leadT1ad

দুই হাত দিয়ে গুলির ক্ষত চেপে ধরে জানালেন, ‘শত্রুরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে’

সুমন সুবহান
সুমন সুবহান

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৯
পাকিস্তানি সৈনিকদের আত্মসমর্পণের দৃশ্য। সংগৃহীত ছবি

তারিখ: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

স্থান: হেমায়েতপুর সেতু, ঢাকা-মিরপুর সড়ক।

সময়: সকাল ০৮:৩০।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোন-এর কমান্ডার মেজর জেনারেল গান্ধর্ব সিং নাগরা আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী (কমান্ডার, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড) ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মিতে কোর্সমেট ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে কমিশন পেয়েছিলেন আর বন্ধু ছিলেন। জেনারেল নাগরা জেনারেল নিয়াজিকে ‘আবদুল্লাহ’ বলে ডাকতেন। ভাগ্যের পরিহাসে ১৯৭১ সালে দুই বন্ধু দুই শিবিরে, একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। একজন পরাজিত আর অন্যজন কিছুক্ষণের মধ্যে বিজয়ীর বেশে ঢাকা শহরে ঢুকবেন। সকাল সাড়ে আটটায় মেজর জেনারেল নাগরা জীপের বনেটে এক টুকরো কাগজ রেখে জেনারেল নিয়াজীকে একটা চিরকুট লিখলেন,

প্রিয় আবদুল্লাহ,
আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেল্কি খতম হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মত আত্মসমর্পণ করো। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভো কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি, আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া হবে।
তোমারই
মেজর জেনারেল নাগরা

জেনারেল নাগরার এডিসি, ২ প্যারা ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুটেন্ট এবং একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ চারজন দুইটি জীপে সাদা পতাকা না থাকায় একটি সাদা জামা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা লেখা চিরকুটটা নিয়ে শত্রু-অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর দিকে ছুটলেন।

তারিখ: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

স্থান: ঢাকা সেনানিবাস।

সময়: সকাল ৯:০০।

চিরকুটটা যখন জেনারেল নিয়াজির হাতে পৌঁছে, তখন তাঁর পাশে মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং রিয়ার এডমিরাল শরীফ। জেনারেল ফরমান চিরকুটের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিনিই কি (নাগরা) আলোচক দল? জেনারেল নিয়াজী কোন মন্তব্য করলেন না। স্পষ্ট প্রশ্ন তখন এটাই, তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, না মোকাবেলা করা হবে। মেজর জেনারেল ফরমান জেনারেল নিয়াজীকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোন রিজার্ভ বাহিনী আছে কি?

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি

জেনারেল নিয়াজী এবারো কিছু বললেন না। রিয়ার এডমিরাল শরীফ একই প্রশ্ন পাঞ্জাবী ভাষায় রিপিট করলেন, কুজ পাল্লে হ্যায়? জেনারেল নিয়াজি জেনারেল জামশেদের দিকে তাকালেন। ইষ্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ডিজি মেজর জেনারেল জামশেদ তাঁর বাহিনী নিয়ে ঢাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। জেনারেল জামশেদ মুখে কিছু বললেন না, শুধু মাথা এদিক-ওদিক নাড়ালেন, যার অর্থ হলো, কিছুই নেই শূন্য। জেনারেল রাও ফরমান এবং রিয়ার এডমিরাল শরিফ তখন জেনারেল নিয়াজিকে বললেন, যদি এই-ই হয় তাহলে যান, যা সে (নাগরা) করতে বলে, করেন গিয়ে।

লে. জেনারেল নিয়াজি মেজর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাতে মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন।

তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।

স্থান: ঢাকা-মিরপুর সড়ক।

সময়: সকাল ০৯:৩০।

এডিসি’কে পাঠানোর এক ঘণ্টা পর মিরপুর সেতুর দিক থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসা গাড়ির গর্জন শুনে যৌথবাহিনীর সৈনিকেরা উত্কণ্ঠিত হয়ে উঠেছিল। পরক্ষণেই মাটি কাঁপিয়ে কয়েক ঝাঁক গুলির শব্দ শোনা গেল। চার-পাঁচটি মেশিনগান একসঙ্গে বিকট শব্দে গর্জে উঠে থেমে যায়। হঠাৎ ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর আবারো থমথমে নীরবতা। যৌথবাহিনীর ভুল ভাঙলে দেখা যায় গাড়ি দুটি শত্রুর নয়, যৌথবাহিনীর গাড়ি দুটিই ফিরে আসছিল। গাড়ির ওপর সাদা পতাকা বা কাপড় না থাকায় শত্রুরা ধেয়ে আসছে ভেবে যৌথবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের সৈন্যরা তাদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে।

প্রতিনিধিদল নিয়াজির কাছে নাগরার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পর নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি বলে জানিয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে জেনে আনন্দে উদ্বেলিত প্রতিনিধি দল নিজেদের কমান্ডারের কাছে এই দারুণ সুখবরটি পৌঁছে দিতে দ্রুত বেগে ছুটে আসছিল। আসার পথে অসাবধানতাবশত গাড়িতে লটকানো সাদা জামাটি কখন যে প্রচণ্ড বাতাসে উড়ে গেছে তা তাঁরা জানতেই পারে নি। তাই এই বিভ্রাট। যৌথবাহিনী আমিন বাজার স্কুলের পাশে দৌড়ে গিয়ে দেখল, দুটি জীপই বিকল হয়ে থেমে আছে। একটাতে তিন জনের মৃতদেহ। রক্তে সমস্ত জীপটা ভেসে গিয়েছে। তখনও তাদের শরীর থেকে রক্ত চুয়ে পড়ছে।

আহত অবস্থায় একজন তখনও জীপের স্টিয়ারিং ধরে বসে ছিলেন, তার হাঁটুর নিচের অংশ বুলেট বিদ্ধ হয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল। দারুণ সুখবরটি যত তাড়াতাড়ি দিতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি যেন সহযোদ্ধা হারানোর দুঃখ এবং গুলিতে আহত হওয়ার নিদারুণ যন্ত্রণার উপশম ঘটবে। তিনি তাঁর ক্ষতস্থান দু’হাতে চেপে ধরে গলার স্বর জড়িয়ে আসা সত্ত্বেও যতদূর সম্ভব স্পষ্টভাবে প্রত্যয় মেশানো কণ্ঠে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘শত্রুরা, আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। তাঁদের দিক থেকে এখনই কোনো একজন জেনারেল আত্মসমর্পণের প্রথম পর্ব সারতে আসছেন।’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েকঘন্টা আগে মিরপুরে কয়েক হাজার বছর আগের ইতিহাস যেন ভিন্ন প্রেক্ষিত এবং পটভূমিতে সেদিন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। এ যেন মিরপুর নয়, মিরপুর সেদিন যেন প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগরী। ঢাকা-মিরপুর সড়কে সেদিন এথেন্স নগরীর এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। ঘটনাটা জানতে ফিরে যাই খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালের আগস্ট/সেপ্টেম্বর মাসের দিকে, এথেন্স-এর সঙ্গে ম্যারাথনের ময়দানে সেসময়ে পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী পার্সিয়ান সেনাদের মাঝে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংখ্যালঘু এথেন্সবাসী, শক্তিশালী, ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পার্সিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারছিল না। এরকম অবস্থায় শক্তিশালী সামরিক নগরী স্পার্টার কাছ থেকে সহযোগিতা লাভের জন্য ম্যারাথন শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত দুর্গ থেকে বার্তাবাহক হিসেবে ফেইডিপ্পিডেস’কে পাঠানো হয়। টানা দেড় দিন টানা দৌড়ে ফেইডিপ্পিডেস স্পার্টায় পৌঁছলেও স্পার্টানদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে হতাশার সঙ্গে ম্যারাথনে ফিরে আসেন।

কিন্তু এসেই শুনতে পান, বিশাল পার্সিয়ান সৈন্যদলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ম্যারাথনের যোদ্ধারা বড় জয় নিশ্চিত করেছে। এই সংবাদ এথেন্সে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফেইডিপ্পিডেসকে আবারও রাস্তায় নামতে হয়। তিনি ম্যারাথনের যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রায় ২৬ মাইল একটানা দৌড়ে এথেন্স নগরীর কেন্দ্রে পৌঁছান এবং ‘নানিকাক্যাম্যান’ বা ‘আমরা বিজয়ী হয়েছি’ বলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ম্যারাথন থেকে এথেন্স নয়, ঢাকা থেকে মিরপুরে গুলিবিদ্ধ যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের দ্রুত নিঃশেষিত শক্তি শেষবারের মতো জড়ো করে পূর্ণ বিজয়ের দারুণ সংবাদ দিলেন এ যুগের বীর সেনানী, এই শতাব্দীর ফেইডিপ্পিডেস। নাম না জানা এই বীর সেনাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

বিষয়:

Ad 300x250

সম্পর্কিত