leadT1ad

‘ভাত দে’: ক্ষুধা যখন সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু

আজ ১৪ ডিসেম্বর। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক আমজাদ হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘ভাত দে’ এবং তাঁর রাজনৈতিক ও সমাজভাবনা নিয়ে এই বিশেষ লেখা।

ফাবিহা বিনতে হক
ফাবিহা বিনতে হক

স্ট্রিম গ্রাফিক

ক্ষুধা কিভাবে মানুষের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়, সেলুলয়েডের ফিতায় তার সবচেয়ে নির্মম দলিল আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া আমজাদ হোসেনের কালজয়ী সিনেমা ‘ভাত দে’ তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, দারিদ্র্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি এক চপেটাঘাত।

আমজাদ হোসেন এমন একজন পরিচালক ছিলেন, যিনি গ্রামবাংলার মাটির গন্ধ জানতেন। কিন্তু সেই গন্ধ রোমান্টিক ছিল না, ছিল শোষণের, ঘামের, ক্ষুধার। ‘ভাত দে’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন, পেটে ভাত না থাকলে সবকিছু অর্থহীন।

প্রেক্ষাপট ও নির্মাণের ভাবনা

‘ভাত দে’ সিনেমাটি যখন নির্মিত হয়, তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এক যুগের একটু বেশি। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ তখনও ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের দগদগে ঘা এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট। আমজাদ হোসেন তাঁর সিনেমাটি বানিয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের এক রূঢ় বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, দারিদ্র্য কীভাবে একটি শিল্পমনা পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।

বাউলরা গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেয়, কিন্তু দিনশেষে তাঁদের হাড়িতে ভাত জোটে না। এই সিনেমার ভাবনা অনেকাংশে কবি রফিক আজাদের সেই বিখ্যাত কবিতার স্পিরিটকে ধারণ করে, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো।’

ভাত দে সিনেমার দৃশ্য। ছবি: বাংলা মুভি ডেটাবেজ
ভাত দে সিনেমার দৃশ্য। ছবি: বাংলা মুভি ডেটাবেজ

যদিও সিনেমাটি সরাসরি কবিতাকে অনুসরণ করে নির্মিত হয়নি, তবে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্ষুধার হাহাকারই ছিল আমজাদ হোসেনের সিনেমার মূল প্রেক্ষাপট। তিনি চেয়েছিলেন এমন গল্প বলতে, যেখানে দর্শক বিনোদনের বদলে নিজেদের অস্তিত্বের সংকটকে পর্দায় দেখবে। তাই তো, এই বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র দেখে প্রেক্ষাগৃহে চোখ ভিজেছে ধনী-গরিব সকলেরই।

‘ভাত দে’ সিনেমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি: ক্ষুধার রাজনীতি

অর্থনীতি যে একটি সমাজকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মূলত তারই জলজ্যান্ত উদহারণ এঁকেছেন এই গুণী পরিচালক। যেমন সিনেমায় একজন অন্ধ বাউলের চরিত্র তিনি এনেছেন, যে গান গেয়ে বেড়ায়। কিন্তু সমাজ তাকে এবং তার মেয়েকে জরির চরিত্রে অভিনয় করা শাবানাকে ভিক্ষুকের চেয়ে বেশি সম্মান দেয় না। আমজাদ হোসেন এখানে খুব সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদী সমাজে শিল্পের কোনো মূল্য নেই যদি না তা বিক্রি করা যায়। ক্ষুধার কাছে হেরে গিয়ে বাউলকে তার শেষ সম্বল প্রিয় দোতারাটি বিক্রি করতে হয়। এটি কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র বিক্রি নয়, এটি হলো ক্ষুধার কাছে শিল্পের পরাজয়।

এছাড়া, সিনেমায় দেখা যায়, গ্রামের ধনী মহাজনরা বাউলের কন্যা জরিনাকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখে। এখানে পরিচালক দেখিয়েছেন, গরীবের পেটে ভাত নেই, কিন্তু ধনীর লালসার কোনো কমতি নেই। আমজাদ হোসেনের রাজনৈতিক দর্শন এখানে মার্কসবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ‘অর্থনীতিই সবকিছুর চালিকাশক্তি’। অর্থাৎ যার হাতে টাকা আছে, সমাজের যাবতীয় নিয়ম সে-ই বানায়।

১৯৮৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছিল ‘ভাত দে’। দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করে নেওয়া ‘ভাত দে’ সিনেমাটি মুক্তির বছর ‘সেরা সিনেমা’ হিসাবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিল। এ ছাড়া এটি নয়টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে নেয়। এক কথায় বলতে গেলে ‘ভাত দে’ হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি সিনেমা।

সিনেমার শেষের দিকে, জরিনা যখন পাগলের মতো চিৎকার করে বলে, ‘ভাত দে’, তখন সেই চিৎকার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে ছিল না। সেই চিৎকার ছিল সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। এটি ছিল এক ধরণের পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট। পরিচালক বোঝাতে চেয়েছেন, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের মুখে ভাত তুলে দিতে পারে না, সেখানে নৈতিকতা বা মূল্যবোধের কথা বলা বিলাসিতা।

সিনেমায় জরি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাবানা। তিনি যে কী অসাধারণ অভিনেত্রী এ সিনেমা তারই প্রমাণ। সিনেমায় তাঁর কান্না, ক্ষুধার তাড়নায় পাগলের বেশে ছুটে বেড়ানো, শক্ত হৃদয়েও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এদিকে সারাক্ষণ সুরেলা ভঙ্গিতে কথা বলা আলমগীর খুব যেন সুখী মানুষ, সমাজের কাঠিন্য কোনো কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না।

১৯৮৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছিল ‘ভাত দে’। দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করে নেওয়া ‘ভাত দে’ সিনেমাটি মুক্তির বছর ‘সেরা সিনেমা’ হিসাবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিল। এ ছাড়া এটি নয়টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে নেয়। এক কথায় বলতে গেলে ‘ভাত দে’ হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি সিনেমা।

আমজাদ হোসেন নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো খেয়াল করলে একটি প্যাটার্ন দেখা যায়। তিনি সবসময় প্রান্তিক মানুষের গল্প বলেছেন।

আমজাদ হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি ‘ভাত দে’ আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি শুধু বিনোদনের জন্য সিনেমা বানাননি, তিনি সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেছিলেন একটি জাতির ক্ষুধার্ত আর্তনাদ। ১৪ ডিসেম্বর, এই গুণী নির্মাতার প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত