সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব আয়োজিত ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভাটি বাংলাদেশের সমকালীন সমাজ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সোমবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে এই সভায় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্যে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো, সংবাদপত্রের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকারের যে সম্মিলিত চিত্রটি পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি কেবল একটি সহিংসতার ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার সামগ্রিক কার্যকারিতা নিয়ে যে প্রশ্ন ওঠে, এই আলোচনা তার বিশ্লেষণ।
জীবনের অধিকার ও অস্তিত্বের সংকট
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এই সভায় গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থাকে কেবল ‘কণ্ঠরোধ’ হিসেবে নয়, বরং ‘জীবননাশের হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি সেই রাতের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার প্রায় ২৫-২৬ জন সহকর্মী ছাদে আটকে পড়েছিলেন। এখন যদি হতো যে যারা ডেইলি স্টারকে ঘৃণা করে, তারা বলতো এই সাংবাদিক তোদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই, তোরা বেরিয়ে যা আমরা বিল্ডিং আগুন লাগাব... কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডকে আসতে দেওয়া হয় নাই। এটার মানে কি? এটেম্পট অব মার্ডার। মতপ্রকাশ তো অনেক দূর, এখন বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।’
এই বক্তব্যটি নির্দেশ করে যে যখন একটি সমাজে ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়, তখন আক্রমণকারীদের লক্ষ্য কেবল তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করা থাকে না, বরং ব্যক্তির অস্তিত্ব মুছে ফেলা প্রধান হয়ে ওঠে। ‘বেঁচে থাকার অধিকারের’ এই প্রশ্নটি একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইনি কাঠামোর কার্যকারিতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করে।
প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও মবতন্ত্রের উদ্ভব
মানবাধিকারকর্মী শিরিন হক এই পরিস্থিতিকে ‘শুভ বুদ্ধির নির্বাসন’ হিসেবে অভিহিত করে সরকারের ভূমিকার দিকে আঙুল তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের যে নিষ্ক্রিয়তা সেটা ভয়ঙ্কর! শুভ বুদ্ধি মনে হয় দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছে। তারপরেও আমরা কিছু শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছি আমাদেরকে লড়তে হবে।’
এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ ও ধরন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো কেন্দ্রস্থলে মবতন্ত্র শুরু হয়েছে সচিবালয় অভ্যন্তরে... রাষ্ট্রকাঠামো হচ্ছে দায়িত্বে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা মবতন্ত্রের পেছনের শক্তিকে তাদের ক্ষমতার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে। এই যে কাঠামো, এর মধ্যে কে দায়িত্বে আছে, কার সমন্বয় কি চলছে... নাকি কিছুই করছে না শুধু অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত?’
রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ‘মব’ বা অনানুষ্ঠানিক জনশক্তিকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে, তখন প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা ভেঙে পড়ে এবং জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
মব রাজত্বের ধারাবাহিকতা ও সাংস্কৃতিক আঘাত
রাশেদা কে চৌধুরি এই মব ভায়োলেন্সের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি টেনেছেন। তিনি মনে করেন, এই অরাজকতা হুট করে শুরু হয়নি, বরং সরকারের ধারাবাহিক নতিস্বীকারের ফলে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই মব শুরু হয়েছিল গত বছরের ২০-২১ আগস্ট... এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করেছিল এবং সেখানে সরকার মাথা নত করে মেনে নিয়েছিল ১৪ লক্ষ বাচ্চার ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে। ২০০ শিক্ষার্থী গিয়ে আন্দোলন করেছে। তারপরে দেখলাম এই মবের রাজত্ব হয়ে গেছে বাংলাদেশে। ছায়ানট কেন ভ্যান্ডালাইজ করা হলো? প্রশ্নটা রাখছি বর্তমান সরকারের কাছে।’
তার এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় যে সমাজ যখন নিয়মতান্ত্রিক পন্থার বদলে চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে শুরু করে, তখন সেটি ‘মব রাজত্ব’-এর পথ প্রশস্ত করে। এটি কেবল সংবাদপত্রের ওপর নয়, বরং শিক্ষা ও সংস্কৃতির সামগ্রিক কাঠামোর ওপর এক ধরণের আঘাত।
বিপ্লবের অপব্যবহার ও পরিকল্পিত চক্রান্ত
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ব্যবহার করে এই সহিংসতা চালানোকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘যাঁরা এই ঘটনাটা সেই রাতে ঘটিয়েছে বা যারা প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর হামলা করেছে তারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলোকেই ব্যবহার করেছে। শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুকেই ব্যবহার করেছে... এটা পুরো দেশের রাজনীতি নির্বাচন সেটাকে একদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই পরিকল্পনা চক্রান্ত।’
ব্যারিস্টার সারা হোসেন এই চক্রান্ত রোধে সরকারের ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতাকে তুলে ধরেন। তিনি সরকার পক্ষের নিশ্চেষ্টতা বর্ণনা করেন, ‘ফোনের পর ফোন লাগানো হয়েছে। রেসপন্স পায়নি। কিন্তু একজনও বেরলো না, একজনও আসল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই আগুন জ্বলল। উদীচীর ঘটনা কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পরে ঘটেছে প্রায়। সেটা কি কেউ জানত না যে সেটা হতে যাচ্ছে?’
সারা হোসেন স্পষ্ট করে বঝাতে চেয়েছেন যে নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগের যে সেতুবন্ধন থাকার কথা, তা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখেছে।
নৈতিক বৈধতা ও আদর্শিক মেরুকরণ
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই পরিস্থিতিকে কেবল রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়, বরং একটি আদর্শিক সংঘাত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করে বলেন, ‘বাংলাদেশে শুধু একটি রাজনৈতিক নির্বাচনী আন্দোলন হচ্ছে না। বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত আন্দোলন হচ্ছে। একটি অনির্বাচিত সরকারের শাসন করার যোগ্যতা-ক্ষমতা থাকে, ততক্ষণ যখন তার নৈতিক বৈধতা থাকে। এই ঘটনার ভিতর দিয়ে বর্তমান সরকার তার নৈতিক বৈধতা অনেক ক্ষেত্রেই হ্রাস করে ফেলেছে।’
জাতিসংঘের বিশেষ দূত আইরিন খান একে ‘ইনসাইটমেন্ট’ বা উস্কানি হিসেবে দেখছেন এবং এর পেছনের শক্তির তদন্ত দাবি করেছেন। তাদের এই বিশ্লেষণটি সমাজ-রাজনীতির সেই ধরনকে ফুটিয়ে তোলে যেখানে একটি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর ওপর আদর্শিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য সহিংসতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
নব্য-ফ্যাসিবাদের উত্থান ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
জুনায়েদ সাকি বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদের উত্থান হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুতই আরেকটা ফ্যাসিবাদী শক্তি এমার্জ করতে চাইছে। এবং যেকোনো ফ্যাসিবাদের লক্ষণ হচ্ছে যে সে আগে প্রথমত একটি গোষ্ঠী তৈরি করে, তার মূল ফেসটা সামনে আসে না। তারা জবরদস্তি তৈরি করে তাদের নিজেদের আইডোলজি কিংবা তার লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পুরো অভ্যুত্থানকে একটা ফ্যাসিস্ট আবার গ্যাঁড়াকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সংবাদপত্রের ওপর হামলা গণতন্ত্র ও জুলাই বিপ্লবের ওপর আঘাত। আজ যে বাংলাদেশ দেখছি, এই বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি কোনো দিন দেখিনি। অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’
সাকি এবং ফখরুলের বক্তব্যে একটি বড় অর্জনের পর শূন্যস্থানে উগ্রবাদী শক্তি জায়গা করে নিতে চায় এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে এই শঙ্কা উঠে এসেছে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতাহীন সমাজ
ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মাসরুর আরেফিন এই সংকটের একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না যে আসলে ছায়ানট কবে কি রাজনীতি করল। আমাদের সেক্টর তছনছ করেছে আগের রেজিম। ঠিক তেমন বর্তমান এই যে কাজগুলো হচ্ছে এটাও একইভাবেই খারাপ। এখন তো বেঁচে থাকার প্রশ্ন চলে এসছে, বাঁচতে দিবে কিনা, সেই প্রশ্ন এসছে।’
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সমাজ বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এই অরাজকতা কেবল মিডিয়া হাউজে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক আস্থার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সমাজ-রাজনৈতিক ইঙ্গিত
পুরো প্রতিবাদ সভার এই বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতির যে মূল ধরনগুলো ফুটে ওঠে তা হলো:
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও মবতন্ত্র: রাষ্ট্র তার প্রচলিত আইন ও বাহিনীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বদলে ‘মব’ বা উত্তেজিত জনতার চাপের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের পতনের একটি লক্ষণ।
আদর্শিক অসহিষ্ণুতা: ভিন্নমত ও সংস্কৃতিকে সহ্য করার ক্ষমতা সমাজ হারাচ্ছে। ট্যাগিং এবং উস্কানির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘জনশত্রু’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার এক নতুন রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
বিপ্লব পরবর্তী শূন্যতা: জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে নৈতিক ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ড তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তার বদলে এক ধরনের ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো দখল করার চেষ্টা করছে।
নূরুল কবীর, মতিউর রহমান চৌধুরী এবং এ কে আজাদের বক্তব্যে দীর্ঘ সংগ্রামের শপথ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম এখন আর কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ নেই। এ কে আজাদ বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত না ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, ছায়ানট, উদীচীসহ সকল হামলার বিচার না হবে, ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।’
বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, আদর্শিক অসহিষ্ণুতা এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী ক্ষমতার শূন্যতার এক ত্রিমুখী সংকটের মুখোমুখি। রাষ্ট্র যখন প্রচলিত আইনের বদলে ‘মব’ বা উন্মত্ত জনতাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারায়, তখন গণতন্ত্রের অপরিহার্য স্তম্ভ হিসেবে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সভায় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের দেওয়া ঐক্যের ডাক এবং আইনি প্রতিকারের দাবি কেবল সংবাদপত্র রক্ষার জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রকাঠামোতে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি যদি বজায় থাকে, তবে তা কেবল সংবাদমাধ্যম নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।