আজ মওলানা ভাসানীর জন্মদিন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে অত্যন্ত আবেগময় ও যুক্তিপূর্ণ বার্তা পাঠান। এই বার্তাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করা।
স্ট্রিম ডেস্ক

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণ ছিল অত্যন্ত জটিল। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বাংলাদেশের পক্ষে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির পুরোধা এবং চীনপন্থী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় চীনের ভূমিকা তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। পাকিস্তান ও চীনের বন্ধুত্ব তখন তুঙ্গে, চীন পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এই কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও মওলানা ভাসানী হাল ছাড়েননি। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে মাও সেতুংকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে পাকিস্তান যা করছে তা সমাজতন্ত্র বা মানবতার কোনো সংজ্ঞাতেই পড়ে না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে অত্যন্ত আবেগময় ও যুক্তিপূর্ণ বার্তা পাঠান। এই বার্তাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করা।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো বার্তায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, তাদের দেওয়া অস্ত্র দিয়েই ইয়াহিয়া খান গণহত্যা চালাচ্ছে। ভাসানী লেখেন:
‘চীনের ও আপনাদের দেয়া সামরিকসম্ভার দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নর-নারী-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন। আপনার দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যাতে তারা বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করতে পারে তার ব্যবস্থা করুন। “বাংলাদেশ” প্রজাতন্ত্র অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুন।’
তবে ভাসানীর মূল মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটি ছিল চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর সঙ্গে। তিনি মাও-কে সমাজতন্ত্রের মূল দীক্ষা—শোষিতের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মাও সেতুং-এর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে চীনের শত্রু চিয়াং কাইশেকের সঙ্গে তুলনা করেন। চিঠিটি ছিল এমন:
‘প্রেসিডেন্ট মাও সেতুঙ,
সমাজতন্ত্রের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা। একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্রের বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর যে বর্বর অত্যাচার চলিতেছে তা থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি। আপনার সরকারের সরবরাহ করা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়ার সামরিক গভর্নমেন্ট নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে বাংলাদেশের নিরপরাধ, নিরস্ত্র, অসহায়, কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের সাহায্যে সামরিক চক্র বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের উপর পশুর মতো যে বীভৎস আক্রমণ চালিয়েছে, আপনার সরকার যদি তার প্রতিবাদ না করে তবে বিশ্ববাসীর এই ধারণাই হবে যে, আপনি অত্যাচারিত জনগণের বন্ধু নন।
বাংলাদেশের নিরপরাধ জনগণের উপর সামরিকচক্র যে নির্যাতন চালিয়েছে তার তুলনা আপনার দেশে চিয়াং কাইশেকের, রাশিয়ার জারের এবং স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনকালেও পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি দুর্ভাগা বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে যে বর্বরতা ও নৃশংসতা চলছে তার প্রচণ্ডতা ও প্রকৃতির সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র বিবরণ বিভিন্ন ভারতীয় সূত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। যে কোন দেশের, এমনকি ইয়াহিয়া সরকারের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা যদি সরজমিনে সব কিছু দেখে যান, তাহলে বিশ্ববাসী বর্বরতার যথার্থ চিত্র ও যথার্থ প্রকৃতি এবং আমার অভিযোগের সত্যতা জানতে পারেন।
আপনি ভালোভাবেই জানেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের পিছনে যে প্রকাশ্য জনসমর্থন রয়েছে, কম্বোডিয়ার সিহানুক সরকারের পিছনেও ততখানি সমর্থন নেই। তাই আপনার নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, বাংলাদেশের স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে আপনি সমর্থন করুন, স্বীকৃতি দিন ও সর্বপ্রকারের সাহায্য করুন।
পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এবং পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আমাকে ৩১ বছর কারাবাস করতে হয়েছে। বর্তমানে আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ। আমার এই বয়সে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা আমার সামান্য বাসগৃহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত আমার মূল্যবান বইগুলিও তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাড়িতে আগুন লাগাবার পর আমার পরিবারবর্গের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমি জানি না।
ইতি
মওলানা ভাসানী।
এই চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি মওলানা ভাসানী প্রবাসী সরকারের ভিত শক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে তিনি কলকাতায় আসেন এবং বিভিন্ন বামপন্থী দল ও কংগ্রেসের সমন্বয়ে একটি 'সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি' গঠনে নেতৃত্ব দেন। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ, শ্রী মনোরঞ্জন ধর এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। এই কমিটি গঠনের ফলে প্রবাসী সরকার ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি সুসংহত রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে।
মাও সেতুংকে চিঠি পাঠানোর পরেও যখন চীনের নীতিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীনের অস্ত্র দিয়ে গণহত্যা চালিয়ে যেতে লাগল, তখন মওলানা ভাসানী তাঁর অবস্থান আরও কঠোর করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কূটনৈতিক অনুরোধের দিন শেষ। দেরাদুনে অবস্থানকালে তিনি পুনরায় মাও সেতুংকে তারবার্তা পাঠান এবং ১৯৭১ সালের ২৪ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ঐতিহাসিক লিখিত ভাষণ প্রদান করেন।
এই ভাষণে তিনি চীন ও আমেরিকা উভয়কেই 'জালেম' সরকারের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক বিবৃতির পূর্ণরূপ নিচে দেওয়া হলো:
মানবতার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও চীন জালেম সরকারকে স্বাধীন বাংলায় টিকাইয়া রাখার অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য প্রদান করিলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাহাদিগকে একদিন আসামী হইয়া দাঁড়াইতে হইবে। তাই আমি দুনিয়ার সকল দেশের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ ও সরকারের নিকট আবেদন করি, ইয়াহিয়া সরকারের এই ধরনের মানবতাবিরোধী অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন ও প্রতিরোধ গড়িয়া তুলুন।
আমি উল্লেখ করিতে চাই বাংলার স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাৎ করিবার ষড়যন্ত্র যতই গভীর হোক না কেন, তাহা ব্যর্থ হইবেই। মীমাংসার ধোকাবাজিতে জীবনের সকল সম্পদ হারাইয়া, নারীর ইজ্জত, ঘরবাড়ি হারাইয়া, দেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া এবং দশ লক্ষ অমূল্য প্রাণ দান করিয়া স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনসাধারণ আর কিছুই গ্রহণ করিবে না। তাহাদের একমাত্র পথ পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু। মাঝখানে অবস্থান গ্রহণের কোনো সুযোগ নাই। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে নস্যাৎ করিয়া গোঁজামিল দিবার জন্য যে কোনো দল এহিয়া খানের সহিত হাত মিলাইবে, তাহাদের অবস্থা গণবিরোধী মুসলিম লীগের চাইতেও ধিকৃত হইবে। তাহাদের রাজনৈতিক মৃত্যু কেহ রোধ করিতে পারিবে না।’
মওলানা ভাসানীর এই অনমনীয় মনোভাব প্রমাণ করে যে তিনি একাত্তরে চীনপন্থী আদর্শের অন্ধ অনুসারী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক ও বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। যখনই দেখেছেন তাঁর প্রিয় আদর্শের দেশ চীন বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, তিনি তাদের সমালোচনা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তাঁর ‘পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু’ স্লোগানটিই ছিল ১৯৭১ সালের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা।
তথ্যসূত্র:
১. মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড); সম্পাদক: হাসান হাফিজুর রহমান; শিরোনাম: মওলানা ভাসানীর বিবৃতি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণ ছিল অত্যন্ত জটিল। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বাংলাদেশের পক্ষে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির পুরোধা এবং চীনপন্থী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় চীনের ভূমিকা তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। পাকিস্তান ও চীনের বন্ধুত্ব তখন তুঙ্গে, চীন পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এই কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও মওলানা ভাসানী হাল ছাড়েননি। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে মাও সেতুংকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে পাকিস্তান যা করছে তা সমাজতন্ত্র বা মানবতার কোনো সংজ্ঞাতেই পড়ে না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে অত্যন্ত আবেগময় ও যুক্তিপূর্ণ বার্তা পাঠান। এই বার্তাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করা।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো বার্তায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, তাদের দেওয়া অস্ত্র দিয়েই ইয়াহিয়া খান গণহত্যা চালাচ্ছে। ভাসানী লেখেন:
