leadT1ad

শেখ পরিবারের গল্পে ভর করে এক আমলার বই-বাণিজ্য

স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. আনু মাহমুদ। এখন পর্যন্ত লিখেছেন শতাধিক বই। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ পরিবারকে নিয়েই ত্রিশের বেশি বই আছে তাঁর। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময়ে এমপি বা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাঁর বই কিনতো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। এমন বেশ কিছু ডিও লেটার বা সরকারি নথি স্ট্রিমের হাতে এসেছে।

সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহ্মদের সই করা একটি ডিও লেটার থেকে জানা যায়, তাম্রলিপি প্রকাশনীর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বইটি দেশব্যাপী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। বইটির লেখক আনু মাহমুদ। ডিও লেটারটি পাঠানো হয়েছিল ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বরে। চিঠিটির সঙ্গে পাঠানো হয় একটি নমুনা কপি।

ওই চিঠিতে উল্লেখিত একটি বিষয় ছিল এমন– ‘বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার জীবন ও কর্মের সাক্ষ্য বহনকারী এই গ্রন্থটি দেশব্যাপী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা ও আদর্শের চেতনায় উজ্জীবিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’

২০২২ সালের ৮ জুন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পক্ষে চিঠিটি গ্রহণ করেন তৎকালীন সহকারী কমিশনার মোহা. জাহাঙ্গীর আলম বাবু। এরপর আরেক চিঠিতে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসনের আওতাধীন সব সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন বইটি সংগ্রহ করে সেই নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা মোহা. আবদুর রশিদের সই করা একটি চিঠিতেও এমন নির্দেশনা রয়েছে যে, সেই জেলার আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান যেন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বইটি সংগ্রহ করে।

সরকারি অর্থ অপচয়

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এরই একটি ধরন ছিল এভাবে বই কেনানো। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, একজন সরকারি কর্মকর্তার লেখা বইকে সরকারি নির্দেশে নানা প্রতিষ্ঠানে বারবার কেনানো হয়েছিল— যার পেছনে বাজার চাহিদা বা পাঠকের আগ্রহের বদলে আছে কেবল পদমর্যাদা ও প্রভাবের জোর।

এ প্রসঙ্গে ঐতিহ্যের প্রকাশক আরিফুর রহমান নাইম স্ট্রিমকে বলেন, ‘এটি ভালো লক্ষণ নয়। আমলা যদি মানসম্পন্ন বই লেখেন তাহলে এক কথা। কিন্তু আমাদের দেশের আমলারা তো বেশির ভাগই পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়ার জন্য বই লেখেন। সেজন্য বইগুলো মানসম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।’

শেখ হাসিনা সরকারকে নির্দেশ করে তিনি বলেন, ‘তখন গুটিকয়েক প্রকাশক ও লেখকেরাই সরকারি সুবিধাগুলো নিয়েছে। অনেক প্রকাশকের ভালো বই থাকা সত্ত্বেও কোনো সরকারি প্রকল্পে তাদের থেকে একটি বইও নেওয়া হয়নি।’

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চপদ ও প্রভাবে পরিচালিত হয়ে বই কেনাকাটায় নতুন এক অনৈতিক রীতির জন্ম দিয়েছিল বলে অভিযোগ করছেন প্রকাশক ও পাঠ্যপুস্তক সংশ্লিষ্টরা। ‘সূচিপত্র’র প্রকাশক সাঈদ বারী স্ট্রিমকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সরকারি নির্দেশে বেশিরভাগই মানহীন বই কেনা হয়েছে। বইয়ের নামের ওপরে শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার ছবি থাকলেই তা উত্তীর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। দেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মানসম্পন্ন বইয়ের বিকল্প নেই।’

আনু মাহমুদের অনেক বই-ই সরকারিভাবে কেনা হয়েছে। তাঁর বইগুলো সব মানহীন বলে মন্তব্য করেন সাঈদ বারী। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির সময়ে মারা গেছেন তিনি। আমাকেও বই দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করিনি (প্রকাশ) তখন। দেখা যেত, বিভিন্ন লেখকের লেখা এনে সংকলন করতেন, কিন্তু উপরে নাম থাকত আনু মাহমুদের। যেন তিনিই বইটির লেখক। এগুলো আসলে অসততা।’

মানহীন বই কিনে সরকারি অর্থ অপচয় করেছেন তৎকালীন ক্ষমতাবানেরা। এতে আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন গ্রন্থিকের তরুণ প্রকাশক আব্দুর রাজ্জাক রুবেল।

ন্যাশনাল পাবলিকেশন ও আনু মাহমুদের বই

ন্যাশনাল পাবলিকেশনের প্যাডে লিখিত একটি চিঠি স্ট্রিমের হাতে এসেছে। চিঠিটি লেখা হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তাকে। চিঠিটির বিষয়— ‘বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত ন্যাশনাল পাবলিকেশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থগুলো আপনার আওতাধীন সকল প্রতিষ্ঠান/অফিস প্রধানকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বঙ্গবন্ধু বুক কর্ণার-এ সংরক্ষণে পদক্ষেপ ও অবহিতকরণসহ নির্দেশনা প্রদান প্রসঙ্গে।’

চিঠির নিচে সই আছে প্রকাশক এইচ এম ইব্রাহিম খলিলের। বইগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, আমি তো প্রকাশক। আমি তো প্রচার করবই। আমি সবাইকে বলতে পারি বইটি কেনেন।

ন্যাশনাল পাবলিকেশনের প্যাডে তাঁর সই করা চিঠিটির সংযুক্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন রয়েছে। এই অনুমোদন কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো তাদের ব্যাপার। আমি তো বইটি কেনার জন্য বলতেই পারি।

চিঠিতে থাকা বই দুটি হলো— বাঙালি জাতির কলঙ্কিত অধ্যায় রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বৈশ্বিক প্রামাণ্য ঐতিহ্য।

২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নোটিশের মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু বুক কর্নার’-এ বইসমূহ ক্রয়/সংগ্রহ, বিতরণ ও সংরক্ষণ বিষয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকার ২৫ ও ২৬ নম্বরে ছিল বই দুটি।

এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালের একটি ডিও লেটারে ওই বই দুটি যাতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগ্রহ করা হয় তার নির্দেশ দেওয়া। সেখানে সই আছে তৎকালীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাসের। এ ছাড়া ১৩ এপ্রিল ২০২২ সালে সই করা এক চিঠিতে সেখানকার পরিচালক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনও একই নির্দেশ দেন।

একই নির্দেশ দেন চট্টগ্রামের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার পরিচালক অধ্যাপক হোসাইন আহমেদ আরিফ ইলাহী। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে বই দুটি কেনার জন্য নির্দেশ দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (প্র. অর্থ) এ. কে. এম. লুৎফর রহমান। একই কাজ করতে বলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে সই আছে সহকারী পরিচালক শাহীনুর ইসলামের। স্ট্রিমের হাতে রয়েছে তাঁদের সবার সই করা চিঠি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও আনু মাহমুদের বই কিনতে নির্দেশ দেয়

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি ডিও লেটার স্ট্রিমের হাতে আসার পরে সেখান থেকে জানা যায়, আনু মাহমুদের পাঁচটি বই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া সম্পাদিত দুটি বই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লাইব্রেরিসহ অধস্তন দপ্তরগুলোর (আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট) লাইব্রেরিতে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই তালিকায় থাকা আনু মাহমুদের বইগুলো হলো— ১. বাঙালী জাতির কলঙ্গিত অধ্যায় রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট ২. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বৈশ্বিক প্রামাণ্য ৩. বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ৪. গণপরিষদ ও সংসদে বঙ্গবন্ধু ও ৫. বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়: জাতির কলঙ্ক মোচন।

আনু মাহমুদের এই পাঁচটি বইই প্রকাশিত হয়েছে ন্যাশনাল পাবলিকেশন থেকে।

আর তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সম্পাদিত বইয়ের নাম— নির্বাচিত উক্তি। পাঠক সমাবেশ থেকে বইটি বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। বইটি করা হয়েছে শেখ হাসিনার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষণের সংকলন নিয়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বাদ যায়নি

আনু মাহমুদের বাঙালী জাতির কলঙ্গিত অধ্যায় রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বৈশ্বিক প্রামাণ্য, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, গণপরিষদ ও সংসদে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়: জাতির কলঙ্ক মোচন বইগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠানে সংগ্রহের জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই নির্দেশ দেওয়া হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরের ৫ তারিখে। স্ট্রিমের হাতে আসা নথি থেকে জানা যায়, পরে সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই বইগুলোর কপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়।

গ্রন্থিকের প্রকাশক আব্দুর রাজ্জাক রুবেল বলেন, ‘মানসম্পন্ন বই হলে যে কারও বই-ই সরকার কিনতে পারে। আগে দেখতাম, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বই লিখেছেন, সেটাই সরকারিভাবে কেনা হতো। সেখানে দেখা হতো না, বইটি কেমন? পড়ার যোগ্য কি না। তাই আমরা চাইব, গণ-অভ্যুত্থানের পরে যেন সরকার থেকে মানসম্পন্ন বই কেনা হয়। কারও পদ-পদবি দেখে যেন সস্তা বই আর না কেনে সরকার।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত