leadT1ad

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়াল

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

গত জানুয়ারিতে চীন জানায় যে তাদের পণ্য ও সেবাখাতে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে—যা বিশ্বে কোনো দেশের জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা। কিন্তু ২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে চীন সেই সীমাও অতিক্রম করেছে। সোমবার প্রকাশিত কাস্টমস তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত চীনের মোট বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। ২০২৪ সালের পুরো বছরের উদ্বৃত্ত ছিল ৯৯২ বিলিয়ন ডলার।

এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে একটি কঠিন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। ২০২৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তবে অক্টোবরের শেষ দিকে সমঝোতা হয়, শুল্ক কমে আসে এবং রেয়ার আর্থ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয়।

অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে চীন এখনো বহু চাপে রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি আবাসন খাতে মন্দা, বিনিয়োগে রেকর্ড পতন এবং ভোক্তা ব্যয়ের ধীরগতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বহির্বাণিজ্য–নির্ভরতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

দেশটি জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশ রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বৈদেশিক বাজার এখন বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রপ্তানি প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কমেছে। একই সময়ে চীনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিনসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি একই হারে কমিয়েছে। ফলে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীন তিনগুণ বেশি রপ্তানি করছে।

শুধু নভেম্বর মাসেই উদ্বৃত্ত হয়েছে ১১১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ মাসিক উদ্বৃত্ত। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসের মোট উদ্বৃত্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।

চীন এবার রপ্তানির বাজার ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছে। গাড়ি, সোলার প্যানেল, ভোক্তা-ইলেকট্রনিক্সসহ নানা পণ্য দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বাজারে ঢল নামিয়েছে।

ফলে জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী উৎপাদনকারীরা বাজার হারাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশেও অনেক কারখানা মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে উৎপাদন কমাতে বা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।

চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পণ্যের চূড়ান্ত সংযোজন-প্রক্রিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মেক্সিকো ও আফ্রিকায় সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে। এভাবে তারা সরাসরি চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক কিছুটা এড়াতে পারছে।

চীন বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমদানির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি রপ্তানি করছে এবং গত বছরের তুলনায় উদ্বৃত্ত আরও বেড়েছে।

এর পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে—চীনা মুদ্রা রেনমিনবির দুর্বল অবস্থা এবং চীনে দাম কমতে থাকা, বিপরীতে ইউরোপ–আমেরিকায় দাম বৃদ্ধি।

চীনের মুদ্রার দুর্বলতা দেশটির রপ্তানি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন চীনের মোট অর্থনীতির এক-দশমাংশই উৎপাদিত পণ্যের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থেকে আসে। ইউরোপ এতে সবচেয়ে বেশি চাপ অনুভব করছে।

ইইউ চেম্বার অব কমার্স-এর প্রেসিডেন্ট জেন্স এসকেলুন্ড বলেন, ‘রেনমিনবি ইউরোর তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়িত। এমন অবস্থায় চীনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা প্রায় অসম্ভব।’

চীনের উদ্বৃত্ত এখন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উত্থানের সময় অথবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায়ও বেশি।

এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চীনের আর্থনীতি ও মুদ্রানীতি পর্যালোচনায় বার্ষিক সফরে রয়েছে। বুধবার ফলাফলের প্রাথমিক মূল্যায়ন প্রকাশের কথা।

অন্যদিকে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাদেরসহ বহু অর্থনীতিবিদ রেনমিনবির মান বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

রেনমিনবি শক্তিশালী হলে গ্যাসোলিন, ফরাসি ওয়াইন, জাপানি প্রসাধনীসহ আমদানিপণ্য সস্তা হবে। এতে চীনা নাগরিকদের হাতে বাড়তি অর্থ থাকবে এবং স্থানীয় রেস্টুরেন্ট, কনসার্ট, ইলেকট্রিক গাড়ির মতো অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা হতে পারে।

ভোক্তা ব্যয় বাড়ানো এখন বেইজিংয়ের অগ্রাধিকার। তবে মুদ্রামানের উত্থান রপ্তানিকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং কম রেনমিনবিতে পণ্য বিক্রিতে তারা কম আয় পাবে। এতে কারখানা–ভিত্তিক কর্মসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

চীনের রপ্তানি আয় প্রযুক্তি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে এবং রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশগুলোকে সহায়তার সক্ষমতা দিয়েছে।

তাই চীন বাড়তি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ধরে রাখতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা না বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার শি জিনপিং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য কাঠামোয় সংরক্ষণবাদ সমাধান নয়, বরং আরও ঝুঁকি তৈরি করবে।

তবে কিছু চীনা অর্থনীতিবিদ মনে করেন, একসময় দেশকে ভোক্তা স্বার্থে উদ্বৃত্ত কমাতে হবে, প্রয়োজনে ঘাটতিও নিতে হবে।

গত মাসে এক বক্তৃতায় ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি স্কুলের ডিন ঝাং জুন বলেন, যদি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে হয়, তবে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমানো প্রয়োজন। ভবিষ্যতে এমনকি বাণিজ্য ঘাটতিও বিবেচনা করা যেতে পারে।

এ অর্জন দেখায় যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও চীন রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাজার বৈচিত্র্যকরণও এ প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য সমঝোতার পরবর্তী সময়ে।

তবে এ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু দুর্বলতাও স্পষ্ট। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল, এবং বড় রপ্তানি উদ্বৃত্তের কারণে বাণিজ্য অংশীদারদের প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের আশঙ্কা রয়েছে। এই উদ্বৃত্ত চীনের প্রায় ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিয়ে উদ্বেগও বাড়িয়েছে।

বাণিজ্য উদ্বৃত্ত চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। শিল্প খাতে সংকোচন ও খুচরা খাতে মন্থরতা থাকা সত্ত্বেও দেশটি ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে। তবে এই উদ্বৃত্ত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য আরও নষ্ট করতে পারে এবং এতে শুল্ক আরোপের ঝুঁকিও বাড়ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইতোমধ্যে ইইউর বাণিজ্যিক পদক্ষেপের সতর্কতা দিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের বৈশ্বিক রপ্তানি অংশীদারিত্ব ১৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো জরুরি। এই লক্ষ্য পূরণে ২০২৬ সালে সক্রিয় রাজস্ব ব্যয় ও শিথিল মুদ্রানীতি গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

Ad 300x250

সম্পর্কিত