leadT1ad

ইসরায়েল-হামাস কি যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করছে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

২৩ নভেম্বর ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের শেষকৃত্যে শোকাহতরা। ছবি: এএফপি

হামাস শিগগিরই গাজায় থাকা শেষ ইসরায়েলি বন্দীর মরদেহ হস্তান্তর করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশের সুবিধার্থে তারা অস্ত্র ব্যবহারে ‘বিরতি’ নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত।

অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, দ্বিতীয় ধাপে যাওয়া কঠিন হতে পারে। তবে এ মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রথম ধাপ চলাকালে ইসরায়েল গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। এতে অন্তত ৩৬০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এখনো গাজায় সহায়তা প্রবেশে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে এবং অনুমোদিত সহায়তার পরিমাণ চুক্তির তুলনায় অনেক কম।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—প্রথম ধাপে কী ঘটেছে এবং দ্বিতীয় ধাপের সম্ভাবনা কতটুকু?

ইসরায়েল কি যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে?

উত্তর—না।

গত ১০ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েল এটি অন্তত ৫৯০ বার লঙ্ঘন করেছে। এতে ৩৬০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং দুই বছরের সামগ্রিক মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ধাপে ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধ, সেনা প্রত্যাহার, সহায়তা প্রবেশের অনুমতি এবং গাজায় আটক ইসরায়েলিদের বিনিময়ে শত শত ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তির কথা ছিল।

তবে এক মাস পর নেতানিয়াহু বলেন, গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয়নি এবং হামাসকে নিরস্ত্র করা হবে।

ইসরায়েলি নেতারা নিয়মিত ঘোষণা দিয়ে আসছেন যে তারা হামাসকে ধ্বংস করতে চায়। ফলে গাজার মানুষ এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে এবং প্রতিদিন হামলার ঝুঁকিতে বসবাস করছে।

ইসরায়েল কি সেনা প্রত্যাহার করেছে?

চুক্তির পর প্রথমে ইসরায়েল সৈন্যদের ইয়েলো লাইন বা হলুদ রেখার পেছনে সরিয়ে নেয়। এই সীমানা গাজার স্থলসীমা বরাবর রয়েছে এবং এটি ইসরায়েল ও হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকার অস্থায়ী বিভাজনরেখা।

হামাসের অভিযোগ, ইসরায়েল প্রতিদিন এই রেখা আরও ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং সীমারেখার কাছাকাছি আসা বেসামরিক ব্যক্তিরাও নিহত হচ্ছে, যার মধ্যে শিশুও রয়েছে।

ইসরায়েল কি সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে?

এবছর পুরোপুরি অবরোধে গাজায় তীব্র খাদ্যঘাটতি তৈরি হয়। জাতিসংঘের সমর্থিত আইপিসি আগস্টে গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষের কথা স্বীকার করে।

যুদ্ধবিরতির পর কিছু সহায়তা প্রবেশের অনুমতি মিলেছে, কিন্তু তা গাজার প্রয়োজন ও চুক্তির মানদণ্ডের তুলনায় অত্যন্ত কম।

সহায়তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত সংকটপূর্ণ, যদিও অপুষ্টির হার কিছুটা কমতে শুরু করেছে।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৯ হাজার ৩০০ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে, যা ফেব্রুয়ারির আগের যুদ্ধবিরতির তুলনায় পাঁচগুণ বেশি।

ইউএনআরডব্লিউএ-র বহিঃসম্পর্ক বিভাগের পরিচালক তামারা আলরিফাই বলেন, গাজায় যে পণ্য ঢুকছে তার বড় অংশই বাণিজ্যিক। ফলে প্রধান মানবিক সংস্থাগুলো, বিশেষ করে ইউএনআরডব্লিউএ, সহায়তা পৌঁছাতে পারছে না।

ইসরায়েল কি সত্যিই যুদ্ধবিরতিতে অঙ্গীকারবদ্ধ?

ইসরায়েলের আগে থেকেই একতরফা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার ইতিহাস আছে। নেতানিয়াহু নিজেও বলেছেন যুদ্ধ শেষ হয়নি। তাই ইসরায়েল সত্যিকারের শান্তিতে আগ্রহী কি না—তা এখনো অনিশ্চিত।

অনেক সমালোচকের মতে, গাজায় যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার পেছনে নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সংকট বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এসব চাপে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি সমর্থন করায় নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচানো অনেকটাই তাদের হাতে।

চ্যাথাম হাউসের উপদেষ্টা ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেন, ইসরায়েল কখনো এত দুর্বল নেতৃত্বের অধীনে ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের সমর্থন নেতানিয়াহুকে বহু রাজনৈতিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে।

নেতানিয়াহু নিজের বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলায় প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ট্রাম্পও হারজগকে তাকে ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

যদি যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে ডানপন্থী মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে দেখিয়ে চাপ হালকা করতে পারেন।

মেকেলবার্গের ভাষায়, ‘নেতানিয়াহু যে কোনো সময় বলতে পারবেন, “আমার নয়, সিদ্ধান্তটি ট্রাম্পের।”’

দ্বিতীয় ধাপে কী পরিকল্পনা রয়েছে?

দ্বিতীয় ধাপ মূলত যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিচালনা নিয়ে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়া পরিকল্পনাই সবচেয়ে বিস্তারিত এবং এর আংশিক সমর্থন দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজায় রাজনৈতিক দল নয় বরং পেশাদার ফিলিস্তিনি প্রযুক্তিবিদরা প্রশাসনের দায়িত্ব নেবেন। তাদের ওপর নজর রাখবে একটি বহুজাতিক ‘বোর্ড অব পিস’। পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নিরস্ত্রীকরণের দায়িত্বে থাকবে একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী। লক্ষ্য—গাজা পুনর্গঠন নিশ্চিত করা এবং সংঘাতের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো।

তবে হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী এই পরিকল্পনায় বিদেশি নিয়ন্ত্রণের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবও অগ্রহণযোগ্য বলে জানিয়েছে। তাদের মতে, এটি ফিলিস্তিনি জনগণের ইচ্ছার বাইরে চাপিয়ে দেওয়া সমাধান।

চূড়ান্ত চুক্তি কি সম্ভব?

গাজায় মৃত্যু বাড়ছেই। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের নিশ্চয়তা এখনো নেই। সমালোচকদের মতে, নেতানিয়াহু রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় চলেন। দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন চাপ থাকায় সিদ্ধান্ত যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে।

অন্যদিকে ট্রাম্প ও তাঁর কূটনীতির বাইরে থেকে আসা আলোচক-দল একই সঙ্গে গাজা যুদ্ধ ও ইউক্রেন সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে। তাদের অভিজ্ঞতা সীমিত হওয়ায় ফলাফল অনুমান করা কঠিন।

চুক্তি হলেও ইসরায়েল যে ইচ্ছামতো গাজায় হামলা চালাবে না—এ নিশ্চয়তা নেই। যেমনটি তারা এখনো পশ্চিম তীর, লেবানন, সিরিয়া ও আশপাশের অঞ্চলে করে থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও খুব বেশি নয়।

মেকেলবার্গ বলেন, পরিবর্তনের এতগুলো উপাদান এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে ভবিষ্যৎ অনুমান করা কঠিন।

তার কথায়, ‘এটা নেতানিয়াহুর অধীনে। দুর্নীতি তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে—ডানপন্থী রাজনীতিকে বৈধতা দেওয়া থেকে শুরু করে সামরিক খসড়া আইন পর্যন্ত। সবকিছু জটিল ও অগোছালো। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একজন অস্থিরমতি প্রেসিডেন্ট—এসব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে তা অনুমান প্রায় অসম্ভব।’

সূত্র: আল-জাজিরা

Ad 300x250

সম্পর্কিত