leadT1ad

গ্রাম-শহরে ৬১ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, পেয়েছেন আ.লীগ ঘনিষ্ঠরা

আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ ১২ বছরে ২৬ জেলায় ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়ায় সক্ষমতা ও শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫৫
গত এক যুগে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠরা ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাগিয়ে নিয়েছেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

‘ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’ ২০১২ সালে অনুমোদন পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর।

শুধু তিনি নন, সরকারে থাকার সময় প্রভাব খাটিয়ে গত এক যুগে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠরা ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাগিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫টিই রাজধানীর বাইরে, ২৬ জেলায়। এক জেলায় একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুমোদন দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, নেতা ও তাঁদের পরিবারের সদস্য এবং ব্যবসায়ীরা। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিনেও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। যেগুলো চলছে, গবেষণা তো হয় না; শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে এন্তার প্রশ্ন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দখল পাল্টা দখল দেখা গেছে। বেশির ভাগ মালিক পলাতক থাকায় কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে অবশ্য সরেজমিনে পরিদর্শন করে সার্বিক বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের দুর্বলতার সুযোগে সহজেই অনুমোদন পেয়েছে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইউজিসির পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হলেও রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আটকানো যায়নি।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম স্ট্রিমকে বলেন, ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন দেওয়া নিয়ে আমরা আপত্তি জানালেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেগুলো আমলে নেয়নি। পরিদর্শন করে আমরা প্রতিবেদন দিতাম। যেখানে অনুমোদনে নিরুৎসাহিত করা হতো।’ তিনি এ-ও বলেন, ‘প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পেয়েছে।’

অনুমোদনে রাজনৈতিক পরিচয়ই ‘শেষ কথা’

বিদ্যমান আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম শর্ত– ট্রাস্টি বোর্ড গঠন। অনুমোদনের আবেদন করতে ২১ থেকে সর্বনিম্ন ৯ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড করতে হয়। তবে ট্রাস্টি বোর্ডে কারা থাকবেন সেটি আইনে নির্দিষ্ট করা নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, এর বেশিরভাগ সদস্য একই পরিবারের। তাঁদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যও দেখা গেছে।

এমনই একটি প্রতিষ্ঠান ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া শরীয়তপুরের জেডএইচ শিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ৯ জনই সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের। এর মধ্যে জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য পারভীন হক সিকদারও রয়েছেন।

এ ছাড়া ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অনুমোদন পায় ২০১৩ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কবির হোসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান কবির হোসেন। আর তাঁর স্ত্রী মাসুদা কবির আছেন বোর্ডের সদস্য হিসেবে।

২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বরিশালের গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা আরজুমান বানু নার্গিস ওই ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। আর নানকের মেয়ে এস আমরিন রাখি ভাইস চেয়ারম্যান, ছেলে ফাহিমের স্ত্রী সারাফ আনিকা রহমান ও পিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লব সদস্য।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে সবশেষ ২০২৪ সালের ৭ জুলাই কুষ্টিয়ার জাস্টিস আবু জাফর সিদ্দিকী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব হলেন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর।

গ্রাম থেকে শহর : সবখানে বিশ্ববিদ্যালয়

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে ৩৪টি এবং জেলায় ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, জেলায় জেলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখতে পারছি কি-না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান ও দক্ষ শিক্ষক থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘বড় শহরের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবিধা হলো উচ্চশিক্ষার জন্য শহরকেন্দ্রিক প্রবণতা কমে যাওয়া। কিন্তু আমরা দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। গুণগত মান নিশ্চিত করা ছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া ঠিক নয় ‘

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

মান নিয়ে প্রশ্ন

নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও গবেষণা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আইন অনুযায়ী, অনুমোদনের আগেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী, অনুমোদন পেতে ন্যূনতম ৩টি অনুষদ ও ৬টি বিভাগের পাশাপাশি পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকতে হয়। পাশাপাশি ইউজিসি থেকে নির্ধারিত সংখ্যক পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ করতে হয়।

তবে এসব শর্ত পূরণ না করেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে বলে অভিযোগ আছে। যদিও অনুমোদনের পেলেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ইউজিসি বলছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা নেই।

২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সাময়িক অনুমোদন পাওয়া চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমতি পায়নি। সেগুলো হলো— রূপায়ন এ.কে.এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং জাস্টিস আবু জাফর সিদ্দিকী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা বন্ধ আছে।

গবেষণায় পিছিয়ে

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে অনুমোদন পাওয়া ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০২৩ সালের বাজেটে ২০টি প্রতিষ্ঠান গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। এর মধ্যে ১৫টি আওয়ামী লীগের আমলে অনুমোদন পেয়েছে।

এ ছাড়া একই বছর ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো গবেষণা প্রবন্ধ বের হয়নি; এর ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ই ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অনুমোদন পেয়েছে।

জেলা শহরে অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। স্ট্রিম গ্রাফিক
জেলা শহরে অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। স্ট্রিম গ্রাফিক

ঝুলছে আইন সংশোধনের উদ্যোগ

প্রচলিত আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতির আবেদনের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ৫ কোটি এবং অন্যান্য মহানগরের জন্য ৩ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ও ২৫ হাজার বর্গফুটের নিজস্ব বা ভাড়া নেওয়া জায়গা থাকতে হয়। আর ৯ থেকে ২১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে হয়। তবে সেখানে সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কিংবা শিক্ষানুরাগী হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

২০১৬ সালের দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে আইনের খসড়া এখনও চূড়ান্ত রূপ পায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, ‘আইনটি প্রক্রিয়াধীন আছে। মন্তব্যের জন্য সেটি ইউজিসিতে পাঠানো হয়েছে।’

সংশোধিত আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় ট্রাস্টি বোর্ডের এক-তৃতীয়াংশের শিক্ষাবিদ হওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই বিধান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের আপত্তির কারণে এই বাধ্যবাধকতা শেষ পর্যন্ত থাকছে না বলে জানা গেছে।

তবে বাধ্যবাধকতা না রাখা হলেও বোর্ড অব ট্রাস্টিজে যেন শিক্ষানুরাগী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলছেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।

তিনি স্ট্রিমকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত আইনের খসড়াটি ইউজিসিতে এসেছে। আমরা কাজটি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছি। ইউজিসির প্রশাসনিক পর্যায় থেকে সেটি অনুমোদন হয়ে আবার মন্ত্রণালয়ে যাবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত