আমরা শহরে বসবাস করতে গিয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। কংক্রিটের দেয়াল, লোহার গ্রিল আর যান্ত্রিক জীবনের ভিড়ে শ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকুও যেন সংকুচিত হয়ে এসেছে। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে রাজশাহীর সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা আহমুদুর রহমান সুজনের ছাদবাগান আমাদের কাছে এক বিকল্প জীবনের প্রস্তাব।
আমরা দেখতে পাই যে শহরের ছাদ মানেই আজকাল অব্যবহৃত জায়গা বা অগোছালো স্টোর-রুম। খুব কম মানুষই ভাবেন, এই ছাদই হতে পারে খাদ্য উৎপাদন, মানসিক প্রশান্তির কিংবা পরিবেশ রক্ষার কার্যকর মাধ্যম। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সুজন সেই অল্পসংখ্যক মানুষের একজন, যিনি ছাদকে দেখেছেন সম্ভাবনার চোখে।
রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র ‘কয়েরদাড়া’য় বাড়ির ছাদে প্রায় ১৬০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ছাদবাগান। সেখানে বিশ্বের ২০টি দেশের ৬০টিরও বেশি প্রজাতির আনার বা বেদানা নিয়মিত ফলছে। পুরো ছাদটিই তিনি পানি-প্রতিরোধী সবুজ রঙের পেইন্ট দিয়ে নান্দনিকভাবে রাঙিয়ে তুলেছেন।
ছাদবাগান। ছবি: লেখকের সৌজন্যেদীর্ঘদিন ধরে আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা ছিল যে বাংলাদেশের মাটিতে ভালো মানের বেদানা হয় না, কিংবা হলেও তার বীজ শক্ত এবং স্বাদ কম। এই ধারণা ভাঙার কাজটাই করেছেন সুজন। তিনি প্রমাণ করেছেন সঠিক জাত নির্বাচন, পরিচর্যা আর জৈব ব্যবস্থাপনা থাকলে দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের বেদানাও আমাদের মাটি ও আবহাওয়ায় দারুণ ফলন দিতে পারে। তার বাগানে ঝুলে থাকা টকটকে লাল রসালো বেদানা সেই বাস্তবতারই প্রমাণ।
যেহেতু রাজশাহী বরেন্দ্রভূমির অংশ এবং এখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অনেক সময় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়, সেহেতু অনেকেই ধরে নেন যে ছাদবাগান এখানে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সুজন অস্ট্রেলিয়ান, তুর্কি, ইরানি, আজারবাইজানি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় নানা জাতের আনার এনে বছরের পর বছর পরীক্ষা করেছেন। অনেক ফল ঝরে গেছে, তবু তিনি থামেননি। এই অধ্যবসায়ই আজ তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
সুজনের ছাদবাগান প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ফল যেন একেকটি পরীক্ষার ফলাফল। তিন থেকে চার বছরের ধারাবাহিক পরীক্ষার পর তিনি প্রায় ৮০টির বেশি প্রজাতির আনারের মধ্য থেকে ৬০টির মতো প্রজাতিতে ভালো ফলন পেয়েছেন। আমাদের দেশে যেখানে দ্রুত ফল পাওয়ার মানসিকতা প্রবল, সেখানে এই ধৈর্য্য সত্যিই বিরল। উল্লেখযোগ্য হলো, সুজনের এই ছাদবাগান ইতোমধ্যেই কৃষি সংশ্লিষ্ট অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। রাজশাহীর কৃষি বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি তার ছাদবাগান পরিদর্শন করে বিস্ময় ও মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। এখন অনেক কৃষি বিশেষজ্ঞই সুজনের কাছ থেকেই উন্নত জাতের চারা উপহার হিসেবে সংগ্রহ করছেন।
ছাদবাগানের একুরিয়াম। ছবি: লেখকের সৌজন্যেসুজনের ছাদবাগানের বিস্তার কেবল আনারে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে রয়েছে অন্তত ৮০ জাতের সাইট্রাস গাছ, যা যেকোনো বাগানপ্রেমীর জন্য বিস্ময়ের। কাশ্মিরি কেনু, মরক্কোর মাল্টা, সুইট ম্যান্ডারিন, এফোরার ম্যান্ডারিন, রোডে রেড ও ট্রিপল ক্রস ম্যান্ডারিন প্রতিটি জাতই আলাদা স্বাদ, রং ও গুণে অনন্য।
শুধু তাই নয়, সুজনের সংগ্রহে আছে ১৮ জাতের দুর্লভ লংগান গাছ, যা বাংলাদেশে খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। তাঁর ছাদবাগানে রয়েছে বিশ্বের সেরা কিছু আঙুরের জাত। যেমন ভেলেজ, বাইকুনুর, গোল্ডেন ফিঙ্গার, শাইন মাস্কাট ও মুন ড্রপসের মতো বিরল ও উচ্চমূল্যের আঙুর, যেগুলো স্বাদ ও সৌন্দর্যে একেবারেই আলাদা।
সুজনের বাগানে পা রাখলে বোঝা যায়, এখানে সৌখিনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্ঞান ও পরিকল্পনা। এছাড়াও সুজনের ছাদবাগানে শোভা পাচ্ছে সফেদার উন্নত সংকর জাত ‘রোজ সাপোটে’ ও ‘হোয়াইট সাপোটে’, যা স্বাদে অত্যন্ত সুমিষ্ট, পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং ভোক্তাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যেসব ফল সাধারণত উন্নত দেশের বিশেষায়িত বাগানে সীমাবদ্ধ, সেগুলো আজ রাজশাহীর এক ছাদে নিয়মিত ফলছে।
সুজনের সৃজনশীলতার পরিধি এখানেই থেমে নেই। সর্বশেষ তিনি যুক্ত করেছেন ‘ছাদ পুকুর’ প্রকল্প। ছাদের এক পাশে ‘ছাদ পুকুর’ নামে সাজানো এই আয়োজন যেন শহরের বুকে হঠাৎ পাওয়া এক টুকরো জলজ স্বর্গ। পুকুরের সামনে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অবিরাম ছুটে চলা, বিশাল একুরিয়ামে জলজ উদ্ভিদ আর নানা রঙের মাছের মিছিল। ফলের গাছ, পাখির ডাক আর পানির ভেতর মাছের নড়াচড়া মিলিয়ে পুরো ছাদটিই হয়ে উঠেছে একটি জীবন্ত বাস্তুতন্ত্র।
ছাদবাগানের ফল হাতে ব্যাংক কর্মকর্তা আহমুদুর রহমান সুজনের। ছবি: লেখকের সৌজন্যেধীরে ধীরে এই সাফল্যের গল্প রাজশাহী ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনও টেলিভিশন, কখনও পত্রিকা, কখনো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—নিত্যনতুন শিডিউল মিলিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাঁকে। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হয়েও তিনি এই ব্যস্ততা সামলাচ্ছেন অবলীলায়।
ব্যাংকের জটিল হিসাব, কঠিন অডিট ফাইল আর দায়িত্বের চাপ সামলে ছুটির দিনে সুজনের ঠিকানা হয়ে ওঠে তাঁর ছাদবাগান। নিজের হাতে লাগানো গাছের নিচের চেয়ারে বসলেই তিনি যেন অন্য মানুষ। মাথার ওপরে নির্মল অক্সিজেন, চারপাশে পাখির কলতান, পাতার ফাঁক দিয়ে আসা বাতাস—এই পরিবেশেই তিনি পরের কর্মদিবসের জন্য মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেন।
আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই বিশাল আয়োজন তিনি গড়ে তুলেছেন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি ‘টিজিও’ ব্যাগ ব্যবহার করে। ছাদের জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ এটি। নান্দনিক নকশায় গড়ে তোলা চারতলা ও পাঁচতলা মিলিয়ে পুরো ছাদটিকেই তিনি বাগানে রূপান্তর করেছেন।
রাজশাহীর তীব্র গরমের কথা মাথায় রেখে সুজন আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে সংযুক্ত স্বয়ংক্রিয় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মাত্র কয়েক মিনিটেই ২৫০টি টব ও বড় ড্রামে একসঙ্গে পানি পৌঁছে যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পুরো এই স্বয়ংক্রিয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থাটি তিনি গড়ে তুলেছেন মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যেই।
এই ছাদবাগান দেখে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, বিশেষ করে যারা অবসরকালীন জীবনে সময় কাটানোর পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সুজন তাদের সামনে একটি সফল উদাহরণ। অনেকেই এখন তাঁর কাছ থেকে উপহার হিসেবে চারা সংগ্রহ করছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন এবং নিজের মতো করে শুরু করার সাহস পাচ্ছেন। নগরায়নের নামে আমরা যে সবুজ নিঃশেষ করেছি, তার বিপরীতে যদি কিছু প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে ছাদবাগান হতে পারে সেই ‘গ্রিন ট্যাক্স’। এটি বিবেকেরও দায়। আহমুদুর রহমান সুজনের ছাদবাগান আমাদের শেখায় প্রকৃতির কাছ থেকে নেওয়ার পাশাপাশি কিছু ফিরিয়ে দেওয়াও মানুষের দায়িত্ব।