leadT1ad

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন মোড়ে নানা সমীকরণ

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
দিল্লি

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ১৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার জটিল হয়ে উঠেছে। ভিসা সেবা স্থগিত, পাল্টাপাল্টি রাষ্ট্রদূতকে তলবসহ দুদেশের একাধিক পদক্ষেপে পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। এই নিয়ে বিশ্লেষকরাও উদ্বিগ্ন। তারা দুদেশকেই বিষয়টিকে ধৈর্য ধরে কূটনৈতিক পথে সমাধানে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

এবারের শুরুটা হয়েছিল ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার পর ঘাতকরা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন– এমন ধারণা থেকে। এতে ক্ষুব্ধ হয় বাংলাদেশিরা। বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচিকে ঘিরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ভারত। যদিও একদিন পর আজ মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) ঢাকা কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ওসমান হাদির মৃত্যুর দিন (১৮ ডিসেম্বর) ময়মনসিংহে হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর ভারতেও বাংলাদেশবিরোধী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সদস্যরা হাইকমিশন-ভিসা সেবা দেওয়া কেন্দ্রগুলোর সামনে বিক্ষোভ এবং মারমুখী অবস্থান দেখায়। পরে বাংলাদেশ দিল্লি, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও গুয়াহাটির হাইকমিশন এবং কনস্যুলার কার্যালয়ে ভিসা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।

এর আগে, গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক টানাপোড়েন চলছে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এর সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় সম্পর্কে ফাটল বাড়ে।

সর্বশেষ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে প্রণব ভার্মাকে তলব করে। অপরদিকে ভারত নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায়। ভারত তাদের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা ও উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ

বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শ্যাম কুমার বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখনো সরাসরি ভেঙে পড়ার পর্যায়ে না পৌঁছালেও, এটি গভীর অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এই সম্পর্কে স্পষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছে।’

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থনের কারণে দেশটিকে অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপকারী শক্তি হিসেবে দেখা হয়েছে। বিশেষত সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রশ্নে। অনেকের মতে, ভারতের অব্যাহত সমর্থনই অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হয়েছে।’

অন্যদিকে, বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ‘গেল বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খুব যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল, সেটা বলার কোনো অবকাশ নেই। বর্তমান সময়ে এসেও খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেনি।’

তিনি বলেন, ‘তবে বাংলাদেশের... মানে হাইকমিশনারকে হুমকি দেওয়া এবং সেটাকে মিডিয়া গুজব বলে চালানোটাও যেমন বুদ্ধিমানের মতো কোনো কাজ না ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য। ঠিক তেমনই বাংলাদেশে যে ভারতীয় হাইকমিশন আছে, সেটার ওপর যে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাও খুব গ্রহণযোগ্য কোনো বিষয় না। তবে নিশ্চিতভাবে অতীতে বাংলাদেশের কনস্যুলেটে আঘাত এসছে, মানে আগরতলা, গুয়াহাটি– এসব অঞ্চল এবং এই ধরনের আঘাতের পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখতে পেলাম।’

‘সেই জায়গাতে আমার মনে হয় যে দুদেশেরই এখন উচিত হবে এই বিষয়গুলো কূটনৈতিকভাবে সমাধান করা এবং ভারতের নিশ্চিতভাবেই তার পররাষ্ট্রনীতিতে, তার যে নিরাপত্তাবিষয়ক অবস্থান বাংলাদেশের কনস্যুলেট সম্পর্কে, সেটা আরও সুস্পষ্ট করা।’ যোগ করেন এই কূটনৈতিক বিশ্লেষক।

শ্যাম কুমার অবশ্য সামনের নির্বাচন পর্যন্ত ভারতের সময় নেওয়ার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ হলো ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী গণম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকার গঠিত হবে এবং ভারতের সঙ্গে কার্যকরভাবে সম্পর্ক পরিচালনা করতে পারবে। ভারতের জন্য যুক্তিসংগত অবস্থান হবে পরিস্থিতিকে কিছুটা স্থিত হতে দেওয়া। কারণ এখন তরুণদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশ– উভয় দেশকেই এমন পক্ষগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, যারা এই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে চায়।’

শ্যাম কুমারের মতে, ‘নয়াদিল্লিতে সংঘটিত এসব বিক্ষোভ কেবল বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বরং এর প্রভাব ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও পড়তে পারে। সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি দুদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।’

গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দপ্রস্থ ইউনিভার্সিটির কমিউনকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজের শিক্ষক ড. প্রিয়াংকা সাচদেভা বলেন, ‌'সম্পর্ক উন্নয়ন বা অবনমনের ক্ষেত্রে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দু'দেশের মিডিয়ার এক্ষেত্রে ভূমিকা আছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচুর মিসইনফরমেশন ছড়াচ্ছে। যেগুলা ক্ষোভ ছড়াচ্ছে। সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাইলে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।'

তিনি আরও বলেন, ‌'দু'দেশেই সংখ্যালঘু নির্যাতন সচেতন বা অবচেতনভাবে ঘটে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি এর রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এক্ষেত্রে দু'দেশকেই শান্ত আচরণ করতে হবে। যারা দায়িত্বশীল তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। নইলে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে কষ্ট হবে।'

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. সরোজ গিরি বলেন, ‌'প্রত্যেক বড় রাষ্ট্রকেই অনেক উদার হতে হয়। বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাইলে ভারতকে উদার হতে হবে। আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক মিল অনেক। এই সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এটাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ও ভাঙার যে কলোনিয়াল চিন্তা সেটা ঠেকাতে হবে দুপক্ষকেই। বাংলাদেশ ভারত এখানে ভাই ভাই সম্পর্ক। শত্রুতা তৈরির প্রশ্নই ওঠে না।'

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত