leadT1ad

অনলাইনে হরেদরে নকল বই, কাটতিও চড়া

স্ট্রিম গ্রাফিক

‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’, বইয়ের লেখক ঝানু আমলা আকবর আলি খান। প্রথমা প্রকাশনীতে এটির দাম ৮৫০ টাকা। একটু ‘বুদ্ধি’ করে অনলাইনে ঢু মারলে তা মিলছে অর্ধেক দামে। তা কাগজ কিংবা মান যাই হোক!

হ্যাঁ, ফেসবুকে পেজ খুলে নকল বইয়ের পসরা সাজিয়েছে একটি চক্র। বিক্রি হচ্ছে হরেদরে। তাতে চক্রের সদস্যরা ফুলেফেঁপে উঠলেও ঠকছেন লেখক ও প্রকাশকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকাশনা জগতের আতঙ্ক ‘বই পাইরেসি’ বা বই নকল করা। বাজারে কোনো বই জনপ্রিয় হলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা কাজটি বেশি করেন। তারা মূল বইয়ের কপি বা নকল সংস্করণ তৈরি করে সামাজিকমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করেন। সাধারণ পাঠকরা আসল-নকল বুঝতে না পেরে কম দাম পেয়ে দেদারসে কিনছেন। প্রকাশকরা যেখানে লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বই প্রকাশ করেন, সেখানে চক্রটি কোনো রয়্যালটি না দিয়ে খরচ ছাড়াই চুরির মাধ্যমে ‘ব্যবসা’ করছে। এ নিয়ে আইনি সহায়তা চাইলেও মেলে না।

যেকোনো বই, দাম অর্ধেক

‘প্রজ্ঞা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে এভাবে প্রতারণা করে নামিদামি লেখকের বই বিক্রি করা হচ্ছে। এই পেজের বিরুদ্ধে থানায় জিডি হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।

‘প্রজ্ঞা’ নামের পেজ পর্যবেক্ষণ করে পাইরেসির ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। তারা প্রতিটি বই গায়ের মূল্যের চেয়ে অর্ধেক বা তারও কম দামে দিচ্ছে। প্রথমা প্রকাশনীর বইয়ের মান ও কাগজের কারণে দাম কিছুটা বেশি হলেও পাঠকদের কাছে চাহিদা ব্যাপক। এই সুযোগটিই নিচ্ছে প্রজ্ঞা।

প্রথমা থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইটির গায়ের মূল্য ৮৮০ টাকা। প্রজ্ঞাতে গেলে মিলছে মাত্র ৪৪০ টাকায়। একই লেখকের ‘লালসন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’ বইটির দাম ৮০০, প্রজ্ঞা দিচ্ছে ৪০০ টাকায়।

অর্ধেক দামে বিক্রির বিজ্ঞাপন। ছবি: ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট
অর্ধেক দামে বিক্রির বিজ্ঞাপন। ছবি: ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট

এ নিয়ে প্রথমা প্রকাশনীর এক কর্মকর্তা বলেন, তারা যে দামে বই বিক্রি করছে মান বজায় রেখে তা করা অসম্ভব।

শুধু একক বই নয়, বহু খণ্ডের বা ভলিউমের বইও নকল করছে এই চক্র। ‘বাতিঘর’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তিন খণ্ড) এবং ‘বাঙলাদেশের অভ্যুদয়’ (দুই খণ্ড)—এই সেটগুলোর দাম ৫ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু প্রজ্ঞা তা বিক্রি করছে মাত্র ২ হাজার ৬০০ টাকায়।

দেদারসে বিক্রি হচ্ছে জনপ্রিয় বইয়ের সিরিজ। ছবি: ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট
দেদারসে বিক্রি হচ্ছে জনপ্রিয় বইয়ের সিরিজ। ছবি: ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বইও নকল হচ্ছে। ‘বাদশাহ নামদার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘শুভ্র’ ও ‘কবি’—এই পাঁচটি বইয়ের একটি প্যাকেজ প্রজ্ঞা বিক্রি করছে মাত্র ১ হাজার টাকায়। অথচ বাজারে আসল বইগুলোর মোট দাম ২ হাজার ৪৫০ টাকা। সেই হিসাবে প্রায় ৬০ শতাংশ কমে পাওয়া যাচ্ছে।

এ নিয়ে এক পাঠক বলেন, হুমায়ূন আহমেদের পুরোনো বইও এত কম দামে কোথাও পাওয়া যায় না।

বিষয়টি নিয়ে প্রথমা ডটকমের ইনচার্জ রাসেল রায়হান বলেন, ‘আমরা বিশেষ ক্যাম্পেইন ছাড়া নিজেদের বই সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি করতে পারি। অন্য প্রকাশনীর বইয়ে ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়াও কঠিন। অথচ প্রজ্ঞা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড়ে বই বিক্রি করছে। এটা প্রকাশনীর পক্ষে অসম্ভব। এগুলো নির্ঘাত পাইরেটেড বা চোরাই বই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাজে ছাপা, নিম্নমানের কাগজ ও দুর্বল বাঁধাইয়ের এই বই কিনে পাঠকেরা মূলত প্রতারিত হচ্ছেন। একটি বই কেবল কনটেন্ট নয়, এর নির্মাণশৈলীও গুরুত্বপূর্ণ। প্রজ্ঞা বা ভুঁইফোঁড় পেজগুলো পাঠককে ঠকানোর পাশাপাশি প্রকাশক ও লেখকদের বড় ক্ষতি করছে। কারণ, এই চোরাই বই থেকে লেখক কোনো রয়্যালটি পান না। পুরো টাকাই এই অসাধু চক্র পকেটে ভরছে।’

এই চক্র কোনো প্রকাশনী থেকে বই নেয় না জানিয়ে রাসেল রায়হান বলেন, তারা একটা বই কিনে সেটা ফটোকপি বা স্ক্যান করে। এরপর নিম্নমানের কাগজে ছেপে বাজারে ছাড়ে।

থানায় জিডি করেও মেলেনি প্রতিকার

প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে গত বছরের ৯ জুলাই নিউমার্কেট থানায় জিডি করেছিলেন বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপংকর দাশ। তবে দেড় বছরেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ নিয়ে দীপংকর দাশ স্ট্রিমকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে বইয়ের বাজারের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। এর মধ্যে আমাদের কষ্টের বইগুলো প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে। কপিরাইট অফিস বা প্রকাশক সমিতি কী কাজ করছে, তা আমার বোধগম্য নয়।’

জিডির তদন্তের অগ্রগতি জানতে নিউমার্কেট থানার এসআই সজিব মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে স্ট্রিম। তিনি বলেন, ‘জিডি করার সময় অভিযোগকারী আমাদের ওই ফেসবুক পেজটির লিংক দেননি। তাই আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। লিংক পেলে অবশ্যই অ্যাকশন নেওয়া হবে।’

দেড় বছরেও কেন পেজের লিংক নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।

‘ওষুধে ভেজাল দেওয়ার মতোই অপরাধ বই পাইরেসি’

বই নকল করা নিয়ে লেখক ও প্রকাশকরা বিভিন্ন সময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এরমধ্যে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ফেসবুকে একাধিকবার সরব হয়েছেন। ২০২৪ সালের ১ নভেম্বর তিনি এক পোস্টে লেখেন, ‘আমার বই যারা ৫০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি করে, তারা মূলত চোরাই বই বিক্রি করে। এরা লেখক ও প্রকাশক উভয়কেই ঠকায়। এদের বর্জন করুন।’

বই নকল হওয়ার নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ক্ষোভ। ছবি: ফেসবুক থেকে
বই নকল হওয়ার নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ক্ষোভ। ছবি: ফেসবুক থেকে

ওই সময় তিনি ‘পুস্তকপাঠ-Pustakpath’ ও ‘পাঠলোক-pathlok’ নামে দুটি পেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। ওই দুই পেজের মধ্যে ‘পুস্তকপাঠ’ পাওয়া না গেলেও ‘পাঠলোক’ এখনো সক্রিয়।

এ বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘ওষুধ বা খাবারে ভেজাল দেওয়া যেমন অপরাধ, বই পাইরেসি করাও তেমনই গুরুতর অপরাধ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আসলে কী করছে? সরকারের উচিত এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যথায় লেখক ও প্রকাশকরা ধ্বংস হয়ে যাবেন।’

প্রজ্ঞার মালিক আপনের বিরুদ্ধে প্রতারণার একাধিক অভিযোগ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রজ্ঞা পেজটি চালান আপন নামের একজন। প্রতারণার অভিযোগে গত বছরের ৫ আগস্টের আগে পুলিশ তাঁকে একাধিকবার আটক করে। তবে রহস্যজনকভাবে প্রতিবারই তিনি ছাড়া পেয়েছেন।

আপনের বাবা সুলতান হোসেন রাজধানীর নীলক্ষেতে অন্তত ৩০ বছর ধরে বইয়ের ব্যবসা করছেন। নীলক্ষেতেরই এক বই বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আপন এর আগে মানুষের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে বই দেয়নি। পাওনাদারেরা তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাবা সুলতানকে ধরেছিল। পরে নীলক্ষেত বই বিক্রেতা সমিতির মধ্যস্থতায় জরিমানা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা হয়।’

আরেক বিক্রেতা জানান, ‘প্রজ্ঞা থেকে অর্ডার করলে অনেকেই বই পান না। টাকাও ফেরত পান না। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ আছে। পুলিশ তাঁকে ধরেছিল, কিন্তু সে বারবার পার পেয়ে যায়।’

তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে আপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও ধরেননি। পরে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠানে যান স্ট্রিম প্রতিবেদক। আপনের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন করলে সুলতান হোসেন বলেন, ‘আপনকে নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। ওর জীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই আমার থেকে আলাদা।’

কপিরাইট কী, শাস্তি কী

মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মালিকানা বা স্বত্বাধিকারী নিশ্চিত করাই হচ্ছে কপিরাইট। সাহিত্য বা যেকোনো লেখা, শিল্পকর্ম, সংগীত, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, লেকচার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, নকশা অর্থাৎ, যা কিছু মৌলিকভাবে তৈরি করা হবে, সবকিছুই কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সাহিত্যকর্মের জন্য কবি বা লেখকের মৃত্যুর পর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকে। কপিরাইট থাকলে বিনা অনুমতিতে সেগুলো ব্যবহার, পুনর্মুদ্রণ, অনুবাদ বা প্রকাশ করলে এই আইনের আওতায় শাস্তি ও জরিমানা হতে পারে।

বাংলাদেশে প্রথম কপিরাইট আইন হয় ১৯৭৪ সালে। পরে ২০০০ সালে নতুন একটি কপিরাইট আইন করা হয়। ২০০৫ সালে যা সংশোধন হয়। এই আইন লঙ্ঘন করলে চলচ্চিত্র বাদে চারটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চার বছরের জেল ও দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ পাঁচ বছরের জেল।

Ad 300x250

সম্পর্কিত