leadT1ad

কাগজ ডট এআই: নতুন উদ্যোগ, পুরোনো প্রশ্ন

মিনহাজ রহমান পিয়াস
মিনহাজ রহমান পিয়াস

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ১৪
বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) প্ল্যাটফর্ম ‘কাগজ ডট এআই’। ছবি: সংগৃহীত

দেশীয় প্রযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন নতুন নয়। একসময় বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ নিয়ে ছিল প্রবল উচ্ছ্বাস—নিজের ভাষায়, নিজের দেশের সার্চ ইঞ্জিন। আবার দোয়েল ল্যাপটপকে বলা হয়েছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের আইকন’। লক্ষ্য ছিল কম দামে দেশীয় ল্যাপটপ সবার হাতে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ব্যবহারকারী কমেছে, টেকসই হয়নি, শেষমেশ উদ্যোগটিই থেমে গেছে।

এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে আরেকটি উদ্যোগ, বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) প্ল্যাটফর্ম ‘কাগজ ডট এআই’। প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিকভাবেই ফিরে আসে, এবার কি নতুন প্ল্যাটফর্মও পুরোনো দুটির মতো পরিণতি দেখবে, নাকি সফলতার গল্প তৈরি করবে?

‘কাগজ ডট এআই’ কী

১৫ ডিসেম্বর বাংলা ভাষায় প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্ল্যাটফর্ম ‘কাগজ ডট এআই’ চালু করেছে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এটি আইসিটি বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের একটি প্রকল্পের অংশ।

বাংলা ভাষায় কনটেন্ট তৈরির চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। খবরের কপি, দাপ্তরিক নথি, আবেদনপত্র, রিপোর্ট বা গবেষণা—সবখানেই দ্রুত টাইপিং, শুদ্ধ বানান, টেক্সট সাজানো ও ডকুমেন্ট তৈরি করা অনেক সময়সাপেক্ষ কাজ। এর পাশাপাশি বাংলা ভাষায় ছাপা বই, নথি বা আর্কাইভের বিশাল অংশ এখনো ‘সার্চেবল’ নয়। ডিজিটাল টেক্সটে না থাকায় একটি বইয়ের কোনো অধ্যায়ের তথ্য খুঁজতে হলে পুরো বই উল্টে দেখতে হয়।

বাংলা ভাষার প্রথম সার্চ ইঞ্চিন। ছবি: সংগৃহীত
বাংলা ভাষার প্রথম সার্চ ইঞ্চিন। ছবি: সংগৃহীত

কাগজ ডট এআই যে সেবা দেওয়ার কথা বলছে, তা হলো ওসিআর দিয়ে ছবি থেকে বাংলা লেখা, ভয়েস টাইপিংসহ টেক্সট থেকে বানান যাচাই, ভাষা প্রক্রিয়াকরণ ও কনটেন্ট তৈরি ইত্যাদি।

কারিগরিভাবে এটি কীভাবে কাজ করে

ওয়েবসাইটটি সিঙ্গেল পেজ ওয়েব অ্যাপ (এসপিএ) হিসেবে লোড হয়। এরপর কমান্ড দিলে সেটি প্রক্রিয়াজাত করতে সার্ভারের এআই সেবায় রিকোয়েস্ট পাঠায়। এখানে ‘এআই সার্ভিস ইঞ্জিন’ অংশটি সাধারণত কয়েকটি আলাদা সেকশনে ভাগ করা থাকে। যেমন: ওসিআর সার্ভিস, স্পিচ সার্ভিস ও ট্রান্সলেশন সার্ভিস। এতে কনটেন্ট স্কেলিং করা সহজ হয়।

আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ও কাগজ ডট এআই

একই ধরনের কাজের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় এআই অ্যাপ্লিকেশনগুলোর তালিকায় রয়েছে ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি ও হুইসপার, গুগলের জেমিনি, গুগল ক্লাউড ভিশন, অ্যামাজন ট্রান্সক্রাইব, মাইক্রোসফটের আজুরে ভিশন ডকুমেন্ট ইন্টেলিজেন্স, ক্লদ ও টেসেরাক্ট ওসিআর। এসব প্ল্যাটফর্মে বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষায়ও কাজ করা যায়।

এআই যেহেতু একটি মেশিন লার্নিং পরিষেবা, যা ব্যবহারকারীদের দেওয়া তথ্য থেকে নিজেই নিজেকে ট্রেইন করে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে, সেহেতু বিশ্বজুড়ে এসব প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও জনপ্রিয়তা বেশি হওয়ায় এগুলো কাগজ ডট এআই থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত।

আগের উদ্যোগগুলো কেন সফল হয়নি

বাংলাদেশে বড় বড় প্রযুক্তি উদ্যোগ ব্যর্থ হয় শুধু আইডিয়ার অভাবে নয়, বরং টেকসই কাঠামোর অভাবে।

পিপীলিকা

২০১৩ সালে চালু হয় দেশের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এবং জিপি আইটি লিমিটেড যৌথভাবে এটি তৈরি করেছিল। দাবি করা হয়েছিল, এটি পূর্ণাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ২০ কোটির বেশি মানুষকে তথ্য খুঁজতে সহায়তা করবে। পিপীলিকা ‘আইডিয়া’ হিসেবে সফল হলেও ব্যবসায়িক মডেলে টেকেনি। এর মূল কারণগুলো হলো:

১. বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক প্রজেক্ট: পিপীলিকা শুরু হয়েছিল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রজেক্ট হিসেবে। শুরুতে ৪ টেরাবাইট স্টোরেজ ও গ্রামীণফোন আইটির সহায়তা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে তা পর্যাপ্ত ছিল না।
২. রাজস্ব মডেলের অভাব: সরকারের এটুআই প্রকল্প থেকে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থায়ন করা হলেও মেয়াদ শেষে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই অর্থসংকটে পড়ে প্ল্যাটফর্মটি।
৩. বড় অপারেশনাল খরচ: সার্বক্ষণিক ওয়েব ক্রলিং, ইনডেক্স আপডেট, সার্ভার ও সিকিউরিটি বজায় রাখতে বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও টিমের প্রয়োজন হয়, যা ফান্ডের অভাবে সম্ভব হয়নি।
৪. গুগলের আধিপত্য ও ব্যবহারকারীর অভ্যাস: স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে মানুষ গুগল ব্যবহারে অভ্যস্ত। এই অভ্যাস ভেঙে নতুন প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারী আনতে যে বিপুল মার্কেটিং ও প্রচার দরকার ছিল, পিপীলিকার ক্ষেত্রে তা ছিল সীমিত।

দোয়েল ল্যাপটপকে বলা হয়েছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের আইকন’। ছবি: লিংকডইন থেকে নেওয়া
দোয়েল ল্যাপটপকে বলা হয়েছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের আইকন’। ছবি: লিংকডইন থেকে নেওয়া

দোয়েল

২০১১ সালের ১১ অক্টোবর সাশ্রয়ী দামে ল্যাপটপ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘দোয়েল’ ল্যাপটপের উদ্বোধন করা হয়। এটি ছিল দেশে অ্যাসেম্বল হওয়া প্রথম ল্যাপটপ। দায়িত্ব পায় টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস)। কিন্তু ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের আইকন’ হতে পারেনি দোয়েল।

মার্কেট ইন্টেলিজেন্স ফার্ম আইডিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ল্যাপটপের বাজার প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন ডলারের। যার ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। দোয়েল সাশ্রয়ী হতে গিয়ে যন্ত্রাংশের মানের সঙ্গে আপস করেছিল। ব্যবহারকারীদের ৮৩ শতাংশই ব্যাটারি নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। এ ছাড়া প্রসেসর ও র‍্যামের পারফরম্যান্স ছিল দুর্বল। সঠিক ‘আফটার সেলস সার্ভিস’ না থাকায় মানুষ দোয়েলের ওপর আস্থা হারায়। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।

কাগজ ডট এআই কি পারবে?

প্রশ্ন উঠছে, যেখানে ওপেনএআই, মাইক্রোসফট বা গুগলের মতো টেক জায়ান্টরা বিনামূল্যে উন্নত সেবা দিচ্ছে, সেখানে মানুষ কেন কাগজ ডট এআই ব্যবহার করবে? বৈশ্বিক এসব প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা ও মেশিন লার্নিং দক্ষতা বিশ্বসেরা। এই অসম প্রতিযোগিতার বাজারে কাগজ ডট এআই স্রেফ একটি ‘প্রজেক্ট’ হয়ে থাকবে, নাকি টেকসই ‘প্রোডাক্ট’ হয়ে উঠবে—সেটিই এখন দেখার বিষয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত