অমিত বাপি বিশ্বাস

ফিলাডেলফিয়ার এক ধূলিমলিন সংবাদপত্রের দোকানে দাঁড়িয়ে দশ বছরের এক বালক গভীর মনোযোগে পড়ছে স্পেনের গৃহযুদ্ধের খবর। চারপাশে যখন মহামন্দার (গ্রেট ডিপ্রেশন) হাহাকার, তখন এই বালকের ভাবনায় খেলছে ফ্যাসিবাদের উত্থান আর মানুষের পরাধীনতার গ্লানি। সেই ১৯৩৮ সালে লেখা তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বিষয় ছিল বার্সেলোনার পতন। সেই যে শুরু, তারপর কেটে গেছে আট দশকেরও বেশি সময়। বালকটি বড় হয়েছে, বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে, কিন্তু তাঁর কলম থামেনি, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়নি।
তিনি আব্রাম নোম চমস্কি। ৯৭ বছর বয়সে পা রাখা এই মানুষটি আজ কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক, প্রখর সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী জনবুদ্ধিজীবী (পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল)। এমআইটির করিডর থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন, কিংবা অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট—সর্বত্রই তাঁর সরব উপস্থিতি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাঁকে বলেছিল, ‘সম্ভবত বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
১৯২৮ সালের ৭ ডিসেম্বর। আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় ইউক্রেনীয় ইহুদি অভিবাসী পরিবারে জন্ম নেন নোম । বাবা উইলিয়াম চমস্কি ছিলেন হিব্রু ভাষার পণ্ডিত, মা এলসি চমস্কি ছিলেন সমাজকর্মী। চমস্কির ধমনীতে বইছিল শিক্ষার প্রতি অনুরাগ। বাবার কাছে তিনি শিখেছিলেন ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের খুঁটিনাটি, যা পরবর্তীকালে তাঁর বৈপ্লবিক তত্ত্বের ভিত্তি গড়ে দেয়।

ছোটবেলা থেকেই চমস্কি ছিলেন একটু আলাদা ধরনের। যখন অন্য শিশুরা খেলাধুলায় মত্ত, চমস্কি তখন নিউইয়র্কে তাঁর চাচার বাসায় যেতেন। সেই চাচা ছিলেন বামপন্থী এবং তাঁর নিউজস্ট্যান্ডটি ছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার জায়গা। সেখানে বসেই চমস্কি শুনেছিলেন মার্ক্স, ফ্রয়েড আর রাজনীতির জটিল সব তত্ত্ব। মহামন্দার সেই দিনগুলোতে তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে গরিব মানুষ দরজায় কড়া নেড়ে এক টুকরো কাপড়ের বিনিময়ে খাবার চাইছে। এই দৃশ্যগুলো তাঁর মনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি এক স্থায়ী প্রশ্নের জন্ম দেয়।
তিনি ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে তাঁর মেন্টর ছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী জেলিগ হ্যারিস। হ্যারিস কেবল তাঁকে ভাষাবিজ্ঞান শেখাননি, শিখিয়েছিলেন কীভাবে প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হয়।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কথা। তখন মনোবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানের জগতে একচ্ছত্র দাপট ছিল ‘বিহেভিয়ারিজম’ বা আচরণবাদের। বিএফ স্কিনারের মতো পণ্ডিতরা মনে করতেন, মানুষের মন হলো একটি ‘খালি স্লেট’ (ব্লাঙ্ক স্লেট)। শিশু ভাষা শেখে পরিবেশ থেকে উদ্দীপনা ও অনুকরণ (স্টিমুলাস এন্ড রেসপন্স) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ, আমরা যা শুনি, ঠিক তাই শিখি।
১৯৫৭ সাল। মাত্র ২৯ বছর বয়সে নোম চমস্কি প্রকাশ করলেন তাঁর একশ বারো পৃষ্ঠার বই—‘সিনট্যাকটিক স্ট্রাকচারস’। আর তাতেই কেঁপে উঠল অ্যাকাডেমিক দুনিয়া। চমস্কি সম্পূর্ণ নতুন এক তত্ত্ব হাজির করলেন। তিনি বললেন, স্কিনার ভুল। ভাষা কেবল অনুকরণের বিষয় নয়।
চমস্কির মতে, প্রতিটি মানবশিশু মস্তিষ্কে একটি জন্মগত ‘ব্লু-প্রিন্ট’ বা ছক নিয়ে জন্মায়। তিনি এর নাম দিলেন ‘ইউনিভার্সাল গ্রামার’। তাঁর যুক্তি ছিল খুব সরল কিন্তু অকাট্য—একটি শিশু তাঁর বেড়ে ওঠার সময়ে এমন অনেক বাক্য বলে, যা সে আগে কখনো শোনেনি। যদি সে কেবল অনুকরণই করত, তবে এই নতুন বাক্য সে বানাল কীভাবে?
তিনি ধারণা দিলেন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন ডিভাইস’ (এলএডি)-এর। এটি মস্তিষ্কের এমন একটি কাল্পনিক যন্ত্র, যা শিশুকে যেকোনো ভাষা দ্রুত শিখতে সাহায্য করে। চমস্কি প্রমাণ করলেন, ভাষার মূল ভিত্তি শব্দ নয়, বরং বাক্যগঠনের নিয়ম বা সিনট্যাক্স। তাঁর বিখ্যাত উদাহরণ— ‘কালারলেস গ্রিন আইডিয়াস স্লিপ ফিউরিয়াসলি’ (বর্ণহীন সবুজ ধারণাগুলো প্রচণ্ডভাবে ঘুমায়)। এই বাক্যটির কোনো অর্থ নেই, কিন্তু ব্যাকরণগতভাবে এটি সম্পূর্ণ শুদ্ধ। এর মাধ্যমে তিনি দেখালেন, ভাষা ও অর্থ সব সময় এক নয়; মস্তিষ্কের গঠনের মধ্যেই ব্যাকরণের বীজ বোনা থাকে।
এই তত্ত্বটিকে বলা হয় ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ বা সৃজনশীল ব্যাকরণ। এটি কেবল ভাষাবিজ্ঞান নয়, বদলে দিল সাইকোলজি, ফিলোসফি এবং কম্পিউটার সায়েন্সের গতিপথ। আজকের যুগে আমরা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই, সিরি বা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছি—তার তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন নোম চমস্কি। যদিও বর্তমানের ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ (এলএলএম) যেভাবে কাজ করে (পরিসংখ্যান ও ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে), চমস্কি তার সমালোচনা করেছেন, তবুও তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করেই কম্পিউটার মানুষের ভাষা বুঝতে শিখেছে।
এমআইটি-র নিরাপদ এবং সম্মানজনক অধ্যাপনা জীবন বেছে নিলে চমস্কি হয়তো শান্তিতে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন কণ্টকাকীর্ণ পথ। ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকা তখন ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আমেরিকার মূলধারার মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরা তখন সরকারের গুণগানে ব্যস্ত।

চমস্কি আর চুপ থাকতে পারলেন না। ১৯৬৭ সালে ‘নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’-এ প্রকাশিত হলো তাঁর সেই বিস্ফোরক প্রবন্ধ—‘দ্য রেসপন্সিবিলিটি অব ইন্টেলেকচুয়ালস’ (বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা)।
তিনি লিখলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হলো সত্য বলা এবং মিথ্যাকে উন্মোচন করা।’ তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুললেন, যারা সরকারের নীতি নির্ধারক, সেই তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ’রা কি আসলেই সত্য বলছেন, নাকি ক্ষমতার সেবা করছেন? ভিয়েতনাম যুদ্ধকে তিনি অনৈতিক ও অপরাধমূলক বলে আখ্যায়িত করলেন।
এর ফলাফল হলো ভয়াবহ। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাঁর নাম তুলে দিলেন ‘শত্রুর তালিকায়’ (এনিমি’স লিস্ট)। চমস্কি জানতেন, যেকোনো সময় তাঁকে দীর্ঘমেয়াদে জেলে যেতে হতে পারে। এমনকি তাঁর স্ত্রী যাতে বিপদে না পড়েন, সেজন্য তিনি এমআইটিতে তাঁর এক বন্ধুর কাছে নিজের পিএইচডি ডিগ্রিটি বিক্রির ব্যবস্থা করে রাখার কথা ভেবেছিলেন, যাতে তাঁর পরিবারের আর্থিক সংস্থান হয়। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। পেন্টাগন পেপারস ফাঁস হওয়ার পর দেখা গেল, চমস্কি যা বলেছিলেন, সেই প্রতিটি শব্দ সত্য।
সাধারণ মানুষের ধারণা, আমরা সংবাদপত্রে যা পড়ি বা টিভিতে যা দেখি, তা নিরপেক্ষ। ১৯৮৮ সালে এডওয়ার্ড এস. হারম্যানের সঙ্গে লেখা ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাস মিডিয়া’ বইটিতে চমস্কি এই ধারণাকে চুরমার করে দেন।
তিনি উপস্থাপন করলেন ‘প্রপাগান্ডা মডেল’। তিনি দেখালেন, গণতান্ত্রিক দেশে সরকার জোর করে মানুষের মুখ বন্ধ করে না, বরং মিডিয়ার মাধ্যমে এমনভাবে তথ্য পরিবেশন করে যে মানুষ নিজে থেকেই সরকারের বা কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে কথা বলতে শুরু করে। একেই তিনি বললেন ‘সম্মতি উৎপাদন’ (ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট)। আজকের ফেইক নিউজ আর করপোরেট মিডিয়ার যুগে চমস্কির এই বিশ্লেষণ যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, একুশ শতকে এসে চমস্কির প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?
আজ যখন গাজায় মানবিক বিপর্যয় চলছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ থামছে না, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের কিনারে দাঁড়িয়ে—তখন চমস্কির বিশ্লেষণ আমাদের প্রকৃত সত্য বুঝতে সাহায্য করে। তিনি বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, মানবজাতি দুটি অস্তিত্বসংকটের মুখোমুখি— পারমাণবিক যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। তাঁর এই সতর্কবাণী আজ নির্মম সত্য হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন ‘কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করতে’ (কোশ্চেন অথরিটি)। তিনি বলেন, ক্ষমতা কখনোই নিজে থেকে বৈধতা পায় না। রাষ্ট্র, পুলিশ বা প্রতিষ্ঠান—যেই হোক না কেন, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তাদের ক্ষমতা ব্যবহারের যৌক্তিকতা আছে। যদি তারা তা প্রমাণ করতে না পারে, তবে সেই ক্ষমতা ছুঁড়ে ফেলা উচিত। চমস্কি নিজেকে ‘লিবার্টারিয়ান সোস্যালিস্ট’ বা মুক্তিকামী সমাজতন্ত্রী বলেন, যিনি বিশ্বাস করেন মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো স্বাধীনতা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতি যুগে এমন কিছু মানুষ আসেন যারা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটেন। গ্যালিলিও, রাসেল কিংবা সার্ত্রের মতো নোম চমস্কিও সেই দলের। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ভাষা কেবল যোগাযোগেরমাধ্যম নয়, এটি আমাদের মানবসত্তার পরিচয়। আবার তিনি এটাও শিখিয়েছেন, নীরবতা কোনো বিকল্প নয়; অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাই মানুষের ধর্ম।
‘ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং’ ও ‘দ্য কনভারসেশন’-এর মতো আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলো তাঁকে আখ্যায়িত করেছে এক ‘অপূরণীয় শূন্যতা’ হিসেবে, যা তিনি চলে গেলে তৈরি হবে। কিন্তু চমস্কি তো কেবল রক্ত-মাংসের মানুষ নন, তিনি একটি আদর্শের নাম।
নোম চমস্কি হয়তো চিরকাল বেঁচে থাকবেন না, কিন্তু যতদিন পৃথিবীতে ভাষা থাকবে, যতদিন মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থাকবে এবং যতদিন কেউ না কেউ ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য কথাটি বলে দেবে— ততদিন নোম চমস্কি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন। তাঁর জীবন আমাদের বলে যায়—সত্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ হতে পারে, কিন্তু সে পথে হাঁটাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।
তথ্যসূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং ও দ্য কনভারসেশন

ফিলাডেলফিয়ার এক ধূলিমলিন সংবাদপত্রের দোকানে দাঁড়িয়ে দশ বছরের এক বালক গভীর মনোযোগে পড়ছে স্পেনের গৃহযুদ্ধের খবর। চারপাশে যখন মহামন্দার (গ্রেট ডিপ্রেশন) হাহাকার, তখন এই বালকের ভাবনায় খেলছে ফ্যাসিবাদের উত্থান আর মানুষের পরাধীনতার গ্লানি। সেই ১৯৩৮ সালে লেখা তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বিষয় ছিল বার্সেলোনার পতন। সেই যে শুরু, তারপর কেটে গেছে আট দশকেরও বেশি সময়। বালকটি বড় হয়েছে, বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে, কিন্তু তাঁর কলম থামেনি, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়নি।
তিনি আব্রাম নোম চমস্কি। ৯৭ বছর বয়সে পা রাখা এই মানুষটি আজ কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক, প্রখর সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী জনবুদ্ধিজীবী (পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল)। এমআইটির করিডর থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন, কিংবা অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট—সর্বত্রই তাঁর সরব উপস্থিতি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাঁকে বলেছিল, ‘সম্ভবত বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
১৯২৮ সালের ৭ ডিসেম্বর। আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় ইউক্রেনীয় ইহুদি অভিবাসী পরিবারে জন্ম নেন নোম । বাবা উইলিয়াম চমস্কি ছিলেন হিব্রু ভাষার পণ্ডিত, মা এলসি চমস্কি ছিলেন সমাজকর্মী। চমস্কির ধমনীতে বইছিল শিক্ষার প্রতি অনুরাগ। বাবার কাছে তিনি শিখেছিলেন ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের খুঁটিনাটি, যা পরবর্তীকালে তাঁর বৈপ্লবিক তত্ত্বের ভিত্তি গড়ে দেয়।

ছোটবেলা থেকেই চমস্কি ছিলেন একটু আলাদা ধরনের। যখন অন্য শিশুরা খেলাধুলায় মত্ত, চমস্কি তখন নিউইয়র্কে তাঁর চাচার বাসায় যেতেন। সেই চাচা ছিলেন বামপন্থী এবং তাঁর নিউজস্ট্যান্ডটি ছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার জায়গা। সেখানে বসেই চমস্কি শুনেছিলেন মার্ক্স, ফ্রয়েড আর রাজনীতির জটিল সব তত্ত্ব। মহামন্দার সেই দিনগুলোতে তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে গরিব মানুষ দরজায় কড়া নেড়ে এক টুকরো কাপড়ের বিনিময়ে খাবার চাইছে। এই দৃশ্যগুলো তাঁর মনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি এক স্থায়ী প্রশ্নের জন্ম দেয়।
তিনি ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে তাঁর মেন্টর ছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী জেলিগ হ্যারিস। হ্যারিস কেবল তাঁকে ভাষাবিজ্ঞান শেখাননি, শিখিয়েছিলেন কীভাবে প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হয়।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কথা। তখন মনোবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানের জগতে একচ্ছত্র দাপট ছিল ‘বিহেভিয়ারিজম’ বা আচরণবাদের। বিএফ স্কিনারের মতো পণ্ডিতরা মনে করতেন, মানুষের মন হলো একটি ‘খালি স্লেট’ (ব্লাঙ্ক স্লেট)। শিশু ভাষা শেখে পরিবেশ থেকে উদ্দীপনা ও অনুকরণ (স্টিমুলাস এন্ড রেসপন্স) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ, আমরা যা শুনি, ঠিক তাই শিখি।
১৯৫৭ সাল। মাত্র ২৯ বছর বয়সে নোম চমস্কি প্রকাশ করলেন তাঁর একশ বারো পৃষ্ঠার বই—‘সিনট্যাকটিক স্ট্রাকচারস’। আর তাতেই কেঁপে উঠল অ্যাকাডেমিক দুনিয়া। চমস্কি সম্পূর্ণ নতুন এক তত্ত্ব হাজির করলেন। তিনি বললেন, স্কিনার ভুল। ভাষা কেবল অনুকরণের বিষয় নয়।
চমস্কির মতে, প্রতিটি মানবশিশু মস্তিষ্কে একটি জন্মগত ‘ব্লু-প্রিন্ট’ বা ছক নিয়ে জন্মায়। তিনি এর নাম দিলেন ‘ইউনিভার্সাল গ্রামার’। তাঁর যুক্তি ছিল খুব সরল কিন্তু অকাট্য—একটি শিশু তাঁর বেড়ে ওঠার সময়ে এমন অনেক বাক্য বলে, যা সে আগে কখনো শোনেনি। যদি সে কেবল অনুকরণই করত, তবে এই নতুন বাক্য সে বানাল কীভাবে?
তিনি ধারণা দিলেন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন ডিভাইস’ (এলএডি)-এর। এটি মস্তিষ্কের এমন একটি কাল্পনিক যন্ত্র, যা শিশুকে যেকোনো ভাষা দ্রুত শিখতে সাহায্য করে। চমস্কি প্রমাণ করলেন, ভাষার মূল ভিত্তি শব্দ নয়, বরং বাক্যগঠনের নিয়ম বা সিনট্যাক্স। তাঁর বিখ্যাত উদাহরণ— ‘কালারলেস গ্রিন আইডিয়াস স্লিপ ফিউরিয়াসলি’ (বর্ণহীন সবুজ ধারণাগুলো প্রচণ্ডভাবে ঘুমায়)। এই বাক্যটির কোনো অর্থ নেই, কিন্তু ব্যাকরণগতভাবে এটি সম্পূর্ণ শুদ্ধ। এর মাধ্যমে তিনি দেখালেন, ভাষা ও অর্থ সব সময় এক নয়; মস্তিষ্কের গঠনের মধ্যেই ব্যাকরণের বীজ বোনা থাকে।
এই তত্ত্বটিকে বলা হয় ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ বা সৃজনশীল ব্যাকরণ। এটি কেবল ভাষাবিজ্ঞান নয়, বদলে দিল সাইকোলজি, ফিলোসফি এবং কম্পিউটার সায়েন্সের গতিপথ। আজকের যুগে আমরা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই, সিরি বা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছি—তার তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন নোম চমস্কি। যদিও বর্তমানের ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ (এলএলএম) যেভাবে কাজ করে (পরিসংখ্যান ও ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে), চমস্কি তার সমালোচনা করেছেন, তবুও তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করেই কম্পিউটার মানুষের ভাষা বুঝতে শিখেছে।
এমআইটি-র নিরাপদ এবং সম্মানজনক অধ্যাপনা জীবন বেছে নিলে চমস্কি হয়তো শান্তিতে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন কণ্টকাকীর্ণ পথ। ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকা তখন ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আমেরিকার মূলধারার মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরা তখন সরকারের গুণগানে ব্যস্ত।

চমস্কি আর চুপ থাকতে পারলেন না। ১৯৬৭ সালে ‘নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’-এ প্রকাশিত হলো তাঁর সেই বিস্ফোরক প্রবন্ধ—‘দ্য রেসপন্সিবিলিটি অব ইন্টেলেকচুয়ালস’ (বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা)।
তিনি লিখলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হলো সত্য বলা এবং মিথ্যাকে উন্মোচন করা।’ তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুললেন, যারা সরকারের নীতি নির্ধারক, সেই তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ’রা কি আসলেই সত্য বলছেন, নাকি ক্ষমতার সেবা করছেন? ভিয়েতনাম যুদ্ধকে তিনি অনৈতিক ও অপরাধমূলক বলে আখ্যায়িত করলেন।
এর ফলাফল হলো ভয়াবহ। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাঁর নাম তুলে দিলেন ‘শত্রুর তালিকায়’ (এনিমি’স লিস্ট)। চমস্কি জানতেন, যেকোনো সময় তাঁকে দীর্ঘমেয়াদে জেলে যেতে হতে পারে। এমনকি তাঁর স্ত্রী যাতে বিপদে না পড়েন, সেজন্য তিনি এমআইটিতে তাঁর এক বন্ধুর কাছে নিজের পিএইচডি ডিগ্রিটি বিক্রির ব্যবস্থা করে রাখার কথা ভেবেছিলেন, যাতে তাঁর পরিবারের আর্থিক সংস্থান হয়। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। পেন্টাগন পেপারস ফাঁস হওয়ার পর দেখা গেল, চমস্কি যা বলেছিলেন, সেই প্রতিটি শব্দ সত্য।
সাধারণ মানুষের ধারণা, আমরা সংবাদপত্রে যা পড়ি বা টিভিতে যা দেখি, তা নিরপেক্ষ। ১৯৮৮ সালে এডওয়ার্ড এস. হারম্যানের সঙ্গে লেখা ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাস মিডিয়া’ বইটিতে চমস্কি এই ধারণাকে চুরমার করে দেন।
তিনি উপস্থাপন করলেন ‘প্রপাগান্ডা মডেল’। তিনি দেখালেন, গণতান্ত্রিক দেশে সরকার জোর করে মানুষের মুখ বন্ধ করে না, বরং মিডিয়ার মাধ্যমে এমনভাবে তথ্য পরিবেশন করে যে মানুষ নিজে থেকেই সরকারের বা কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে কথা বলতে শুরু করে। একেই তিনি বললেন ‘সম্মতি উৎপাদন’ (ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট)। আজকের ফেইক নিউজ আর করপোরেট মিডিয়ার যুগে চমস্কির এই বিশ্লেষণ যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, একুশ শতকে এসে চমস্কির প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?
আজ যখন গাজায় মানবিক বিপর্যয় চলছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ থামছে না, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের কিনারে দাঁড়িয়ে—তখন চমস্কির বিশ্লেষণ আমাদের প্রকৃত সত্য বুঝতে সাহায্য করে। তিনি বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, মানবজাতি দুটি অস্তিত্বসংকটের মুখোমুখি— পারমাণবিক যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। তাঁর এই সতর্কবাণী আজ নির্মম সত্য হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন ‘কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করতে’ (কোশ্চেন অথরিটি)। তিনি বলেন, ক্ষমতা কখনোই নিজে থেকে বৈধতা পায় না। রাষ্ট্র, পুলিশ বা প্রতিষ্ঠান—যেই হোক না কেন, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তাদের ক্ষমতা ব্যবহারের যৌক্তিকতা আছে। যদি তারা তা প্রমাণ করতে না পারে, তবে সেই ক্ষমতা ছুঁড়ে ফেলা উচিত। চমস্কি নিজেকে ‘লিবার্টারিয়ান সোস্যালিস্ট’ বা মুক্তিকামী সমাজতন্ত্রী বলেন, যিনি বিশ্বাস করেন মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো স্বাধীনতা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতি যুগে এমন কিছু মানুষ আসেন যারা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটেন। গ্যালিলিও, রাসেল কিংবা সার্ত্রের মতো নোম চমস্কিও সেই দলের। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ভাষা কেবল যোগাযোগেরমাধ্যম নয়, এটি আমাদের মানবসত্তার পরিচয়। আবার তিনি এটাও শিখিয়েছেন, নীরবতা কোনো বিকল্প নয়; অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাই মানুষের ধর্ম।
‘ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং’ ও ‘দ্য কনভারসেশন’-এর মতো আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলো তাঁকে আখ্যায়িত করেছে এক ‘অপূরণীয় শূন্যতা’ হিসেবে, যা তিনি চলে গেলে তৈরি হবে। কিন্তু চমস্কি তো কেবল রক্ত-মাংসের মানুষ নন, তিনি একটি আদর্শের নাম।
নোম চমস্কি হয়তো চিরকাল বেঁচে থাকবেন না, কিন্তু যতদিন পৃথিবীতে ভাষা থাকবে, যতদিন মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থাকবে এবং যতদিন কেউ না কেউ ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য কথাটি বলে দেবে— ততদিন নোম চমস্কি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন। তাঁর জীবন আমাদের বলে যায়—সত্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ হতে পারে, কিন্তু সে পথে হাঁটাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।
তথ্যসূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং ও দ্য কনভারসেশন

আজ ৮ ডিসেম্বর জন লেননের মৃত্যুদিন। দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড বিটলস-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য লেনন ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, লেখক ও শান্তিকর্মী। ‘ইমাজিন’ তাঁর বিখ্যাত গান। এই গানে তিনি কোন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন? কেন গানটি আজও এত প্রাসঙ্গিক?
১ ঘণ্টা আগে
শুনতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। যদিও ইতিহাসের পাতায় কচুরিপানা নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে, কিন্তু কচুরিপানার অবদান অস্বীকার কোনো উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল বারুদ আর রক্তের ইতিহাস নয়। এটি ছিল বাংলার মাটি, জল ও প্রকৃতির এক সম্মিলিত সংগ্রাম।
৩ ঘণ্টা আগে
‘আমরা বর্ষার অপেক্ষায় আছি… তাঁরা পানিকে ভয় পায়, আর আমরা হচ্ছি জলের রাজা। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।’ নিউইয়র্ক টাইমসের খ্যাতিমান সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছিলেন এক বাঙালি অফিসার।
৩ ঘণ্টা আগে
কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের দুটি জরাজীর্ণ বোটকে মডিফাই করে বানানো হয় ‘বিএনএস পদ্ম’ ও ‘বিএনএস পলাশ’। এতে বসানো হয় বিমানবিধ্বংসী কামান। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনায় এই গানবোট দুটির ওপর ভুলবশত মিত্রবাহিনী বিমান হামলা চালায়।
৭ ঘণ্টা আগে