leadT1ad

সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘর্ষ, নিহতের সংখ্যা বাড়ছে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৮
সোমবার সকালে কম্বোডিয়ায় বিমান হামলা চালায় থাইল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সীমান্তসংঘাত আরও তীব্র হয়েছে। প্রাথমিক গোলাগুলির পর সংঘর্ষ এখন ব্যাপক কামান ও বিমান হামলা এবং স্থল অভিযানে রূপ নিয়েছে। এতে অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং বেসামরিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উভয় দেশই চলতি বছরের শুরুতে অর্জিত ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে। ফলে আঞ্চলিক সংকটের আশঙ্কা বাড়ছে।

পটভূমি

থাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তবিতর্কের ইতিহাস শত বছরের বেশি পুরোনো। ফরাসি উপনিবেশ আমলের বিভিন্ন চুক্তি থেকে এই বিরোধের সূত্রপাত। প্রাহা ভিহিয়ার মন্দির এলাকা এবং আশপাশের অনির্ধারিত সীমান্তের ৮১৭ কিলোমিটার অংশ প্রধান বিরোধের কেন্দ্র। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত মন্দিরটিকে কম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অতীতে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে; ২০১১ সালের লড়াইয়ে বহু মানুষ নিহত হয়।

বর্তমান উত্তেজনা ধাপে ধাপে বেড়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে এক কম্বোডিয়ান সৈন্য নিহত হওয়ার পর উভয় দেশ সীমান্তে সেনা বাড়ায় এবং পণ্য আমদানি-রফতানি ও ভ্রমণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এরপর জুলাইয়ে পাঁচ দিনের সংঘর্ষে রকেট ও কামান ব্যবহৃত হয়; এতে ৪৩ থেকে ৪৮ জন নিহত এবং প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় অক্টোবরে কুয়ালালামপুরে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। তবে গত মাসে থাইল্যান্ড ভূমিমাইন বিস্ফোরণে এক সৈন্যের পা ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ঘটনার পর এই চুক্তি স্থগিত করে। কম্বোডিয়া দায় অস্বীকার করে এবং এটিকে অতীতের অবিস্ফোরিত মাইন বলে দাবি করে।

চলমান সংঘর্ষের টাইমলাইন

গত রবিবার (৭ ডিসেম্বর ২০২৫) থেকে শুরু হওয়া নতুন ধাপের সহিংসতা জুলাইয়ের পর সবচেয়ে গুরুতর। সংঘর্ষ এখন বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রবিবার থাইল্যান্ডের সিসাকেত প্রদেশের ফু ফা লেক-ফ্লান হিন পায়েত কোন এলাকায় প্রায় ২০ মিনিট গোলাগুলি চলে। এতে দুই থাই সেনা আহত হয়। কম্বোডিয়া অভিযোগ করে যে ঐতিহাসিক তামোনে থম মন্দিরের কাছে থাই বাহিনী প্রথম আক্রমণ চালায়।

সোমবার (৮ ডিসেম্বর ২০২৫) উবন রাচাথানি প্রদেশে সংঘর্ষ আরও বেড়ে যায়। থাইল্যান্ড জানায়, কম্বোডিয়ান সেনারা আগে গোলাবর্ষণ করেছে। কম্বোডিয়া পাল্টা অভিযোগ করে, থাই ট্যাংক ও কামান আগে আক্রমণ শুরু করে। সকাল ৭টার দিকে এক থাই সেনা নিহত হয়।

এরপর থাইল্যান্ড এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে কম্বোডিয়ার সামরিক অবস্থানে হামলা চালায়। লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল একটি ক্যাসিনো কমপ্লেক্স, যেটিকে তারা ড্রোন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে দাবি করে। তামোনে থম ও তা ক্রাবেইসহ প্রাচীন মন্দিরের আশপাশে গোলাগুলির খবর পাওয়া যায়।

আজ মঙ্গলবার (৯ডিসেম্বর) সংঘর্ষ থাইল্যান্ডের ত্রাট প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। থাই বাহিনী কম্বোডিয়ান অনুপ্রবেশ শনাক্ত করে এবং তাদের বিতাড়নে অভিযান শুরু করে। কম্বোডিয়ার বানতিয়াই মিনচে প্রদেশে রাতভর গোলাবর্ষণে আরও দুই বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিসাকেত ও সুরিন প্রদেশে গোলাবর্ষণের খবর পাওয়া যায়, যদিও নতুন কোনো হতাহতের তথ্য নিশ্চিত হয়নি। কম্বোডিয়ান বাহিনী প্রথমে সংযম দেখালেও পরে পাল্টা রকেট হামলা চালায়, যা থাই বেসামরিক এলাকায় আঘাত হানে।

