নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা আমরা সবাই জানি; কিন্তু লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ‘গুডবাই সামার’ কনসার্টের কথা অনেকেরই অজানা।
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। লন্ডনের কেনিংটনে অবস্থিত বিখ্যাত ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ড। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন ও মানবিক সাহায্য সংগ্রহের এক অনন্য প্রয়াস ছিল ‘গুডবাই সামার’ নামের কনসার্টটি। এটির পোস্টার দেখলেই বোঝা যায়, সে সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের তরুণ সমাজ ও সংগীতপিপাসু মানুষ কীভাবে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এই কনসার্টটি মূলত বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত শরণার্থীদের সহায়তার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। পোস্টারের নান্দনিকতা ও বার্তা আজও ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেদিন ওভালের পরিবেশ ছিল অন্য রকম। কারণ, হাজার হাজার দর্শক কেবল গান শুনতেই সমবেত হয়েছিলেন এমন নয়; বরং একটি মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংহতি জানাতে এসেছিলেন তাঁরা। কনসার্টের প্রবেশমূল্য ধরা হয়েছিল মাত্র ১ দশমিক ২৫ পাউন্ড বা সোয়া এক পাউন্ড; যা আজকের দিনের বিবেচনায় অত্যন্ত নগণ্য মনে হতে পারে, কিন্তু সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এবং বিশেষ করে হাজার হাজার তরুণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে তহবিল গঠিত হয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অফিশিয়ালি ৩১ হাজার দর্শকের কথা বলা হলেও আয়োজকদের মতে, সেই সংখ্যাটা ৩৫ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এই বিশাল জনসমুদ্রের সামনে পারফর্ম করেছিলেন সেই সময়ের বাঘা বাঘা সব রক ব্যান্ড ও শিল্পীরা। যাঁদের মধ্যে ছিল দ্য হু, দ্য ফেসিস, অ্যাটমিক রুস্টার, মট দ্য হুপল, আমেরিকা ও লিন্ডিসফার্নের মতো কিংবদন্তি সব নাম। কনসার্টটির মূল উদ্দেশ্য পোস্টারেই খুব স্পষ্টভাবে লেখা ছিল—‘ইন এইড অব ফেমিন রিলিফ ফর বাংলাদেশ’ অর্থাৎ বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়ে সহায়তার জন্য।
‘গুডবাই সামার’ কনসার্টের কথা অনেকেরই অজানা। ছবি: সংগীতএকাত্তরে শুধু বুলেট আর বারুদ দিয়ে যুদ্ধ হয়নি, গিটারের ছয় তারেও বেজেছিল প্রতিরোধের সুর। কনসার্টের পরিবেশ ছিল অদ্ভুত রকমের জাদুকরী, যেখানে একদিকে রক সংগীতের উন্মাদনা আর অন্যদিকে হাজার মাইল দূরে থাকা এক অসহায় জনপদকে বাঁচানোর আকুতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। দ্য হু ব্যান্ডের পিট টাউনশেন্ড ও রজার ডালট্রি যখন মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন কিংবা রড স্টুয়ার্ট তাঁর ব্যান্ড দ্য ফেসিস নিয়ে মঞ্চে উঠে দর্শকদের দিকে ফুটবল কিক করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তখন সেই আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে ছিল একটি মহৎ উদ্দেশ্য। রড স্টুয়ার্টের সেই বিখ্যাত পারফরম্যান্সের সময় তিনি এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে মঞ্চে এক আনন্দঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যা রক ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। কিন্তু দিন শেষে সবাই জানত, তাঁদের এই উল্লাসের প্রতিটি পেনি পৌঁছে যাবে ভারতের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া ক্ষুধার্ত বাংলাদেশিদের কাছে।
কনসার্টটি থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ১৫ হাজার পাউন্ড। সে সময়ে এটি ছিল একটি বড় অঙ্কের অর্থ এবং এই অর্থ সরাসরি বাংলাদেশের শরণার্থীদের ত্রাণকার্যে ব্যয় করা হয়েছিল।
যদিও জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টের মতো এই আয়োজনটি ততটা ব্যাপক প্রচার পায়নি বা ইতিহাসের পাতায় ততটা উজ্জ্বলভাবে লিখিত হয়নি, তবুও এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম ছিল না। কারণ, এটি ছিল ব্রিটেনে সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে কনসার্টের পোস্টারটির দিকে তাকালে আজও গায়ে কাঁটা দেয়, যেখানে খুব সাধারণ গ্রাফিক্সের মাধ্যমে এক গভীর বার্তা তুলে ধরা হয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে শিল্প কীভাবে মানুষের বিপদে হাতিয়ার হতে পারে।
ওভালের সেই সবুজ ঘাসের ওপর বসে থাকা হাজারো দর্শক সেদিন হয়তো জানতেন না যে তাঁরা কেবল একটি কনসার্ট উপভোগ করছেন না, বরং তাঁরা অংশ নিচ্ছেন একটি নতুন দেশ জন্মের ইতিহাসে; যেখানে তাঁদের টিকিটের বিনিময়ে দেওয়া অর্থ হয়তো কোনো এক শিশুর মুখে খাবার তুলে দিয়েছে কিংবা কোনো এক অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
কনসার্টটির আয়োজন, ব্যবস্থাপনা এবং বিপুল জনসমাগম প্রমাণ করেছিল যে রাজনৈতিক সমীকরণের ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ মানুষ সব সময়ই নিপীড়িতের পক্ষে অবস্থান নেয়। যদিও আজ সেই কনসার্টের ভিডিও ফুটেজ বা অডিও রেকর্ডিং খুব একটা সহজলভ্য নয়, তবুও যাঁরা সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিচারণা এবং সেই আইকনিক পোস্টারটি আজও সাক্ষ্য দেয় যে একাত্তরের সেই বিকেলে লন্ডনবাসী কীভাবে বাংলাদেশের নাম হৃদয়ে ধারণ করেছিল।
জর্জ হ্যারিসনের পাশাপাশি ওভালের এই আয়োজকদের এবং অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের অবদানকেও আমাদের সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। কারণ, তাঁদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসই বিশ্বজনমতের এক বিশাল পাহাড় গড়ে তুলেছিল, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের বিজয়ের পথকে ত্বরান্বিত করেছিল। একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে যখন আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, তখন সুরের জাদুতে যাঁরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের সেই ঋণ কোনো দিন শোধ হওয়ার নয়; আর ওভালের ‘গুডবাই সামার’ কনসার্ট সেই ঋণেরই এক উজ্জ্বল স্মারক হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের ইতিহাসের ক্যানভাসে।