‘চীনের ও আপনাদের দেয়া সামরিকসম্ভার দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নর-নারী-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন। আপনার দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যাতে তারা বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করতে পারে তার ব্যবস্থা করুন। “বাংলাদেশ” প্রজাতন্ত্র অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুন।’
তবে ভাসানীর মূল মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটি ছিল চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর সঙ্গে। তিনি মাও-কে সমাজতন্ত্রের মূল দীক্ষা—শোষিতের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মাও সেতুং-এর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে চীনের শত্রু চিয়াং কাইশেকের সঙ্গে তুলনা করেন। চিঠিটি ছিল এমন:
‘প্রেসিডেন্ট মাও সেতুঙ,
সমাজতন্ত্রের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা। একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্রের বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর যে বর্বর অত্যাচার চলিতেছে তা থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি। আপনার সরকারের সরবরাহ করা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়ার সামরিক গভর্নমেন্ট নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে বাংলাদেশের নিরপরাধ, নিরস্ত্র, অসহায়, কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের সাহায্যে সামরিক চক্র বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের উপর পশুর মতো যে বীভৎস আক্রমণ চালিয়েছে, আপনার সরকার যদি তার প্রতিবাদ না করে তবে বিশ্ববাসীর এই ধারণাই হবে যে, আপনি অত্যাচারিত জনগণের বন্ধু নন।
বাংলাদেশের নিরপরাধ জনগণের উপর সামরিকচক্র যে নির্যাতন চালিয়েছে তার তুলনা আপনার দেশে চিয়াং কাইশেকের, রাশিয়ার জারের এবং স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনকালেও পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি দুর্ভাগা বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে যে বর্বরতা ও নৃশংসতা চলছে তার প্রচণ্ডতা ও প্রকৃতির সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র বিবরণ বিভিন্ন ভারতীয় সূত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। যে কোন দেশের, এমনকি ইয়াহিয়া সরকারের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা যদি সরজমিনে সব কিছু দেখে যান, তাহলে বিশ্ববাসী বর্বরতার যথার্থ চিত্র ও যথার্থ প্রকৃতি এবং আমার অভিযোগের সত্যতা জানতে পারেন।
আপনি ভালোভাবেই জানেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের পিছনে যে প্রকাশ্য জনসমর্থন রয়েছে, কম্বোডিয়ার সিহানুক সরকারের পিছনেও ততখানি সমর্থন নেই। তাই আপনার নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, বাংলাদেশের স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে আপনি সমর্থন করুন, স্বীকৃতি দিন ও সর্বপ্রকারের সাহায্য করুন।
পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এবং পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আমাকে ৩১ বছর কারাবাস করতে হয়েছে। বর্তমানে আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ। আমার এই বয়সে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা আমার সামান্য বাসগৃহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত আমার মূল্যবান বইগুলিও তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাড়িতে আগুন লাগাবার পর আমার পরিবারবর্গের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমি জানি না।
ইতি
মওলানা ভাসানী।
এই চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি মওলানা ভাসানী প্রবাসী সরকারের ভিত শক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে তিনি কলকাতায় আসেন এবং বিভিন্ন বামপন্থী দল ও কংগ্রেসের সমন্বয়ে একটি 'সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি' গঠনে নেতৃত্ব দেন। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ, শ্রী মনোরঞ্জন ধর এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। এই কমিটি গঠনের ফলে প্রবাসী সরকার ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি সুসংহত রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে।
মাও সেতুংকে চিঠি পাঠানোর পরেও যখন চীনের নীতিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীনের অস্ত্র দিয়ে গণহত্যা চালিয়ে যেতে লাগল, তখন মওলানা ভাসানী তাঁর অবস্থান আরও কঠোর করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কূটনৈতিক অনুরোধের দিন শেষ। দেরাদুনে অবস্থানকালে তিনি পুনরায় মাও সেতুংকে তারবার্তা পাঠান এবং ১৯৭১ সালের ২৪ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ঐতিহাসিক লিখিত ভাষণ প্রদান করেন।
এই ভাষণে তিনি চীন ও আমেরিকা উভয়কেই 'জালেম' সরকারের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক বিবৃতির পূর্ণরূপ নিচে দেওয়া হলো:
মানবতার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও চীন জালেম সরকারকে স্বাধীন বাংলায় টিকাইয়া রাখার অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য প্রদান করিলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাহাদিগকে একদিন আসামী হইয়া দাঁড়াইতে হইবে। তাই আমি দুনিয়ার সকল দেশের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ ও সরকারের নিকট আবেদন করি, ইয়াহিয়া সরকারের এই ধরনের মানবতাবিরোধী অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন ও প্রতিরোধ গড়িয়া তুলুন।
আমি উল্লেখ করিতে চাই বাংলার স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাৎ করিবার ষড়যন্ত্র যতই গভীর হোক না কেন, তাহা ব্যর্থ হইবেই। মীমাংসার ধোকাবাজিতে জীবনের সকল সম্পদ হারাইয়া, নারীর ইজ্জত, ঘরবাড়ি হারাইয়া, দেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া এবং দশ লক্ষ অমূল্য প্রাণ দান করিয়া স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনসাধারণ আর কিছুই গ্রহণ করিবে না। তাহাদের একমাত্র পথ পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু। মাঝখানে অবস্থান গ্রহণের কোনো সুযোগ নাই। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে নস্যাৎ করিয়া গোঁজামিল দিবার জন্য যে কোনো দল এহিয়া খানের সহিত হাত মিলাইবে, তাহাদের অবস্থা গণবিরোধী মুসলিম লীগের চাইতেও ধিকৃত হইবে। তাহাদের রাজনৈতিক মৃত্যু কেহ রোধ করিতে পারিবে না।’
মওলানা ভাসানীর এই অনমনীয় মনোভাব প্রমাণ করে যে তিনি একাত্তরে চীনপন্থী আদর্শের অন্ধ অনুসারী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক ও বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। যখনই দেখেছেন তাঁর প্রিয় আদর্শের দেশ চীন বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, তিনি তাদের সমালোচনা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তাঁর ‘পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু’ স্লোগানটিই ছিল ১৯৭১ সালের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা।
তথ্যসূত্র:
১. মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড); সম্পাদক: হাসান হাফিজুর রহমান; শিরোনাম: মওলানা ভাসানীর বিবৃতি

জেনে অবাক হবেন যে রাজশাহীর জঙ্গলে শেষ বাঘটি দেখা যায় ১২৫ বছর আগে। আর কোন কোন বন্যপ্রাণী সেখানে ছিল? নদী, জলাভূমি ও পুকুরে কী কী মাছ পাওয়া যেত? কী কী পাখি দেখা যেত? ১৯১৬ সালে প্রকাশিত এল এস এস ওম্যালি-এর বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার (রাজশাহী) থেকে অনুবাদ করেছেন ভূ-পর্যটক তারেক অণু।
৬ ঘণ্টা আগে
আজ এক ‘অগ্নিপুরুষ’-এর জন্মদিন। ইতিহাসের পাতায় যার নাম লেখা আছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে, কিন্তু শোষকের কলিজা কাঁপাতে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দাবানল। তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
১০ ঘণ্টা আগে
সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক না দিলে দিনটা শুরুই হতে চায় না? খালি পেটে চা পান করা ‘স্বাস্থ্যকর’, এই ধারণা অনেকেরই আছে। কিন্তু বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা মোটেও এত সরল নয়।
১২ ঘণ্টা আগে
১৯৬৭ সালের কথা। খান আতাউর রহমান তখন অভিনেতা, পরিচালক ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত মুখ। ‘অনেক দিনের চেনা’ ও ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’র মতো সিনেমা বানিয়েছেন। সালাহউদ্দিন পরিচালিত ‘সূর্যস্নান’ (১৯৬২) সিনেমায় তৈরি করেছেন ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে’-র মতো গান।
১ দিন আগে