সংঘর্ষে ট্যাংক, কামান, বিএম–২১ রকেট, মর্টার এবং কথিত বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে। লড়াই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সরবরাহপথ ধ্বংস করেছে এবং পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলেছে।

হতাহতের সংখ্যা ও মানবিক প্রভাব

থাইল্যান্ড জানিয়েছে, এক সেনা নিহত হয়েছে এবং ৮ থেকে ১৮ জন আহত হয়েছে। কম্বোডিয়া নিশ্চিত করেছে যে ৪ থেকে ৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ থেকে ১০ জন আহত হয়েছে। অধিকাংশ হতাহত প্রাহা ভিহিয়ার, ওদ্দার মিনচে ও বানতিয়াই মিনচে প্রদেশে।

থাইল্যান্ডে ৩৫ হাজার থেকে ৪ লাখ ৩৮ হাজার পর্যন্ত বেসামরিক লোক সিসাকেত, উবন রাচাথানি, বুরিরাম, সুরিন ও ত্রাট প্রদেশ থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে স্কুল ও হাসপাতাল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। কম্বোডিয়ায়ও লাখো মানুষ সিয়েম রিপসহ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সাধারণ মানুষ ভয়, জীবিকা ব্যাঘাত এবং লুটপাটের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।

থাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তথাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তবিতর্কের ইতিহাস শত বছরের বেশি পুরোনো। ছবি: সংগৃহীত।
থাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তথাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তবিতর্কের ইতিহাস শত বছরের বেশি পুরোনো। ছবি: সংগৃহীত।

সরকারি বিবৃতি

থাই প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল বলেছেন, থাইল্যান্ড কখনোই সহিংসতা চায়নি, তবে সার্বভৌমত্বে আঘাত বরদাশত করবে না। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল উইনথাই সুবারি বিমান হামলাকে কম্বোডিয়ার আক্রমণের প্রতিক্রিয়া বলে উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুতিন আলোচনার সব পথ বন্ধ করেছেন এবং পূর্বের চুক্তিগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেছেন।

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত থাইল্যান্ডকে বেসামরিক গ্রামে হামলা না করার আহ্বান জানান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন থাই বাহিনীকে ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং পাল্টা আঘাত নিশ্চিত করে বলেন, প্রতিক্রিয়ার জন্য ‘লাল রেখা’ নির্ধারিত হয়েছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল মালি সোচেয়তা থাইল্যান্ডের ‘নির্লজ্জ আগ্রাসন’-এর নিন্দা জানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তথ্যমন্ত্রী নেথ ফিয়াকতড়া থাই গোলাগুলিতে বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। কম্বোডিয়া বলছে, তারা যুদ্ধবিরতি সম্মান জানাতে প্রথম দিকে পাল্টা হামলা করেনি।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই সংঘর্ষ দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে নেওয়া দীর্ঘ প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে পারে। তিনি সর্বোচ্চ সংযম ও উত্তেজনা কমাতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও নতুন করে সংঘর্ষ, বিশেষ করে বিমান হামলা ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি উভয় দেশকে সংযমের আহ্বান জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি অক্টোবরের শান্তিচুক্তিতে সাক্ষী ছিলেন, এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেননি।

ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতায় সরাসরি যুক্ত থাকায় ঘটনাটি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের আগের দাবিকে ব্যঙ্গ করে মন্তব্যও করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমগুলো ট্রাম্প-নেতৃত্বাধীন শান্তি প্রক্রিয়ার দুর্বলতা তুলে ধরে নতুন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার আহ্বান জানাচ্ছে।

সম্ভাব্য পরিণতি

সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়লে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। বাণিজ্য, পর্যটন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান গেমসের মতো আয়োজনও ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে। উভয় দেশ ভারী অস্ত্র মোতায়েন করেছে এবং কূটনৈতিক পথ বন্ধ করেছে, ফলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। এতে আসিয়ান বা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা প্রয়োজন হতে পারে।

মানবিক সংকটও ক্রমেই গভীর হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত মানুষ খাদ্যসংকট, সরবরাহ ঘাটতি এবং মানসিক আঘাতের মুখে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দ্রুত উত্তেজনা কমাতে না পারলে পরিস্থিতি আবারও জুলাই মাসের ধ্বংসাত্মক সহিংসতার মতো হয়ে উঠতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক আইন মেনে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ আলোচনায় ফিরতে হবে।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, চ্যানেল নিউ এশিয়া, ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে

Ad 300x250

সম্পর্কিত