রাশিয়া-ভারত-চীনের পুরোনো জোট পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ভারত-চীনের মধ্যে আছে গভীর সন্দেহ। তিন দেশের অর্থনীতির মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান।
মাহবুবুল আলম তারেক

১৯৯০-এর দশকে রাশিয়া, ভারত ও চীনের ‘আরআইসি’ জোটের ধারণা প্রথম আসে। একে তখন মার্কিন প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছিল। এখন আবার জোটটি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের চাপ মোকাবিলায় এই জোটের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে দেখা দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পুরোনো অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক টানাপোড়েনের কারণে জোটের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। যদিও তিন দেশেরই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তবু বাস্তবে এই জোট মূলত সুবিধাবাদী।
যদি জোটটি সত্যিই শক্তিশালী হয়, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যের বার্তা দেবে। কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যে গভীর সন্দেহ এবং তিন দেশের অর্থনৈতিক পার্থক্য সেই সম্ভাবনাকে বাধাপ্রাপ্ত করছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ভারত ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়ার তেল কেনার কারণে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ৫০ শতাংশ করেছেন, যা ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলেও চীন সাময়িকভাবে কিছুটা চাপ থেকে মুক্ত। তবে তারা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আটকে আছে। আর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নতুন মিত্র খুঁজছে।
গত ৩১ আগস্ট চীনের তিয়ানজিনে শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো অংশ নিয়েছে। এর আগে, ২৫ আগস্ট, রাশিয়া ও ভারত আরআইসি জোট পুনরুজ্জীবিত করার কথা জানিয়েছিল। রাশিয়া এসসিও সম্মেলনে এই তিন দেশের মধ্যে আরআইসি নিয়ে আলোচনার বিষয়টি জোর দিয়ে উত্থাপন করে। তবে ওই আলোচনা শেষ পর্যন্ত হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। সম্মেলনের পর মোদি নিজের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডলে পোস্টে লিখেছেন, “চীনে একটি ফলপ্রসূ সফর শেষ করলাম। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছি, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেছি।”
এই সফরের মাধ্যমে মোদি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের দৃঢ় সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে ওয়াশিংটনকে একটি শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছেন। চীন, রাশিয়া ও ভারত দীর্ঘদিন ধরেই এসসিওকে পশ্চিমা বিশ্বের ন্যাটোর বিকল্প মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে নানা কারণে ভারতের পক্ষ থেকে এসসিওতে সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু দ্বিধাও কাজ করেছে।
এর আগের কয়েকটি এসসিও সম্মেলনে মোদি নিজে অংশ নেননি; তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরকে পাঠিয়েছিলেন। এবারে প্রথমবার সাত বছরের মধ্যে তিনি নিজে তিয়ানজিনে এসেছেন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মোদি, পুতিন ও শি জিনপিং একসঙ্গে সৌহার্দ্যের দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন। করমর্দন, আলিঙ্গন ও হাসি-রসিকতার মাধ্যমে তিয়ানজিনে একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয়। মোদি এক্সে লিখেছেন, ‘তিয়ানজিনে কথোপকথন অব্যাহত! প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে মতবিনিময়।
শুল্ক এবং বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এখনই ভারত-চীন সম্পর্কের বড় পরিবর্তনের আশা করা বাস্তবসম্মত নয়।
১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে রাশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়েভজেনি প্রিমাকভ আরআইসি নামের এই জোটের ধারণা প্রথম প্রস্তাব করেন। তিনি ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লি সফরে এই প্রস্তাব দেন। লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু তখন জোটটি গঠিত হলেও খুব দূর এগোয়নি। কাগজে-কলমে এই তিন দেশ—বিশাল অর্থনীতি ও জনসংখ্যা নিয়ে শক্তিশালী মনে হলেও, বাস্তবে ভারত ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস জোটকে সবসময় দুর্বল করে রেখেছে।
২০০০-এর দশক এবং ২০১০-এর দশকের শুরুর দিকেও আরআইসি নিয়মিত বৈঠক করেছে। এসব বৈঠক হয়েছে মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ে। এটি কখনো ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সামরিক বা অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হয়নি। তবে জাতিসংঘ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মে এটি কার্যকর সমন্বয় ফোরাম হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি, ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) মতো নতুন জোট গঠনের ধারণাগত পূর্বসূরী হিসেবেও এর ভূমিকা আছে।
পরবর্তীতে আরআইসি দুটি কারণে গুরুত্ব হারায়। প্রথমত, কোভিড মহামারির সময় বহু বহুপাক্ষিক ফোরাম বন্ধ হয়ে যায়। আরআইসির বৈঠকও স্থগিত হয়; ভার্চুয়াল বৈঠকগুলো অগ্রাধিকার পায় জি-২০ বা ব্রিকসের মতো জরুরি ফরম্যাটে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ ভারত-চীন সম্পর্কে বড় ফাটল ধরায়। দুদেশের মধ্যে আস্থা মারাত্মকভাবে কমে যায়। সীমান্ত সমস্যা অমীমাংসিত থাকায় আরআইসির কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে যায়।
ভারত-চীনের সীমান্ত বিরোধই সবচেয়ে বড় সমস্যা। হিমালয় অঞ্চলে ৩,৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন উত্তেজনা চলছে। ১৯৬২ সালে এই বিরোধ প্রথম যুদ্ধে রূপ নেয়। ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। এরপর দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকে। ভারত চীনা নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা বন্ধ করে দেয় এবং প্রযুক্তি আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক ভারতের জন্য চাপ বাড়িয়েছে। এর ফলে ভারত ও চীনের মধ্যে কিছুটা নৈকট্য দেখা দিয়েছে। সীমান্ত বিরোধ সমাধানের জন্য তারা সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। ভিসা নিয়ে উত্তেজনা কিছুটা কমেছে এবং চীন ভারতের রপ্তানি ইস্যুতে সমন্বয় দেখিয়েছে। তবে নতুন সংঘাতের ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে।
কাউন্সিল ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা হ্যাপিমন জ্যাকব বলেছেন, বড় ধরনের সহিংসতা এখন এড়ানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্মিলনের সম্ভাবনা কম। চীনের দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। মে মাসে সংঘর্ষে পাকিস্তান চীনের জে-১০সি জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেছে। ভারতের মতে, চীন পাকিস্তানকে বিমান প্রতিরক্ষা এবং কৃত্রিম উপগ্রহ সহায়তাও দিয়েছে।
নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকেও জোট ভারতের জন্য লাভজনক নয়। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও পুঁজির ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া বা চীন এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার; দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩১.৮৪ বিলিয়ন ডলার। ভারতের পক্ষে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি বেড়ে ৮৬.৫১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। অন্যদিকে আমদানি ৪৫.৩৩ বিলিয়ন ডলার। বার্কলেসের হিসাব অনুযায়ী, ৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ পণ্য (প্রধানত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও রত্ন-গহনা) ঝুঁকিতে।
চীনের আরেকটি বড় সুবিধা হলো ‘রেয়ার আর্থ’ খনিজ, যা আধুনিক প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে অপরিহার্য। এর ৬১ শতাংশ উৎপাদন এবং ৯২ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ চীনের একচেটিয়া আধিপত্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে। প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং সেমিকন্ডাক্টরসহ বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ভারত কোয়াড ও আইটুইউটু সদস্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যও বাড়ন্ত।
ভারতের সরকারি বিবৃতি— আরআইসি সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত ‘দুইপক্ষের সুবিধামত’ নেওয়া হবে। এটি দেখায়, নয়াদিল্লি দরজা বন্ধ করছে না, তবে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সতর্ক মূল্যায়ন করছে।
তাই আরআইসি পুনরুজ্জীবিত হলেও সীমিত এবং বিষয়ভিত্তিক ফরম্যাটে হবে। জ্বালানি সমন্বয়, জলবায়ু নীতি ও আঞ্চলিক সংযোগে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ ত্রিপক্ষীয় কৌশলগত সমন্বয় শুধুমাত্র বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সম্ভব।
রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া-চীনের বাণিজ্য গত বছর ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ভারতের জন্য এমন একটি জোটে যোগ দেওয়া মানে কনিষ্ঠ অংশীদার হওয়া, যা নয়াদিল্লির জন্য আকর্ষণীয় নয়।
রাশিয়া বারবার জোট পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। ২০২৫ সালের মে মাসে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ‘এই ত্রিপক্ষীয় জোট পুনরুজ্জীবনের সময় এসেছে।’ চীনও সমর্থন জানিয়েছে।
যদি জোটটি সত্যিই শক্তিশালী হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কিন্তু তিন দেশকে একত্রিত করছে প্রয়োজন, বিশ্বাস নয়। তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে দৃশ্যমান সৌহার্দ্য প্রতীকী; বাস্তব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমে গেলে এই ভঙ্গুর জোট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
(ব্লুমবার্গে প্রকাশিত কারিশমা ভাসওয়ানির লেখা এবং ফার্স্টপোস্টে প্রকাশিত অনিন্দ দের লেখা অবলম্বনে)

১৯৯০-এর দশকে রাশিয়া, ভারত ও চীনের ‘আরআইসি’ জোটের ধারণা প্রথম আসে। একে তখন মার্কিন প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছিল। এখন আবার জোটটি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের চাপ মোকাবিলায় এই জোটের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে দেখা দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পুরোনো অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক টানাপোড়েনের কারণে জোটের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। যদিও তিন দেশেরই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তবু বাস্তবে এই জোট মূলত সুবিধাবাদী।
যদি জোটটি সত্যিই শক্তিশালী হয়, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যের বার্তা দেবে। কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যে গভীর সন্দেহ এবং তিন দেশের অর্থনৈতিক পার্থক্য সেই সম্ভাবনাকে বাধাপ্রাপ্ত করছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ভারত ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়ার তেল কেনার কারণে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ৫০ শতাংশ করেছেন, যা ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলেও চীন সাময়িকভাবে কিছুটা চাপ থেকে মুক্ত। তবে তারা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আটকে আছে। আর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নতুন মিত্র খুঁজছে।
গত ৩১ আগস্ট চীনের তিয়ানজিনে শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো অংশ নিয়েছে। এর আগে, ২৫ আগস্ট, রাশিয়া ও ভারত আরআইসি জোট পুনরুজ্জীবিত করার কথা জানিয়েছিল। রাশিয়া এসসিও সম্মেলনে এই তিন দেশের মধ্যে আরআইসি নিয়ে আলোচনার বিষয়টি জোর দিয়ে উত্থাপন করে। তবে ওই আলোচনা শেষ পর্যন্ত হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। সম্মেলনের পর মোদি নিজের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডলে পোস্টে লিখেছেন, “চীনে একটি ফলপ্রসূ সফর শেষ করলাম। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছি, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেছি।”
এই সফরের মাধ্যমে মোদি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের দৃঢ় সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে ওয়াশিংটনকে একটি শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছেন। চীন, রাশিয়া ও ভারত দীর্ঘদিন ধরেই এসসিওকে পশ্চিমা বিশ্বের ন্যাটোর বিকল্প মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে নানা কারণে ভারতের পক্ষ থেকে এসসিওতে সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু দ্বিধাও কাজ করেছে।
এর আগের কয়েকটি এসসিও সম্মেলনে মোদি নিজে অংশ নেননি; তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরকে পাঠিয়েছিলেন। এবারে প্রথমবার সাত বছরের মধ্যে তিনি নিজে তিয়ানজিনে এসেছেন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মোদি, পুতিন ও শি জিনপিং একসঙ্গে সৌহার্দ্যের দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন। করমর্দন, আলিঙ্গন ও হাসি-রসিকতার মাধ্যমে তিয়ানজিনে একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয়। মোদি এক্সে লিখেছেন, ‘তিয়ানজিনে কথোপকথন অব্যাহত! প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে মতবিনিময়।
শুল্ক এবং বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এখনই ভারত-চীন সম্পর্কের বড় পরিবর্তনের আশা করা বাস্তবসম্মত নয়।
১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে রাশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়েভজেনি প্রিমাকভ আরআইসি নামের এই জোটের ধারণা প্রথম প্রস্তাব করেন। তিনি ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লি সফরে এই প্রস্তাব দেন। লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু তখন জোটটি গঠিত হলেও খুব দূর এগোয়নি। কাগজে-কলমে এই তিন দেশ—বিশাল অর্থনীতি ও জনসংখ্যা নিয়ে শক্তিশালী মনে হলেও, বাস্তবে ভারত ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস জোটকে সবসময় দুর্বল করে রেখেছে।
২০০০-এর দশক এবং ২০১০-এর দশকের শুরুর দিকেও আরআইসি নিয়মিত বৈঠক করেছে। এসব বৈঠক হয়েছে মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ে। এটি কখনো ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সামরিক বা অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হয়নি। তবে জাতিসংঘ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মে এটি কার্যকর সমন্বয় ফোরাম হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি, ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) মতো নতুন জোট গঠনের ধারণাগত পূর্বসূরী হিসেবেও এর ভূমিকা আছে।
পরবর্তীতে আরআইসি দুটি কারণে গুরুত্ব হারায়। প্রথমত, কোভিড মহামারির সময় বহু বহুপাক্ষিক ফোরাম বন্ধ হয়ে যায়। আরআইসির বৈঠকও স্থগিত হয়; ভার্চুয়াল বৈঠকগুলো অগ্রাধিকার পায় জি-২০ বা ব্রিকসের মতো জরুরি ফরম্যাটে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ ভারত-চীন সম্পর্কে বড় ফাটল ধরায়। দুদেশের মধ্যে আস্থা মারাত্মকভাবে কমে যায়। সীমান্ত সমস্যা অমীমাংসিত থাকায় আরআইসির কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে যায়।
ভারত-চীনের সীমান্ত বিরোধই সবচেয়ে বড় সমস্যা। হিমালয় অঞ্চলে ৩,৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন উত্তেজনা চলছে। ১৯৬২ সালে এই বিরোধ প্রথম যুদ্ধে রূপ নেয়। ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। এরপর দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকে। ভারত চীনা নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা বন্ধ করে দেয় এবং প্রযুক্তি আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক ভারতের জন্য চাপ বাড়িয়েছে। এর ফলে ভারত ও চীনের মধ্যে কিছুটা নৈকট্য দেখা দিয়েছে। সীমান্ত বিরোধ সমাধানের জন্য তারা সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। ভিসা নিয়ে উত্তেজনা কিছুটা কমেছে এবং চীন ভারতের রপ্তানি ইস্যুতে সমন্বয় দেখিয়েছে। তবে নতুন সংঘাতের ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে।
কাউন্সিল ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা হ্যাপিমন জ্যাকব বলেছেন, বড় ধরনের সহিংসতা এখন এড়ানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্মিলনের সম্ভাবনা কম। চীনের দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। মে মাসে সংঘর্ষে পাকিস্তান চীনের জে-১০সি জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেছে। ভারতের মতে, চীন পাকিস্তানকে বিমান প্রতিরক্ষা এবং কৃত্রিম উপগ্রহ সহায়তাও দিয়েছে।
নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকেও জোট ভারতের জন্য লাভজনক নয়। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও পুঁজির ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া বা চীন এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার; দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩১.৮৪ বিলিয়ন ডলার। ভারতের পক্ষে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি বেড়ে ৮৬.৫১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। অন্যদিকে আমদানি ৪৫.৩৩ বিলিয়ন ডলার। বার্কলেসের হিসাব অনুযায়ী, ৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ পণ্য (প্রধানত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও রত্ন-গহনা) ঝুঁকিতে।
চীনের আরেকটি বড় সুবিধা হলো ‘রেয়ার আর্থ’ খনিজ, যা আধুনিক প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে অপরিহার্য। এর ৬১ শতাংশ উৎপাদন এবং ৯২ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ চীনের একচেটিয়া আধিপত্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে। প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং সেমিকন্ডাক্টরসহ বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ভারত কোয়াড ও আইটুইউটু সদস্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যও বাড়ন্ত।
ভারতের সরকারি বিবৃতি— আরআইসি সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত ‘দুইপক্ষের সুবিধামত’ নেওয়া হবে। এটি দেখায়, নয়াদিল্লি দরজা বন্ধ করছে না, তবে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সতর্ক মূল্যায়ন করছে।
তাই আরআইসি পুনরুজ্জীবিত হলেও সীমিত এবং বিষয়ভিত্তিক ফরম্যাটে হবে। জ্বালানি সমন্বয়, জলবায়ু নীতি ও আঞ্চলিক সংযোগে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ ত্রিপক্ষীয় কৌশলগত সমন্বয় শুধুমাত্র বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সম্ভব।
রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া-চীনের বাণিজ্য গত বছর ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ভারতের জন্য এমন একটি জোটে যোগ দেওয়া মানে কনিষ্ঠ অংশীদার হওয়া, যা নয়াদিল্লির জন্য আকর্ষণীয় নয়।
রাশিয়া বারবার জোট পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। ২০২৫ সালের মে মাসে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ‘এই ত্রিপক্ষীয় জোট পুনরুজ্জীবনের সময় এসেছে।’ চীনও সমর্থন জানিয়েছে।
যদি জোটটি সত্যিই শক্তিশালী হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কিন্তু তিন দেশকে একত্রিত করছে প্রয়োজন, বিশ্বাস নয়। তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে দৃশ্যমান সৌহার্দ্য প্রতীকী; বাস্তব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমে গেলে এই ভঙ্গুর জোট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
(ব্লুমবার্গে প্রকাশিত কারিশমা ভাসওয়ানির লেখা এবং ফার্স্টপোস্টে প্রকাশিত অনিন্দ দের লেখা অবলম্বনে)

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কি কনভেনশনাল যুদ্ধ নাকি ইনসারজেন্সি অপারেশন? অনেকেরই এই বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার নয়। তবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে শুরুতেই জানতে হবে ইনসারজেন্সি এবং কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন কী?
১৩ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে মানবাধিকার কমিশন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগে গত ৯ নভেম্বর সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এর ধারাবাহিকতায়
১ দিন আগে
বিশ্বের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তবে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন এখনো বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় কম। বাংলাদেশে গড় উৎপাদন প্রায় প্রতি হেক্টরে ১১ টন ।
২ দিন আগে
অপরাধবিজ্ঞানে একটি তত্ত্ব আছে—‘মিউচুয়াল রিক্রিমিনেশন’ বা পারস্পরিক দোষারোপ। যখন কোনো অপরাধী চক্রের সদস্যরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে শুরু করে, তখন তাদের জবানবন্দি থেকেই বেরিয়ে আসে আসল সত্য। একাত্তরে পরাজয়ের পর পাকিস্তানি জেনারেলরা ঠিক এই কাজটিই করেছেন।
৩ দিন আগে