আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের জন্মদিন। ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রে তিনি যে আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করেছেন তার রূপটি আসলে কেমন? মাটির ময়নার চরিত্র চিত্রণে তারেক মাসুদ কি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন?
মাসুদ পারভেজ

তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-অঙ্গনে একটি বিশেষ নাম। যদিও তাঁর চলচ্চিত্র-জীবন সুদীর্ঘ হয়নি তবুও প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য মিলিয়ে মোট ১৯টি চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে তাঁকে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রথাগত চলচ্চিত্রের বাইরে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস ‘আদম সুরত’ (১৯৮৯), ‘মাটির ময়না’ (২০০২), ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬), ‘নরসুন্দর’ (২০০৯) ও ‘রানওয়ে’ (২০১০) বিশেষত্বের দাবি রাখে। তিনি মাটির ময়না চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের বয়ান কীভাবে সৃষ্টি করেছেন তা অন্বেষণ করাই এই আলোচনার লক্ষ্য। এবার সেদিকে যাওয়া যাক।
মাটির ময়না প্রসঙ্গে আলোচনা শুরুর পূর্বে ভারতীয় কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে একটু দৃষ্টি দেই। বিভূতিভূষণ নামটি বলার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মধ্যে যে ইমেজ আসে তা হলো ‘পথের পাঁচালী’। চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস থেকে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র। কী আছে এই উপন্যাসে? কিংবা পথের পাঁচালী উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পায়?
বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ তো ক্ষয়িষ্ণু এক ব্রাহ্মণ ও তার পুত্রের গল্প—যা মূলত ঔপনিবেশিক ভারতে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবির্ভাবের ফলে সৃষ্ট বাস্তবতা। এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন কী করে? ব্রাহ্মণ হরিহর ও তার বালক পুত্র অপুকে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে নতুন পথের দিকে নেয়। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যে আকাঙ্খার সন্ধানে তারা বের হয়ে যায়— তা কি আদৌ পূরণ হয়েছিল? ততদিনে ব্রাহ্মণ হরিহরের পৌরোহিত্য পুঁজি-প্রভাবিত কলকাতায় মোটামুটি অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে। এই যে বিভূতিভূষণ নিশ্চিন্দিপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি গ্রাম্যপরিবারকে ভিটেমাটির মায়া উপড়িয়ে নিয়ে এলেন, কেন করলেন এটা? আর সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র হিসেবে কেন-ই বা এই বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিলেন? বিভূতিভূষণ ও সত্যজিৎ উভয়েই একই বিষয়কে দেখাতে চেয়েছেন, আর তা হলো ঔপনিবেশিক ভারতের বাংলা। হরিহরের মৃত্যু একটি নির্দিষ্ট পেশার পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে তার পুত্র অপুর পূর্বপুরুষের পথে আর যাওয়া হয়নি। বলা যায়, সে অবস্থা ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সংকটে অপু তার ভিটেমাটিতে ফেরার জন্যে মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করেছে। কারণ নিশ্চিন্দিপুরের বাইরে অপু নিজেকে ‘আউটসাইডার’ হিসেবে দেখেছে, ফলে তার আত্মপরিচয় হলো গ্রামে ফেরার আকুতি। শেকড়ে ফেরার এই আকুতিটাই মূলত মানুষের আত্মপরিচয়ের তাগিদ থেকে উদ্ভুত। মানুষের জ্ঞান ও নির্জ্ঞান মন সর্বদা এই আকুতি অনুভব করে। যা বোধ করেছিল অডিসিয়ুস, তার রাজ্য ইথাকায় ফেরার জন্য। তারেক মাসুদ তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে এই আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন। মাটির ময়নার ক্ষেত্রে বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।
মাটির ময়নার চরিত্র চিত্রণে তারেক মাসুদ কি পথের পাঁচালী উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন? ধরা যাক,
দুর্গার মতো আসমার মৃত্যু হলো। অপুর মতো আনুও বোন হারিয়ে একাকিত্ব বোধ করল। কিন্তু এখানে একটি বড় পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ইংরেজ উপনিবেশে অপু পুরোহিত হওয়ার দীক্ষা নিয়েও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্কুলে যায়, আর সেই ইংরেজ উপনিবেশ খতম হওয়ার পর স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে আনু যায় কওমি মাদ্রাসায়। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে আনুর এই বিষয়টি খেয়াল করা দরকার। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আনু বাংলাভাষী অঞ্চলের মানুষ হওয়ায় তার আইডেনটিটি বাঙালি মুসলমান। কিন্তু ইংরেজ উপনিবেশে থাকার পরেও অপুকে বাঙালি হিন্দু আউডেনটিটি ধারণ করতে হয়নি। ফলে আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি ও মুসলমান এই দুইটি বিষয় কারও কারও মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর এই প্রকৃতির মানুষ হলো আনুর পিতা কাজী মাজহারুল ইসলাম। এই কাজী মাজহারুল ইসলামের সংকট কিংবা অভিপ্রায়টা বোঝা দরকার। তার সম্পর্কে চলচ্চিত্রে করিম বয়াতি বলেন, ‘কাজী সাব অবিশ্যি এমুন ছিল না। ইংরাজ সায়েব গো মতো কাপড়-চোপড় পরতো। হঠাৎ যে কী অইলো, দরবেশ অইয়া গেল। কী মানুষ কী অইয়া গেল! দাড়ি রাখলো, টুপি আলখেল্লা লাগাইলো। আর বউডার খেলা বন্দ। বাড়ির চাইরদিকে বেড়া দিয়া দিল। ঘরের মইদ্যেই বোরকা পরাইয়া রাখে। নতুন মুসলমান তো, কী কড়া! এহন তো তোমার বাপ অনেক নরম হইয়া গেছে।’

প্রশ্ন জাগে, কাজী মাজহারুল চরিত্রটির এরকম রূপান্তরের কারণ কী? আর তাকে ‘নতুন মুসলমান’ কী অর্থে বলা হলো? সে প্রসঙ্গে আসা যাবে। তার আগে বলা যাক হরিহরের কথা। হরিহর ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উত্থাপন হয়নি, কাজী মাজহারুলের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। প্রশ্নটা হলো ধর্ম বনাম কালচারের দ্বন্দ্ব উদ্ভূত-সংকটের কারণ খোঁজ করা দরকার। সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে কাজী মাজহারুলের মধ্যে এই সংকট কীভাবে আত্মপরিচেয়র সংকটের রূপ নিল তা দেখা দরকার। সে তার বাঙালি মুসলমানের বাঙালিত্বকে খারিজ করে শুধু মুসলমানি আত্মপরিচয় নির্ধারণ করতে চায়।
আর এই আত্মপরিচয়ের জন্য মুসলমানিত্বের যে সকল চিহ্ন ধারণ করা দরকার তা কট্টরভাবে পালন করে সে। আর এই বিষয়টিকে করিম বয়াতি বলে ‘নতুন মসুলমান’। তো এই নতুন মুসলমানের রাজনৈতিক ইতিহাসটা খেয়াল করা দরকার। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান আন্দোলন সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানেরা পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন ও প্রচারণা চালায়। এক্ষেত্রে তাঁদের আত্মপরিচয় মূলত একটি ধর্মীয় চেতনাকে কেন্দ্র করে একীভূত হয়। তো এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তানে কাজী মাজহারুল ইসলাম তার আত্মপরিচয়কে শুধুই মুসলমান হিসেবেই ধারণ করতে চায়। সেক্ষেত্রে তার কর্মে কঠোর মুসলমানিত্বের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বলা যায়, এটা ঔপনিবেশিক ভারতের দেওবন্দি প্রভাব। যারা একই সঙ্গে ইংরেজ-বিরোধিতা ও আলিগড়পন্থীদের বিরোধিতা জারি রাখে। দেওবন্দিরা ইংরেজ-বিরোধিতা করতে গিয়ে ইংরেজদের সবকিছুকে মুসলমানের জন্য হারাম ঘোষণা করে। আর কাজী মাজহারুল এই পন্থী ফলে তার পুত্র আনুকে কওমি মাদ্রাসায় পড়তে পাঠায়, অুসস্থ কন্যার জন্য এলোপ্যাথি চিকিৎসা না করে নিজেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেয়, স্ত্রীকে ঘরের ভেতরেও পর্দাবৃত করে রাখে, এমনকি ঘরের জানালা খোলাও নিষিদ্ধ থাকে।
কাজী মাজহারুলের মুসলমান আত্মপরিচয় নির্মাণের যে প্রচেষ্টা তা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী একটি রাষ্ট্র যখন উন্মেষের জন্য প্রক্রিয়াধীন তা কাজী মাজহারুল ও খান বাহাদুর চরিত্রটির চোখে একধরনের অরাজকাতা ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। খান বাহাদুর বলে, ‘সারা বঙ্গাল মুলুক জুড়ে কী অরাজকতা সৃষ্টি হইয়াছিল! এর সুরাহা কিন্তু মিছিল-মিটিংয়ে গুলি আর টিয়ারশেল চালাইয়া সম্ভব ছিল না, তার জন্য দরকার ছিল একটা আসল ওষুধ মার্শাল ল’। এখন দেখ সব কেমন ডান্ডার কাছে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ... কি, ঠিক বলি নাই কথাটা।’

বাংলাভাষী খান বাহাদুর ও কাজী মাজহারুলের এই পাকিস্তানপন্থা কি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা অর্থাৎ ইসলাম থেকে উদ্ভুত নাকি অন্য কিছু? বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সংগ্রাম চলচ্চিত্রে লক্ষ করা যায়, তাতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ জনগণই তো মুসলমান এবং পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের সক্রিয়তাও ছিল। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি ও মুসলমান এই দুয়ের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো? কাজী মাজহারুল চরিত্রটি ইসলমাকে পলিটিক্যাল টুলস হিসেবে ধরে তার আত্মপরিচয় ধারণ করতে চেয়েছে। এর ফলে তার কাছে ধর্ম ও কালচারের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তা আর থাকেনি। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মকে আইডেনটিটি হিসেবে ধরে তার জাতিভিত্তিক বাঙালি কালচারকে সে খারিজ করেছে।
ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্নকে সে ধারণ করেনি বা করতে চায়নি। তার কাছে জাতীয়তাবাদের আইডেনটিটি হয়ে উঠেছে ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি হত্যা শুরু করলে সে বলে, ‘শোনা কথায় বিশ্বাস করব না। ওরা আসছে ইসলাম রক্ষা করতে, শান্তি রক্ষা করতে। তো ওরা মানুষ মারবে ক্যান? মুসলমান মুসলমানকে মারবে ক্যান?’ অর্থাৎ পাকিস্তানি ও বাঙালি উভয়কে সে একই মুসলমান হিসেবে ধরে জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় দাড় করায়। কিন্তু তার সেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় টিকে না, যখন সে দেখে তার নিজের বাড়িও পাকিস্তানি সৈন্যরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ধর্মীয় আইডেনটিটি একই হওয়ার পরেও আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে যে বিভাজিত রূপ খেয়াল করা যায়, তাতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
চলচ্চিত্রে আত্মপরিচয়ের আরেক ধরনের প্রেক্ষাপট লক্ষ করা যায় পলিটিক্যাল ইসলামিস্ট ও স্প্রিচুয়াল ইসলামিস্ট ঘরানার মধ্যে। এক্ষেত্রে হালিম হুজুর ও ইব্রাহিম হুজুরের একটি কথোপকথন তুলে ধরা যাক:
ইব্রাহিম: ... এই দেশে ইসলাম তো তলোয়ার দি কায়েম অয় ন। আইত্যার ছাড়া বেশুমার সুফি দরবেশ সালাামত, এখওয়ানিয়ত আর হামদরদির দাওয়াত লই আতরাফ কওমের দরওয়াজার তুন দরওয়াজায় গুইচ্যেন। তলোয়ার দি ইরানি তুরানি রাজা বাদশা ওই হারে জমিন দখল কইচ্যে কিন্তু দিল দখল কইত্য হারে ন। ইসলামের খোশ আমদেদ এই নাঙা দিওয়ানা ফকির আউলিয়াগো লইয়া আইছে। সাচ্চা বাত অইলো, রাজনীতি কন আইত্যার কন, কোনো তাকাত দি উরফের তুন ইসলামের কায়েম করন সম্ভব ন। সহিহ্ দ্বীনি এলেমের দাবাত গরে গরে হৌচাই দেওনের মদ্যে ইসলামের কামিয়াবি হাসিল অইবো।
হালিম: আপনে বলতে চাইতেছেন দ্বীনি এলেমের তরক্কিই আমাদের একমাত্র কাজ হওয়া উচিৎ। সেরেফ এলেমের জন্য এলেম?
ইব্রাহিম: বেশাক ন। আমরা যা কইত্যাম আছি, হিয়ার মইদ্যে এলেম ন, আমলও আছে। চান চাই, আঙ্গো মাদ্রাসায় যারা ভর্তি অওনের লাই আইয়ে, এতিম পোলাপান তো আছেই, আর যে মা-বাপ হেতেনগো আওলাদেগোরে হড়ালেয়া তো দূরের কতা, খানাপিনারও ব্যবস্থা কইত্যে হারে না, হেগুনরেই মাদ্রাসায় হাডায়। হেগুনরে দেখভাল করি খাঁডি মোছলমান করি গড়ি তোলাই আঙ্গো বড় কাম, আঙ্গো বড় আমল। বুইজ্জেন নি কী কইলাম! হেগুনরে রাজনীতির ফেতনা-ফ্যাসাদে এস্তেমাল করা আঙ্গো ঠিক ন।
হালিম: কিন্তু কম্যুনিস্টপন্থীরা ধর্মনিরেপক্ষতার নামে যা শুরু করছে, তা ইসলামের জন্য খতরার কারণ হইয়া দাঁড়াইতেছে। এদের মোকাবিলা না করলি ক্যামনে চলবে?
ইব্রাহিম: তাহলে কম্যুনিস্ট আর রাজনীতি আলাগো লগে আঙ্গো ফারাকটা থাকলো কোনাই?
হালিম: লেকিন ইসলামকে রাজনীতি থেইকা আলাদা করবেন কীভাবে? অহন তো পাকিস্তানকে জারি রাখাই মুশকিল হয়ে পড়তেছে। পাকিস্তান যদি ভাইঙ্গা যায়, তবে এই অঞ্চলে ইসলামের অবস্থা খতরনাক হইয়া পড়বে।
ইব্রাহিম: আইচ্ছা হালিম মিয়া, আন্নে এককান কথা কন চাই, পাকিস্তান না থাকলে ইসলামের অবস্থা বেহাল অই যাইবো, ক্যামনে বুইজলেন? পাকিস্তান কি ইসলাম কায়েম কইচ্যে নাকি মিলিটারি হুকুমত কায়েম কইচ্যে?
উদ্ধৃতিতে দুই হুজুরের আলাপে মূলত পলিটিক্যাল ইসলামের সঙ্গে স্প্রিচুয়াল ইসলামের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরা হয়েছে। তো মজার ব্যাপারটা হলো ইব্রাহিম হুজুর বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সাপেক্ষে মাদ্রাসার ছাত্রদের পাঠদানের প্রেক্ষাপটকে যখন বর্ণনা করে, তখন হালিম হুজুর বলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কথা। সমকালীন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দুই জনই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের শাসন কাঠোমাতে বাংলাভাষী জনগণের আর্থিক ও সামাজিক যে দুর্দশা বিদ্যমান ছিল তাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। ইব্রাহিম হুজুরের উক্তিতে এই বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আর হালিম হুজুর বলে, পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামি রাজনীতির কথা। কারণ সে ইসলামকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সমর্থক। ফলে সে মনে করে, পাকিস্তান ভেঙে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠিত হলে সেখানে ইসলাম বিপন্ন হয়ে যাবে।
এই যে, ধর্মকে কেন্দ্র করে হালিম হুজুর জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়কে ধারণ করেছে সেখানে জাতিগত আত্মপরিচয় অর্থাৎ বাঙালিত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সে। আর এর ফলে ইসলাম ও পাকিস্তান তার কাছে সমার্থক হয়ে উঠেছে। সেই পাকিস্তানকে রক্ষার জন্যে সে মাদ্রাসায় লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণও দেয়। পলিটিক্যাল ও স্প্রিচুয়াল ইসলামের পাশাপাশি চলচ্চিত্রে আরেক ধরনের প্রেক্ষাপট লক্ষ করা যায় আর তা হলো লৌকিক ইসলাম। এই অঞ্চলে সুফিদের আগমন ও ইসলাম প্রচারের প্রভাব সম্পর্কে সাহিত্যে ও ইতিহাসে যে বয়ান পাওয়া যায় তা লৌকিক ইসলামের প্রেক্ষাপট। তারেক মাসুদ আত্মপরিচয় প্রশ্নে চলচ্চিত্রে এই ধারাটিকেও তুলে ধরলেন। আর সেখানে হাজির হলো দুই বয়াতির মধ্যে পালাগানের লড়াই। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে তারেক মাসুদ আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করেছেন তার রূপটি আসলে কেমন? করিম বয়াতিকে দিয়ে এর উত্তরটি তিনি দিয়েছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মিলন ও করিম বয়াতির কথোপকথন:
করিম: ব্রিটিশরা যে কী এক খেলা আপনেগো মাতার মইদ্যে ঢুকাইয়া দিয়া গেল, বুঝি না। খেলা অবে এক ঘন্টা, বেশি অইলে দেড় ঘন্টা। পাঁচ-ছয়দিন ধইরা অনবরত! এইট্যা কোনো খেলা অইলো?
মিলন: করিম ভাই, আর খেলা নাই। খেলা সব শ্যাষ! ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট কমেন্টারি থামাইয়া ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিছে। ন্যাশনাল এসেম্বিলি বাতিল করছে। আমাগো আগেই বুঝা উচিত ছিল, আমরা বাঙালিরা যত ভোটেই জিতি না ক্যান, ঐ পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারিরা ক্ষমতা ছাড়বো না। ...মুক্তি সংগ্রাম ছাড়া বাঙালির আর কোনো পথই বুঝি খোলা থাকলো না!
করিম: রাজনীতিও একধরনের খেলা...। এই খেলায় আমার-আপনার কোনো লাব নাই। মানুষ যদি বুজতো তার আসল মুক্তি কোতায়!
মিলন: তুমি যে কী কও বয়াতি বাই! এই তোমাগো মতো ধর্মান্ধ লোকের জন্য দেশের এই অবস্থা।
করিম: কথাটা কী কইলেন, দর্মান্দ? হ, বুজছি! আসলে বুজলেন কি মিলন বাই, পরকিত কোনো দর্মই, তা ইন্দু হোক, ইসলাম হোক আর খেস্টান হোক, তা মানুষেকে অন্দ করে না। তার চক্ষুডা খুইলা দেয়।
করিম বয়াতির এই বয়ান খেয়াল করা দরকার। সকল ধর্মের অবস্থান উল্লেখ করে প্রকৃত ধর্মের যে ধারণা সে দিল, তাতে একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের কাঠামো হতে পারে। এতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু কারোরই প্রভাব নয় বরং ভাষা, ধর্ম কিংবা অপরাপর জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের বৈশিষ্ট্যগুলোর চেয়ে সবার মনে একজাতি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষাটাই প্রাধান্য পাবে।

তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-অঙ্গনে একটি বিশেষ নাম। যদিও তাঁর চলচ্চিত্র-জীবন সুদীর্ঘ হয়নি তবুও প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য মিলিয়ে মোট ১৯টি চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে তাঁকে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রথাগত চলচ্চিত্রের বাইরে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস ‘আদম সুরত’ (১৯৮৯), ‘মাটির ময়না’ (২০০২), ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬), ‘নরসুন্দর’ (২০০৯) ও ‘রানওয়ে’ (২০১০) বিশেষত্বের দাবি রাখে। তিনি মাটির ময়না চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের বয়ান কীভাবে সৃষ্টি করেছেন তা অন্বেষণ করাই এই আলোচনার লক্ষ্য। এবার সেদিকে যাওয়া যাক।
মাটির ময়না প্রসঙ্গে আলোচনা শুরুর পূর্বে ভারতীয় কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে একটু দৃষ্টি দেই। বিভূতিভূষণ নামটি বলার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মধ্যে যে ইমেজ আসে তা হলো ‘পথের পাঁচালী’। চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস থেকে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র। কী আছে এই উপন্যাসে? কিংবা পথের পাঁচালী উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পায়?
বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ তো ক্ষয়িষ্ণু এক ব্রাহ্মণ ও তার পুত্রের গল্প—যা মূলত ঔপনিবেশিক ভারতে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবির্ভাবের ফলে সৃষ্ট বাস্তবতা। এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন কী করে? ব্রাহ্মণ হরিহর ও তার বালক পুত্র অপুকে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে নতুন পথের দিকে নেয়। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যে আকাঙ্খার সন্ধানে তারা বের হয়ে যায়— তা কি আদৌ পূরণ হয়েছিল? ততদিনে ব্রাহ্মণ হরিহরের পৌরোহিত্য পুঁজি-প্রভাবিত কলকাতায় মোটামুটি অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে। এই যে বিভূতিভূষণ নিশ্চিন্দিপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি গ্রাম্যপরিবারকে ভিটেমাটির মায়া উপড়িয়ে নিয়ে এলেন, কেন করলেন এটা? আর সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র হিসেবে কেন-ই বা এই বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিলেন? বিভূতিভূষণ ও সত্যজিৎ উভয়েই একই বিষয়কে দেখাতে চেয়েছেন, আর তা হলো ঔপনিবেশিক ভারতের বাংলা। হরিহরের মৃত্যু একটি নির্দিষ্ট পেশার পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে তার পুত্র অপুর পূর্বপুরুষের পথে আর যাওয়া হয়নি। বলা যায়, সে অবস্থা ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সংকটে অপু তার ভিটেমাটিতে ফেরার জন্যে মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করেছে। কারণ নিশ্চিন্দিপুরের বাইরে অপু নিজেকে ‘আউটসাইডার’ হিসেবে দেখেছে, ফলে তার আত্মপরিচয় হলো গ্রামে ফেরার আকুতি। শেকড়ে ফেরার এই আকুতিটাই মূলত মানুষের আত্মপরিচয়ের তাগিদ থেকে উদ্ভুত। মানুষের জ্ঞান ও নির্জ্ঞান মন সর্বদা এই আকুতি অনুভব করে। যা বোধ করেছিল অডিসিয়ুস, তার রাজ্য ইথাকায় ফেরার জন্য। তারেক মাসুদ তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে এই আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন। মাটির ময়নার ক্ষেত্রে বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।
মাটির ময়নার চরিত্র চিত্রণে তারেক মাসুদ কি পথের পাঁচালী উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন? ধরা যাক,
দুর্গার মতো আসমার মৃত্যু হলো। অপুর মতো আনুও বোন হারিয়ে একাকিত্ব বোধ করল। কিন্তু এখানে একটি বড় পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ইংরেজ উপনিবেশে অপু পুরোহিত হওয়ার দীক্ষা নিয়েও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্কুলে যায়, আর সেই ইংরেজ উপনিবেশ খতম হওয়ার পর স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে আনু যায় কওমি মাদ্রাসায়। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে আনুর এই বিষয়টি খেয়াল করা দরকার। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আনু বাংলাভাষী অঞ্চলের মানুষ হওয়ায় তার আইডেনটিটি বাঙালি মুসলমান। কিন্তু ইংরেজ উপনিবেশে থাকার পরেও অপুকে বাঙালি হিন্দু আউডেনটিটি ধারণ করতে হয়নি। ফলে আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি ও মুসলমান এই দুইটি বিষয় কারও কারও মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর এই প্রকৃতির মানুষ হলো আনুর পিতা কাজী মাজহারুল ইসলাম। এই কাজী মাজহারুল ইসলামের সংকট কিংবা অভিপ্রায়টা বোঝা দরকার। তার সম্পর্কে চলচ্চিত্রে করিম বয়াতি বলেন, ‘কাজী সাব অবিশ্যি এমুন ছিল না। ইংরাজ সায়েব গো মতো কাপড়-চোপড় পরতো। হঠাৎ যে কী অইলো, দরবেশ অইয়া গেল। কী মানুষ কী অইয়া গেল! দাড়ি রাখলো, টুপি আলখেল্লা লাগাইলো। আর বউডার খেলা বন্দ। বাড়ির চাইরদিকে বেড়া দিয়া দিল। ঘরের মইদ্যেই বোরকা পরাইয়া রাখে। নতুন মুসলমান তো, কী কড়া! এহন তো তোমার বাপ অনেক নরম হইয়া গেছে।’

প্রশ্ন জাগে, কাজী মাজহারুল চরিত্রটির এরকম রূপান্তরের কারণ কী? আর তাকে ‘নতুন মুসলমান’ কী অর্থে বলা হলো? সে প্রসঙ্গে আসা যাবে। তার আগে বলা যাক হরিহরের কথা। হরিহর ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উত্থাপন হয়নি, কাজী মাজহারুলের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। প্রশ্নটা হলো ধর্ম বনাম কালচারের দ্বন্দ্ব উদ্ভূত-সংকটের কারণ খোঁজ করা দরকার। সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে কাজী মাজহারুলের মধ্যে এই সংকট কীভাবে আত্মপরিচেয়র সংকটের রূপ নিল তা দেখা দরকার। সে তার বাঙালি মুসলমানের বাঙালিত্বকে খারিজ করে শুধু মুসলমানি আত্মপরিচয় নির্ধারণ করতে চায়।
আর এই আত্মপরিচয়ের জন্য মুসলমানিত্বের যে সকল চিহ্ন ধারণ করা দরকার তা কট্টরভাবে পালন করে সে। আর এই বিষয়টিকে করিম বয়াতি বলে ‘নতুন মসুলমান’। তো এই নতুন মুসলমানের রাজনৈতিক ইতিহাসটা খেয়াল করা দরকার। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান আন্দোলন সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানেরা পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন ও প্রচারণা চালায়। এক্ষেত্রে তাঁদের আত্মপরিচয় মূলত একটি ধর্মীয় চেতনাকে কেন্দ্র করে একীভূত হয়। তো এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তানে কাজী মাজহারুল ইসলাম তার আত্মপরিচয়কে শুধুই মুসলমান হিসেবেই ধারণ করতে চায়। সেক্ষেত্রে তার কর্মে কঠোর মুসলমানিত্বের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বলা যায়, এটা ঔপনিবেশিক ভারতের দেওবন্দি প্রভাব। যারা একই সঙ্গে ইংরেজ-বিরোধিতা ও আলিগড়পন্থীদের বিরোধিতা জারি রাখে। দেওবন্দিরা ইংরেজ-বিরোধিতা করতে গিয়ে ইংরেজদের সবকিছুকে মুসলমানের জন্য হারাম ঘোষণা করে। আর কাজী মাজহারুল এই পন্থী ফলে তার পুত্র আনুকে কওমি মাদ্রাসায় পড়তে পাঠায়, অুসস্থ কন্যার জন্য এলোপ্যাথি চিকিৎসা না করে নিজেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেয়, স্ত্রীকে ঘরের ভেতরেও পর্দাবৃত করে রাখে, এমনকি ঘরের জানালা খোলাও নিষিদ্ধ থাকে।
কাজী মাজহারুলের মুসলমান আত্মপরিচয় নির্মাণের যে প্রচেষ্টা তা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী একটি রাষ্ট্র যখন উন্মেষের জন্য প্রক্রিয়াধীন তা কাজী মাজহারুল ও খান বাহাদুর চরিত্রটির চোখে একধরনের অরাজকাতা ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। খান বাহাদুর বলে, ‘সারা বঙ্গাল মুলুক জুড়ে কী অরাজকতা সৃষ্টি হইয়াছিল! এর সুরাহা কিন্তু মিছিল-মিটিংয়ে গুলি আর টিয়ারশেল চালাইয়া সম্ভব ছিল না, তার জন্য দরকার ছিল একটা আসল ওষুধ মার্শাল ল’। এখন দেখ সব কেমন ডান্ডার কাছে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ... কি, ঠিক বলি নাই কথাটা।’

বাংলাভাষী খান বাহাদুর ও কাজী মাজহারুলের এই পাকিস্তানপন্থা কি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা অর্থাৎ ইসলাম থেকে উদ্ভুত নাকি অন্য কিছু? বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সংগ্রাম চলচ্চিত্রে লক্ষ করা যায়, তাতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ জনগণই তো মুসলমান এবং পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের সক্রিয়তাও ছিল। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি ও মুসলমান এই দুয়ের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো? কাজী মাজহারুল চরিত্রটি ইসলমাকে পলিটিক্যাল টুলস হিসেবে ধরে তার আত্মপরিচয় ধারণ করতে চেয়েছে। এর ফলে তার কাছে ধর্ম ও কালচারের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তা আর থাকেনি। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মকে আইডেনটিটি হিসেবে ধরে তার জাতিভিত্তিক বাঙালি কালচারকে সে খারিজ করেছে।
ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্নকে সে ধারণ করেনি বা করতে চায়নি। তার কাছে জাতীয়তাবাদের আইডেনটিটি হয়ে উঠেছে ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি হত্যা শুরু করলে সে বলে, ‘শোনা কথায় বিশ্বাস করব না। ওরা আসছে ইসলাম রক্ষা করতে, শান্তি রক্ষা করতে। তো ওরা মানুষ মারবে ক্যান? মুসলমান মুসলমানকে মারবে ক্যান?’ অর্থাৎ পাকিস্তানি ও বাঙালি উভয়কে সে একই মুসলমান হিসেবে ধরে জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় দাড় করায়। কিন্তু তার সেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় টিকে না, যখন সে দেখে তার নিজের বাড়িও পাকিস্তানি সৈন্যরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ধর্মীয় আইডেনটিটি একই হওয়ার পরেও আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে যে বিভাজিত রূপ খেয়াল করা যায়, তাতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
চলচ্চিত্রে আত্মপরিচয়ের আরেক ধরনের প্রেক্ষাপট লক্ষ করা যায় পলিটিক্যাল ইসলামিস্ট ও স্প্রিচুয়াল ইসলামিস্ট ঘরানার মধ্যে। এক্ষেত্রে হালিম হুজুর ও ইব্রাহিম হুজুরের একটি কথোপকথন তুলে ধরা যাক:
ইব্রাহিম: ... এই দেশে ইসলাম তো তলোয়ার দি কায়েম অয় ন। আইত্যার ছাড়া বেশুমার সুফি দরবেশ সালাামত, এখওয়ানিয়ত আর হামদরদির দাওয়াত লই আতরাফ কওমের দরওয়াজার তুন দরওয়াজায় গুইচ্যেন। তলোয়ার দি ইরানি তুরানি রাজা বাদশা ওই হারে জমিন দখল কইচ্যে কিন্তু দিল দখল কইত্য হারে ন। ইসলামের খোশ আমদেদ এই নাঙা দিওয়ানা ফকির আউলিয়াগো লইয়া আইছে। সাচ্চা বাত অইলো, রাজনীতি কন আইত্যার কন, কোনো তাকাত দি উরফের তুন ইসলামের কায়েম করন সম্ভব ন। সহিহ্ দ্বীনি এলেমের দাবাত গরে গরে হৌচাই দেওনের মদ্যে ইসলামের কামিয়াবি হাসিল অইবো।
হালিম: আপনে বলতে চাইতেছেন দ্বীনি এলেমের তরক্কিই আমাদের একমাত্র কাজ হওয়া উচিৎ। সেরেফ এলেমের জন্য এলেম?
ইব্রাহিম: বেশাক ন। আমরা যা কইত্যাম আছি, হিয়ার মইদ্যে এলেম ন, আমলও আছে। চান চাই, আঙ্গো মাদ্রাসায় যারা ভর্তি অওনের লাই আইয়ে, এতিম পোলাপান তো আছেই, আর যে মা-বাপ হেতেনগো আওলাদেগোরে হড়ালেয়া তো দূরের কতা, খানাপিনারও ব্যবস্থা কইত্যে হারে না, হেগুনরেই মাদ্রাসায় হাডায়। হেগুনরে দেখভাল করি খাঁডি মোছলমান করি গড়ি তোলাই আঙ্গো বড় কাম, আঙ্গো বড় আমল। বুইজ্জেন নি কী কইলাম! হেগুনরে রাজনীতির ফেতনা-ফ্যাসাদে এস্তেমাল করা আঙ্গো ঠিক ন।
হালিম: কিন্তু কম্যুনিস্টপন্থীরা ধর্মনিরেপক্ষতার নামে যা শুরু করছে, তা ইসলামের জন্য খতরার কারণ হইয়া দাঁড়াইতেছে। এদের মোকাবিলা না করলি ক্যামনে চলবে?
ইব্রাহিম: তাহলে কম্যুনিস্ট আর রাজনীতি আলাগো লগে আঙ্গো ফারাকটা থাকলো কোনাই?
হালিম: লেকিন ইসলামকে রাজনীতি থেইকা আলাদা করবেন কীভাবে? অহন তো পাকিস্তানকে জারি রাখাই মুশকিল হয়ে পড়তেছে। পাকিস্তান যদি ভাইঙ্গা যায়, তবে এই অঞ্চলে ইসলামের অবস্থা খতরনাক হইয়া পড়বে।
ইব্রাহিম: আইচ্ছা হালিম মিয়া, আন্নে এককান কথা কন চাই, পাকিস্তান না থাকলে ইসলামের অবস্থা বেহাল অই যাইবো, ক্যামনে বুইজলেন? পাকিস্তান কি ইসলাম কায়েম কইচ্যে নাকি মিলিটারি হুকুমত কায়েম কইচ্যে?
উদ্ধৃতিতে দুই হুজুরের আলাপে মূলত পলিটিক্যাল ইসলামের সঙ্গে স্প্রিচুয়াল ইসলামের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরা হয়েছে। তো মজার ব্যাপারটা হলো ইব্রাহিম হুজুর বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সাপেক্ষে মাদ্রাসার ছাত্রদের পাঠদানের প্রেক্ষাপটকে যখন বর্ণনা করে, তখন হালিম হুজুর বলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কথা। সমকালীন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দুই জনই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের শাসন কাঠোমাতে বাংলাভাষী জনগণের আর্থিক ও সামাজিক যে দুর্দশা বিদ্যমান ছিল তাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। ইব্রাহিম হুজুরের উক্তিতে এই বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আর হালিম হুজুর বলে, পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামি রাজনীতির কথা। কারণ সে ইসলামকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সমর্থক। ফলে সে মনে করে, পাকিস্তান ভেঙে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠিত হলে সেখানে ইসলাম বিপন্ন হয়ে যাবে।
এই যে, ধর্মকে কেন্দ্র করে হালিম হুজুর জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়কে ধারণ করেছে সেখানে জাতিগত আত্মপরিচয় অর্থাৎ বাঙালিত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সে। আর এর ফলে ইসলাম ও পাকিস্তান তার কাছে সমার্থক হয়ে উঠেছে। সেই পাকিস্তানকে রক্ষার জন্যে সে মাদ্রাসায় লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণও দেয়। পলিটিক্যাল ও স্প্রিচুয়াল ইসলামের পাশাপাশি চলচ্চিত্রে আরেক ধরনের প্রেক্ষাপট লক্ষ করা যায় আর তা হলো লৌকিক ইসলাম। এই অঞ্চলে সুফিদের আগমন ও ইসলাম প্রচারের প্রভাব সম্পর্কে সাহিত্যে ও ইতিহাসে যে বয়ান পাওয়া যায় তা লৌকিক ইসলামের প্রেক্ষাপট। তারেক মাসুদ আত্মপরিচয় প্রশ্নে চলচ্চিত্রে এই ধারাটিকেও তুলে ধরলেন। আর সেখানে হাজির হলো দুই বয়াতির মধ্যে পালাগানের লড়াই। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে তারেক মাসুদ আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করেছেন তার রূপটি আসলে কেমন? করিম বয়াতিকে দিয়ে এর উত্তরটি তিনি দিয়েছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মিলন ও করিম বয়াতির কথোপকথন:
করিম: ব্রিটিশরা যে কী এক খেলা আপনেগো মাতার মইদ্যে ঢুকাইয়া দিয়া গেল, বুঝি না। খেলা অবে এক ঘন্টা, বেশি অইলে দেড় ঘন্টা। পাঁচ-ছয়দিন ধইরা অনবরত! এইট্যা কোনো খেলা অইলো?
মিলন: করিম ভাই, আর খেলা নাই। খেলা সব শ্যাষ! ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট কমেন্টারি থামাইয়া ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিছে। ন্যাশনাল এসেম্বিলি বাতিল করছে। আমাগো আগেই বুঝা উচিত ছিল, আমরা বাঙালিরা যত ভোটেই জিতি না ক্যান, ঐ পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারিরা ক্ষমতা ছাড়বো না। ...মুক্তি সংগ্রাম ছাড়া বাঙালির আর কোনো পথই বুঝি খোলা থাকলো না!
করিম: রাজনীতিও একধরনের খেলা...। এই খেলায় আমার-আপনার কোনো লাব নাই। মানুষ যদি বুজতো তার আসল মুক্তি কোতায়!
মিলন: তুমি যে কী কও বয়াতি বাই! এই তোমাগো মতো ধর্মান্ধ লোকের জন্য দেশের এই অবস্থা।
করিম: কথাটা কী কইলেন, দর্মান্দ? হ, বুজছি! আসলে বুজলেন কি মিলন বাই, পরকিত কোনো দর্মই, তা ইন্দু হোক, ইসলাম হোক আর খেস্টান হোক, তা মানুষেকে অন্দ করে না। তার চক্ষুডা খুইলা দেয়।
করিম বয়াতির এই বয়ান খেয়াল করা দরকার। সকল ধর্মের অবস্থান উল্লেখ করে প্রকৃত ধর্মের যে ধারণা সে দিল, তাতে একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের কাঠামো হতে পারে। এতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু কারোরই প্রভাব নয় বরং ভাষা, ধর্ম কিংবা অপরাপর জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের বৈশিষ্ট্যগুলোর চেয়ে সবার মনে একজাতি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষাটাই প্রাধান্য পাবে।

আজ ৮ ডিসেম্বর জন লেননের মৃত্যুদিন। দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড বিটলস-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য লেনন ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, লেখক ও শান্তিকর্মী। ‘ইমাজিন’ তাঁর বিখ্যাত গান। এই গানে তিনি কোন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন? কেন গানটি আজও এত প্রাসঙ্গিক?
৪ ঘণ্টা আগে
বর্তমান বিশ্বে সাহসী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁর নাম সবার আগে আসে, তিনি নোম চমস্কি। ৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। একদিকে তিনি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের স্থপতি, অন্যদিকে শোষিতের পক্ষে দাঁড়ানো এক অকুতোভয় যোদ্ধা। খুঁজে দেখা যাক আধুনিক সময়ের অন্যতম প্রধান চিন্তক ও জনবুদ্ধিজীবী নোম চমস্কির বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম।
৬ ঘণ্টা আগে
শুনতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। যদিও ইতিহাসের পাতায় কচুরিপানা নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে, কিন্তু কচুরিপানার অবদান অস্বীকার কোনো উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল বারুদ আর রক্তের ইতিহাস নয়। এটি ছিল বাংলার মাটি, জল ও প্রকৃতির এক সম্মিলিত সংগ্রাম।
৬ ঘণ্টা আগে
‘আমরা বর্ষার অপেক্ষায় আছি… তাঁরা পানিকে ভয় পায়, আর আমরা হচ্ছি জলের রাজা। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।’ নিউইয়র্ক টাইমসের খ্যাতিমান সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছিলেন এক বাঙালি অফিসার।
৬ ঘণ্টা আগে