বনের কোলাহল নেই, নেই কোনো সঙ্গী। ইট-পাথরের রাজধানীতে জাতীয় চিড়িয়াখানার খাঁচায় একাকী দিন পার করছে আফ্রিকান গন্ডার, ক্যাঙ্গারু, কেশোয়ারি, উল্লুকসহ অন্তত ১৬ প্রজাতির প্রাণী। আইনের স্পষ্ট বাধ্যবাধকতা থাকলেও বছরের পর বছর ধরে এসব প্রাণীকে সঙ্গীহীন অবস্থায় রাখা হয়েছে। এতে প্রাণীরা হয়ে পড়ছে বিষণ্ন, দেখা দিচ্ছে আচরণগত অস্বাভাবিকতা।
চিড়িয়াখানার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ২২ আগস্ট থেকে একটি কেশোয়ারি পাখি খাঁচায় একাকী জীবন কাটাচ্ছে। দীর্ঘ ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে সঙ্গীহীন এই পাখি। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, আবদ্ধ অবস্থায় এই পাখির গড় আয়ু ২০ বছরের মতো। সেই হিসাবে, পুরুষ কেশোয়ারিটির জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটছে একাকী।
একই চিত্র আফ্রিকান গন্ডারের খাঁচায়। ২০১৩ সাল থেকে একটি স্ত্রী গন্ডার সেখানে সঙ্গীহীন। গত এক যুগেও তার জন্য কোনো পুরুষ সঙ্গীর ব্যবস্থা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তবে সম্প্রতি গন্ডারের জন্য খাঁচা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষের আশা, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রাণীটির সঙ্গী আনা সম্ভব হবে।
গন্ডার ও কেশোয়ারি ছাড়া আরও ১৪ প্রজাতির প্রাণী জাতীয় চিড়িয়াখানায় নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছে। এই তালিকায় রয়েছে একটি করে স্ত্রী কমন ইল্যান্ড, স্ত্রী ক্যাঙ্গারু, পুরুষ ইন্ডিয়ান সারসক্রেন, স্ত্রী হামাদ্রিয়াস বেবুন, পুরুষ উল্লুক, কুলু বানর (পুরুষ), আফ্রিকান সাদা সিংহ, আফ্রিকান সিংহী (মুক্তা), চিত্রা হায়েনা (স্ত্রী) এবং আফ্রিকান সিংহ (ডেইজি)।
একই প্রজাতির একাধিক প্রাণী থাকলেও বিপরীত লিঙ্গের অভাবে সঙ্গীহীন জীবনযাপন করছে তিনটি হনুমান লেঙ্গুর (সবগুলো পুরুষ), চারটি লোনা পানির কুমির (পুরুষ) এবং দুটি মিঠা পানির কুমির (পুরুষ)।
‘বাংলাদেশ চিড়িয়াখানা আইন ২০২৩’-এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কেবল একই প্রজাতির একই লিঙ্গের প্রাণী রাখা যাবে না। অথচ জাতীয় চিড়িয়াখানায় বছরের পর বছর ধরে এই আইন উপেক্ষিত হচ্ছে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মতোই প্রাণীরাও সঙ্গী চায়। কেউ দলবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে, কেউ বা নির্দিষ্ট জোড়ায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান স্ট্রিমকে বলেন, ‘প্রাণীরা প্রাকৃতিক পরিবেশে যেভাবে জীবনযাপন করে, তাদের সেভাবে রাখতে পারাটাই আদর্শ। একা থাকলে প্রাণীরা ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগে, খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয় এবং আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। চিড়িয়াখানায় সব সময় প্রাকৃতিক পরিবেশ দেওয়া সম্ভব না হলেও অন্তত সঙ্গীহীন রাখা উচিত নয়।’
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, সংকট সমাধানে তারা উদ্যোগী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি সরকারি কমিটি প্রায় ২০০টি নতুন প্রাণী কেনার সুপারিশ করেছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে এই ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘সঙ্গীহীন প্রাণীদের জন্য নতুন সঙ্গী কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং প্রক্রিয়াটি চলমান। কিছু খাঁচাও প্রস্তুত করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে দ্রুতই এসব প্রাণীর একাকীত্ব ঘুচবে বলে আশা করছি।’