খালেদা জিয়া তাঁর সমর্থক এবং বৃহত্তর জনসমাজে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি লাভ করেছেন। এই উপাধি তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন নেত্রী’ বিশেষণটি কি কেবল দলীয় তকমা? নাকি দীর্ঘ চার দশকে তাঁর ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রলোভন এড়িয়ে চলার দৃঢ়তার স্বীকৃতি? কেন তাঁকে বলা হয় আপসহীন?
খালেদা জিয়ার এই উপাধির প্রেক্ষাপটে আছে ১৯৮৬ সালের এক ঐতিহাসিক ‘না’ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক দীর্ঘ ও নিঃসঙ্গ সংগ্রাম।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এবং তাঁকে ‘আপসহীন’ খেতাবে ভূষিত করার মূল ভিত্তিটি রচিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার তখন ক্ষমতায় থাকার বৈধতার সংকট কাটাচ্ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে এনে নিজের শাসনকে গণতান্ত্রিক রূপ দিতে।
সেই সময়ের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যারা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে, তারা জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হবে।’ বিএনপি এবং খালেদা জিয়াও একই অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সেই নির্বাচন বর্জন করে, যার ফলে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এই বর্জন তাঁকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ এবং গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সিদ্ধান্ত এরশাদের ক্ষমতাকে বৈধতা পেতে বাধা দিয়েছিল।
সেই সময় দৃশ্যপটে একা হয়ে যান খালেদা জিয়া। এরশাদ সরকার তাঁকে বহু প্রলোভন দেখিয়েছিল—ক্ষমতার অংশীদারত্ব, মন্ত্রিত্ব, এমনকি প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব। কিন্তু খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘স্বৈরাচারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। যতক্ষণ না গণতন্ত্র মুক্তি পায়, ততক্ষণ রাজপথই আমার ঠিকানা।’
সেদিন খালেদা জিয়া আপস করলে হয়তো তখনই ক্ষমতার স্বাদ পেতেন। কিন্তু হারিয়ে ফেলতেন জনগণের আস্থা। তাঁর সেই ‘না’ বলার সাহসের কারণে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়। নতুন করে দানা বাঁধে এরশাদবিরোধী আন্দোলন। সেই থেকে জনমানুষের চোখে খালেদা জিয়া আরোহণ করলেন এক ভিন্ন উচ্চতায়। তিনি আর কেবল জিয়াউর রহমানের সহানুভূতি পাওয়া বিধবা স্ত্রী থাকলেন না; হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের আস্থার প্রতীক—‘আপসহীন নেত্রী’।
১৯৮৬ সালে যাঁরা নির্বাচনে গিয়ে এরশাদকে বৈধতা দিতে চেয়েছিলেন, জনগণ তাঁদের ওই সব কর্মকাণ্ড ভুলে যায়নি। এর প্রমাণ মেলে ১৯৯১ সালের নিরপেক্ষ নির্বাচনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সব হিসাব উল্টে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ভোটবিপ্লব ঘটায়। তারা বেছে নেয় সেই মানুষটিকে, যিনি এর আগের ৯ বছর স্বৈরাচারের সামনে মাথা নত করেননি। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। এটি ছিল তাঁর আপসহীনতার প্রথম বড় রাজনৈতিক বিজয়।
১/১১-এর সংকট: মাটি কামড়ে পড়ে থাকা
খালেদা জিয়ার আপসহীনতার দ্বিতীয় বড় পরীক্ষাটি আসে ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া—দুজনকেই রাজনীতি থেকে সরানোর ছক কষা হয়।
সে সময় শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার নামে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি দেশত্যাগ করেন। খালেদা জিয়ার ওপরও প্রবল চাপ ছিল সৌদি আরব বা যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়ার জন্য। তাঁর দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয়। বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া বললেন, ‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশই আমার ঠিকানা। মরলে এ দেশেই মরব, কিন্তু জেলের ভয়ে দেশ ছাড়ব না।’
খালেদা জিয়া জেল খেটেছেন, কিন্তু দেশ ছাড়েননি। মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এই অনড় অবস্থানের ভূমিকা ব্যাপক। এই দেশপ্রেম এবং সাহসের দৃষ্টান্ত খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থানকে আবার পরীক্ষিত করে। তিনি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান।
এরপর ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর। সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে ৪০ বছর ধরে যে বাড়িতে তিনি বাস করছিলেন, ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডের সেই বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়। সেদিন ৭৩ বছর বয়সী এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চোখের পানি দেখেছিল পুরো বিশ্ব। তাঁকে যখন টেনেহিঁচড়ে বের করা হচ্ছিল, তিনি কোনো রাজনৈতিক হুমকি দেননি। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’
খালেদা জিয়া ভেঙে পড়েননি। গুলশানের ভাড়া বাড়িতে উঠে আবার নতুন করে দল গোছানোর কাজ শুরু করেন।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে না যাওয়া
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করেন। আন্তর্জাতিক মহল এবং অভ্যন্তরীণ চাপ ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই নির্বাচনে অংশ নেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রকে হত্যা করে আমি এমপি-মন্ত্রী হতে চাই না।’
খালেদা জিয়ার সেই বয়কটকে অনেকে ‘রাজনৈতিক ভুল’ বলেছেন। কিন্তু সেই বয়কট ৫ জানুয়ারির ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনকে এক প্রহসনে রূপান্তরিত করে।
একই কায়দায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া ছিলেন কারাগারে। প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল প্যারোলে মুক্তি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে অথবা সমঝোতা করতে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হলে কোনো সমঝোতা নয়।’
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়। পাঠানো হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে। জনমানবহীন সেই কারাগারে তিনি ছিলেন একমাত্র বন্দি।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, অসুস্থ এবং প্রবীণ এই মানুষটিকে রাখা হয়েছিল বসবাসের অযোগ্য এক নির্জন প্রকোষ্ঠে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বাড়ছিল। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে রাজনীতি ছাড়ার শর্তে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু অসুস্থ শরীরে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি সরকারের শর্তে মুক্তি নিতে রাজি হননি। এই আপস না করার দৃঢ়তা, এই সহ্যশক্তি খালেদা জিয়াকে নিয়ে গেছে আলাদা উচ্চতায়।
খালেদা জিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী
কারাবন্দি হওয়ার আগে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সম্পর্কে একটি কথা বলেছিলেন। সেই কথা আজ মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগকে আমাদের কিছুই করতে হবে না। ওরা নিজেরাই একদিন পচবে। পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতন আর শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে কথাটি সত্য হয়েছে। যে নেত্রী ক্ষমতার লোভে কখনো দেশ ছাড়েননি, তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছিল। আর যিনি তাঁকে বন্দি রেখেছিলেন, তাঁকেই শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালাতে হলো।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অনুসরণীয় এক উদাহরণ। স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দলের হাল ধরেছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে আপস করলে হয়তো তাঁর জীবন মসৃণ হতো, কিন্তু তিনি হতেন না ‘দেশনেত্রী’। ১/১১-তে দেশ ছাড়লে হয়তো আরামে থাকতেন, কিন্তু হতেন না দৃঢ়তার প্রতীক।
খালেদা জিয়ার এই আপসহীন ও অনমনীয় অবস্থানের কিছু নেতিবাচক রাজনৈতিক ফল নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। নীতিগত কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো পরবর্তী সময়ে বিএনপিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংসদের বাইরে রাখে। এর ফলে দলের সাংগঠনিক কাঠামো এবং সরকারে প্রভাব ফেলার সুযোগ সীমিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর এই কঠোর অবস্থান কখনো কখনো বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল।
তবে সব মিলিয়ে আজকের দিনে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মূল্যায়ন বলে, তিনি হেরে যাননি। তাঁর দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে অনেক। কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের দৃঢ়তা। জেল, জুলুম, গৃহবন্দিত্ব, এক সন্তানের মৃত্যু, আরেক সন্তানের নির্বাসন এবং শারীরিক অসুস্থতা—কোনো কিছুই তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি।
ক্ষমতার প্রলোভন ত্যাগ করে, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে, নীতির প্রশ্নে অটল থেকে বাংলাদেশে ‘না’ বলার সাহস যে কজন দেখাতে পেরেছেন—তাঁদের তালিকায় খালেদা জিয়ার অবস্থান নিঃসন্দেহে অন্যতম। বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘আপসহীন’ শব্দটিতে তাঁর দাবি অস্বীকার করা যাবে না।
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক