ্নে তিনি অনড় ছিলেন, অবিচল ছিলেন। অবিচল ছিলেন বলেই তাঁকে এই শেষ বয়সে এসে এতটা অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে, এতটা দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হয়েছে। এবং দেশবাসী এটা উপলব্ধি করে। উপলব্ধি করে বলেই আজকে তিনি আমাদের দেশে একজন একক ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, যাঁকে মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে এবং তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। শুধু গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে না, তাঁকে মনে করে জাতির দুর্দিনে তিনি পথ দেখাবেন, সেই রকম একজন মানুষ।

ঢাকা স্ট্রিম: আপনারা একটি ভিন্ন ধারার রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তো সেই ভিন্ন ধারার রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কীভাবে এক রেখায় দাঁড়ালেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: এক তো গণতন্ত্রের জন্য আকাঙ্ক্ষা। এবং গণতন্ত্রের লড়াইটা তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে করেছেন স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে, এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে। দুই, আমার ব্যক্তিগতভাবে যে কারণ, সেটা হচ্ছে—বাংলাদেশে মওলানা ভাসানীও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নাই, যেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে, যদিও আমি বিএনপির সদস্য নই বা তাদের কোনো কমিটিতে আমি নাই, কিন্তু তাদের যে সমস্ত সেমিনার হতো, সেই সব সেমিনারগুলোতে আমি এই ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান আমি তুলে ধরতে পেরেছি। এটা ছিল আমার জন্য এমন একটা সুযোগ... যেই সুযোগটা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মূলত এই দুটো কারণ, যে কারণে আমরা তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেছি। হয়তো অন্য অনেক ব্যাপারে আমাদের দ্বিমত থাকতে পারে।

ঢাকা স্ট্রিম: রাজনীতিতে আপনারা খালেদা জিয়ার থেকে এবং বেগম জিয়া আপনাদের থেকে কী পেয়েছেন?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: খুব সহজ কথায় বলতে পারি, যেমন ধরেন ১৯৯৬ সালে যে সংকট ছিল, সেই সংকটের সময় আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছি। সেই সময় তাঁর দল প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে গিয়েছিল এই শেখ হাসিনার জামাত-জাতীয় পার্টির আন্দোলনের ফলে। এবং সেই সময় তাঁর দলের মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার সাহেব প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কার্যত দলীয় কর্মকাণ্ড প্রায় অসার হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় কী করে এগোনো যায়, পুরো পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়—সেটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হতো, আলোচনা হতো। এবং আমাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে আমি সাহসের সঙ্গে বলেছি যে—এখন দেশে যে অবস্থা, সেখানে আপনার যে সরকার, সেই সরকারের কোনো নির্দেশ দেশের কোনো প্রান্তে কার্যকর হচ্ছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে, দর্শন বলে—যে শাসকের নির্দেশ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কার্যকর হয় না, তার শাসন ক্ষমতায় না থাকাই শ্রেয়। আমি এটাও বলেছিলাম যে, আপনি সামরিক বাহিনীকে নামিয়েছেন কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরকে কার্যকর করতে পারেন নাই। এই পরিস্থিতিতে আপনার সরে দাঁড়ানোই শ্রেয়। এবং আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস করে সরে দাঁড়াবেন। সরে দাঁড়াবেন সেই ট্রেডিশনাল ওয়েতে নয়, আপনি জনগণের মধ্যে ঘোষণা দিয়েই সরে দাঁড়াবেন। এবং সরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই জনগণের মধ্যে চলে যাবেন। যে কারণে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পার্টি অফিসের সামনে বিরাট জনসমাবেশ করেছিলেন। এবং জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন দেশের কোন পরিস্থিতিতে তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে তিনি বলেছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এর ষড়যন্ত্রের ফলেই তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেই সমাবেশে বিপুল মানুষ জড়ো হয়েছিল। তার পরদিন আরও বৃহত্তর একটা সমাবেশ হয়। তো আমি তাঁকে যেটা দেখেছি, যে তাঁর অনেক সীমাবদ্ধতার কথা মানুষ বলে, কিন্তু তাঁর দেশপ্রেমের কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না। এবং এটাই তাঁর প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। তারপরে জাতীয় ঐক্য গড়ে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য, সেই ব্যাপারেও তিনি আমাদের পরামর্শ উনি নিয়েছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন।

ঢাকা স্ট্রিম: খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপনার কোনো স্মৃতি যদি বলতেন।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: সেই সব স্মৃতি তো অনেক কিছুই আছে হয়তো। তো একটা মজার কথা বলি। সেটা হচ্ছে—আমি এবং আমার ছোট ভাই ওমরা করেছিলাম। এবং সেই ওমরা সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে। তো ওমরা থেকে ফিরে আসার পর সম্ভবত একটা ইফতার পার্টি বা কিছু ছিল। তো আমাদের দুই ভাইকে উনি দেখলেন। ওমরা করার পর নিয়ম হচ্ছে মাথা মুড়িয়ে ফেলতে হয়। আমি যে চুল ছেঁটেছিলাম, পুরো চুল ছাঁটা হয় নাই, ছোট করে ফেলা হয়েছিল চুলগুলো, খুবই ছোট করে ফেলা হয়েছিল। সেটাও করা যায়, সেটাও শরিয়ত সম্মত। আর মাহফুজ উল্লাহ পুরা মাথাটাই মুণ্ডন করেছিলেন। ইফতার পার্টিতে আমাদের দুজনকে দেখে উনি বললেন—মাহফুজ উল্লাহ সাহেব তো মাথা মুণ্ডন করেছেন, আপনি তো মাথা মুণ্ডন করেন নাই, আপনি কি আসলে ওমরা করেছেন? এইভাবে উনি রসিকতা করেছিলেন আমার সঙ্গে।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

সম্পর্কিত