leadT1ad

আসাদ পরিবারের পতনের এক বছর পরে কেমন আছে সিরিয়া

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের পতন ঘটে। ছবি: সংগৃহীত।

সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের পতনের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছর এই দিনে বাশার আল-আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটে। আহমদ আল-শারা (সাবেক আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি) নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে।

গত এক বছরে কিছু স্থিতি ফিরেছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে, নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছে এবং সকল নাগরিকের জন্য শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু সংস্কার চলছে। তবে সিরিয়া এখনো বিভক্ত। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসম্পূর্ণ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক ধ্বংস আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এখনো চলছে।

অনেক সিরীয় আসাদের পতনকে মুক্ত নিঃশ্বাস হিসেবে দেখছে। কিন্তু সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উদ্বেগ, ইসরায়েলি হামলা ও আইএসআইএসের অবশিষ্ট উপস্থিতি অগ্রগতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো ঐক্য ও ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তবুও দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের ক্ষত এখনো গভীর।

আসাদ পরিবার ১৯৭১ সালে হাফেজ আল-আসাদের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ২০০০ সালে তার ছেলে বাশার দায়িত্ব নেন। এই সময়ে কঠোর দমননীতি, বিরোধী দমন ও আলাবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে শক্তি ভারসাম্যে শাসন চলেছে।

২০১১ সালে আরব বসন্তের আন্দোলন রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। প্রায় ৮ দশমিক ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়। কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। অবকাঠামো ধ্বংসের ক্ষতি কয়েকশ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে আসাদের বাহিনী রাসায়নিক হামলা, গণগ্রেপ্তারসহ অসংখ্য নৃশংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত।

২০২৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ১১ দিনের দ্রুত অভিযানে এইচটিএস আলেপ্পোসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে এবং দামেস্কের দিকে অগ্রসর হয়। ৮ ডিসেম্বর আসাদের বাহিনী ভেঙে পড়ে এবং তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এরপর আহমেদ আল-শারা অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

গত এক বছরের পরিস্থিতি

শারা সরকার জঙ্গি পরিচয় ঝেড়ে ফেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা গঠনের চেষ্টা করছে। নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠন, অতীত নির্যাতনের অনুসন্ধান এবং পুনর্গঠনের জন্য তেল খাত আধুনিকীকরণ ও বিমানবন্দর বেসরকারীকরণের মতো অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।

২০২৫ সালের মার্চে আলাবি শিয়াদের এলাকায় হামলায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়, অধিকাংশই বেসামরিক। জুলাইয়ে সুইদায় দ্রুজ ও বেদুইনদের সংঘাতে লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এর পর ইসরায়েল একাধিক বিমান হামলা চালায়। নভেম্বরের অভিযানেও বেইত জিন্নে ১৩ জন নিহত হন।

আইএসআইএস এর অবশিষ্ট সেনারা হত্যা ও অভিযান পরিচালনা করেছে। তারা প্রচারণায় শারাকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিচ্ছে।

আজ দামেস্কসহ বিভিন্ন শহরে সামরিক কুচকাওয়াজ, প্যারাশুট প্রদর্শনী ও রাস্তার উৎসব হয়। লাখো মানুষ অংশ নেয়। তবে কুর্দি কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে এসব অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে।

চ্যালেঞ্জ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা

সিরিয়া গভীরভাবে বিভক্ত সমাজ। আলাবিদের প্রতিশোধের ভয়, খ্রিস্টানদের শারার অতীত নিয়ে শঙ্কা, দ্রুজদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং কুর্দিদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার সংঘাতকে জীবন্ত রাখছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে শতাধিক নিহত, ইচ্ছামত গ্রেপ্তার, যৌন সহিংসতা ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক আচরণ এখনও চলমান। এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, পুরোনো ক্ষত এত গভীর যে যেকোনো সময় গৃহযুদ্ধের অবস্থা ফেরত আসতে পারে।

মানবাধিকার সংগঠন এসএনএইচআর সত্য-নির্ভর ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছে। তারা আসাদ আমলের ১ লাখ ৮১ হাজার বন্দি ও ১ লাখ ৩০ হাজার নিখোঁজের তথ্য হালনাগাদ করছে।

ক্ষতবিক্ষত অঞ্চলগুলোর মানুষের আর্তি স্পষ্ট, ‘আমরা নিরাপত্তা চাই। আমাদের শিশুরা নরকে বাস করছে।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবস্থান

আহমেদ আল-শারা এখন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। ২০২৫ সালের নভেম্বরে ট্রাম্পের সাথে বৈঠকের পর তার মাথার জন্য ১ কোটি ডলারের পুরস্কার প্রত্যাহার হয় এবং নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে সংলাপেও মধ্যস্থতা করে।

সৌদি আরব আলোচনা প্রক্রিয়া সহজ করে। তুরস্ক বর্ষপূর্তিতে অভিনন্দন জানায়।

তবে গোলান মালভূমিকে ঘিরে ইসরায়েলের সাথে বিরোধ অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক বিমান হামলা শান্তি আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ বলছে, সিরিয়াকে স্বাধীন, সার্বভৌম ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠনে বৈশ্বিক সহায়তা প্রয়োজন।

অর্থনীতি ও মানবিক পরিস্থিতি

নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ায় অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও পুনর্গঠনে এখনো বড় অর্থঘাটতি রয়েছে। কেন্দ্রীয় পুনর্গঠন তহবিল না থাকায় অগ্রগতি অসম।

প্রতিদিনের জীবন কঠিন। ২৫ লাখের বেশি শিশু স্কুলের বাইরে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো বাস্তুচ্যুত। মৌলিক সেবা বহু এলাকায় অপ্রতুল।

মানুষ অল্প খরচে দিন চালাচ্ছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ চলছে, কিন্তু অগ্রগতি নাজুক।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া

আসাদের পতনের বর্ষপূর্তিতে দামেস্ক ও হোমসের উৎসবমুখর ভিডিওতে অনেকেই আনন্দ প্রকাশ করেছে। তারা স্বাধীনতার অনুভূতি তুলে ধরেছে।

তবে কেউ কেউ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কেউ ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মানবাধিকারকর্মীরা ন্যায়বিচার ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের আহ্বান জানাচ্ছেন।

ভবিষ্যৎ

শারার সরকার ভেঙে পড়বে—এ পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ হয়নি। কিন্তু সিরিয়ার ভবিষ্যৎ টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তি ও বিভাজন নিরসনের ওপর।

জাতিসংঘ বলছে, সংকট অতিক্রম করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।

সাম্প্রদায়িক ক্ষত পুনরায় বিস্ফোরিত হলে বা বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ বাড়লে সংঘাত নতুন করে জ্বলতে পারে।

এখন সিরিয়া উদযাপনের মুহূর্তে আছে। কিন্তু একটি স্থিতিশীল, একীভূত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পথে যাত্রা এখনও দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ—তবুও সম্ভাবনার আলো আছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, এপি

Ad 300x250

সম্পর্কিত