ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন। অনেকে টাকাও তুলতে পারছেন না। এর ফলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১৭টির মোট ঋণের ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নামে লুটপাট হয়েছে। সে সময় এসব ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য হলেও তা শ্রেণিকরণ করা হয়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খেলাপি ঋণ কম দেখানোর প্রবণতা বন্ধ হওয়ায় এখন ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে। এতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫১ দশমিক ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৯৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। একই সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৮১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক লুটপাট করেন সাবেক চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। জনতা ব্যাংক লুটপাট করে বেক্সিমকো গ্রুপ, এনন টেক্স গ্রুপ, জনকণ্ঠ গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৬ থেকে ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের হার ইউনিয়ন ব্যাংকের। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ১১৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের হার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের, যেখানে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বা ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৭০ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এক্সিম ব্যাংক ছিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে এবং বাকি চারটি ছিল চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কর্ণধার ও বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে। তারা দুজনই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, একসময় শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ চৌধুরী নাফিজ সরাফতের নিয়ন্ত্রণে থাকা পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পাঁচ হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। এক সময় ওরিয়ন গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৩১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। এই বাংকের বেশিরভাগ টাকা গেছে বেক্সিমকো, সিকদার, স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুসহ আরও কয়েকজনের কাছে।
এছাড়া আগে সিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩২ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ। সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ৫৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এর বাইরে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি ৯৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। এক বছর আগে একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।