leadT1ad

পৃথিবীতে মানবাধিকার বলে কি আদতে কিছু আছে

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা নিসন্দেহে সুন্দর দলিল, একটি রোমান্টিক স্বপ্ন। স্ট্রিম গ্রাফিক

গাজার ধুলোমাখা ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে শিশুর নিথর দেহ। তার পাশেই অসহায় দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় জাতিসংঘের ত্রাণের গাড়ি। তখন ‘মানবাধিকার’ শব্দটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রহসন বলে মনে হয়। গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় যা ঘটছে, তাকে কোনো সাধারণ যুদ্ধ বলা চলে না, বরং বলা উচিত ‘গণহত্যা’। হাসপাতাল, স্কুল, রিফিউজি ক্যাম্প, কোথাও জীবনের নিরাপত্তা নেই।

অথচ ১৯৪৮ সালে বিশ্বনেতাদের স্বাক্ষরিত ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’র (ইউডিএইচআর) প্রতিজ্ঞা ছিল—‘নেভার এগেইন’ বা আর কখনো নয়। কিন্তু গাজার আকাশ যখন ফসফরাস বোমায় জ্বলে ওঠে, তখন সেই প্রতিজ্ঞা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা এবং হাজার হাজার নারী ও শিশুর মৃত্যু কেবল একটি ভূখণ্ডের ট্র্যাজেডি নয়। এই গণহত্যা আসলে আধুনিক সভ্যতার পরাজয়। বিশ্ববিবেকের এই পরাজয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিংবা জাতিসংঘের মতো বড় বড় সংস্থাগুলো আসলে কতটা নখদন্তহীন। তারা বিবৃতি দিতে পারে। নিন্দা জানাতে পারে। ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু একটি বুলেট বা বোমা থামানোর ক্ষমতা তাদের নেই।

গাজার এই ধ্বংসলীলা জগতের সামনে রূঢ় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে মানবাধিকার বলে কি আদতে কিছু আছে? নাকি এটি কেবল শক্তিশালী দেশগুলোর সুবিধামতো ব্যবহারের জন্য তৈরি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার?

মানবাধিকার আসলে কী?

কেতাবি ভাষায়, মানবাধিকার হলো মানুষের জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য কিছু অধিকার, যা কোনো রাষ্ট্র বা শাসক কেড়ে নিতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জাতীয়তা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার, মতপ্রকাশের, খাদ্যের ও নিরাপত্তার অধিকারই হলো মানবাধিকার।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা নিসন্দেহে সুন্দর দলিল, একটি রোমান্টিক স্বপ্ন। সেমিনারে, সিম্পোজিয়ামে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে এটি শুনতে খুব ভালো শোনায়। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর রুক্ষ মাটিতে, যেখানে ক্ষমতার জোরই শেষ কথা, সেখানে মানবাধিকার অকার্যকর ধারণা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশেষ করে হলোকাস্টের পর বিশ্বনেতারা অনুধাবন করেছিলেন, রাষ্ট্র বা শাসকের ইচ্ছার ওপর মানুষের জীবন ছেড়ে দেওয়া যায় না। সেই চেতনা থেকেই ১৯৪৮ সালে প্যারিসে গৃহীত হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ। এর মূল দর্শন ছিল—মানুষ হিসেবে প্রতিটি জীবনের মূল্য সমান। কিন্তু গত সাত দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সংজ্ঞা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাস্তবে মানবাধিকারের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় ক্ষমতার সমীকরণে।

একজন ইউরোপীয় বা আমেরিকান নাগরিকের জীবনের যে মূল্য বা ‘অধিকার’ হিসেবে গণ্য হয়, মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার একজন নাগরিকের জীবন সেই একই পাল্লায় মাপা হয় না।

জাতিসংঘ আসলে ‘কাগুজে বাঘ’

মানবাধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার নাম জাতিসংঘ। গাজায় যখন দিনের পর দিন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ছিল কার্যত অচল। এর মূল কারণ—ভেটো ক্ষমতা। জাতিসংঘের কাঠামোতেই গলদ রয়ে গেছে। পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা মাত্র পাঁচ দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স) হাতে।

গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য যখনই কোনো প্রস্তাব আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা তা আটকে দিয়েছে। আবার ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে রাশিয়ার ভেটো সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, এই পরাশক্তিগুলো বা তাদের মিত্ররা যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তখন জাতিসংঘ ‘ডিবেটিং ক্লাব’ বা বিতর্ক সভার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রাফাহ ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি জানেন, তাঁর কথার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। যে সংস্থাটি তৈরি হয়েছিল বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য, সেটি এখন কেবল ‘ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা’য় পরিণত হয়েছে। তারা লাশ গুনতে পারে। কিন্তু লাশ হওয়া থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে না।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে মানবাধিকারের দ্বিমুখী নীতি

মানবাধিকারের ধারণা যে কতটা সিলেক্টিভ বা বাছ-বিচারমূলক তা বোঝা যায় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে। ইউক্রেনের যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, রাশিয়ার ওপর হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার সিকিভাগ তৎপরতাও দেখা যায়নি ইয়েমেন, সুদান বা গাজায়।

ইয়েমেনে বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধে লাখো মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। কিন্তু সেখানে মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো দেশগুলোই সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে। সুদানে জাতিগত দাঙ্গায় হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত। কিন্তু তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার হেডলাইন হয় না। মানবাধিকার এখন আর নৈতিক অবস্থান নয়, বরং ভূ-রাজনীতির ঘুঁটি।

যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশটি আমার মিত্র হয় তবে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশই যথেষ্ট। আর যদি শত্রু হয় তবে তার বিচার চাই। এই দ্বিমুখী নীতিই মানবাধিকারের ধারণাকে সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যকর করে তুলেছে।

কেন আমরা মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হলাম

মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের এই সামষ্টিক ব্যর্থতার পেছনের কয়েকটি মূল কারণ হলো:

এনফোর্সমেন্ট বা প্রয়োগের অভাব: আন্তর্জাতিক আদালতের (আইসিজে) কোনো নিজস্ব পুলিশ বা সেনাবাহিনী নেই। তারা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে। কিন্তু তা কার্যকর করার ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা ‘ইমপিনিউটি’ তৈরি হয়েছে। শাসকরা জানেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও তাদের কিছু হবে না।

জাতীয় স্বার্থ বনাম মানবিকতা: রাষ্ট্রগুলো সবসময় তাদের জাতীয় স্বার্থ, অর্থনীতি ও সামরিক জোটকে মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে জেনেও পশ্চিমা দেশগুলো অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেনি। কারণ সেখানে তাদের কৌশলগত স্বার্থ ও অস্ত্র ব্যবসার লাভ জড়িত।

মানবাধিকারের রাজনীতিকরণ: শক্তিশালী দেশগুলো মানবাধিকারকে দুর্বল দেশগুলোকে চাপে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যখন কোনো উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচন বা শ্রম অধিকার নিয়ে সমস্যা হয় তখন স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আসে। কিন্তু একই ধরনের বা এর চেয়ে ভয়াবহ অপরাধ যখন কোনো পরাশক্তি করে, তখন বিশ্ব নীরব থাকে।

১৯৪৮ সালে প্যারিসে গৃহীত হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ। এর মূল দর্শন ছিল—মানুষ হিসেবে প্রতিটি জীবনের মূল্য সমান। কিন্তু গত সাত দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সংজ্ঞা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।

দিনশেষে, গাজার ধ্বংসস্তূপ, ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশু কিংবা ইউক্রেনের ট্রেঞ্চে মৃত সৈনিক—আমাদের এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সেটি হলো, পৃথিবীতে মানবাধিকার বলতে আদতে কিছু নেই। যা আছে, তা হলো ‘নাগরিক অধিকার’, যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের দেয়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন নিজেই ঘাতক হয়ে ওঠে অথবা অন্য কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র যখন আগ্রাসন চালায় তখন ‘মানুষ’ হিসেবে আপনার অধিকার রক্ষা করার কেউ নেই।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা নিসন্দেহে সুন্দর দলিল, একটি রোমান্টিক স্বপ্ন। সেমিনারে, সিম্পোজিয়ামে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে এটি শুনতে খুব ভালো শোনায়। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর রুক্ষ মাটিতে, যেখানে ক্ষমতার জোরই শেষ কথা, সেখানে মানবাধিকার অকার্যকর ধারণা। গাজায় যা ঘটেছে ও ঘটছে, তা প্রমাণ করে যে—যদি আপনার পেছনে কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র বা সামরিক জোট না থাকে, তবে আপনার ‘বেঁচে থাকার অধিকার’টুকুও নিশ্চিত নয়।

অতএব, আমাদের স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবাধিকার কেবল কিছু কেতাবি শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়। দুর্বলকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ও সবলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত একটি মুখোশ মাত্র। গাজার প্রতিটি মৃতদেহ সেই মুখোশই টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।

লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত