আজ ৯ ডিসেম্বর, বেগম রোকেয়া দিবস। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিবছরের মতো এবারও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হচ্ছে। সাধারণত দিনটি পালনের জন্য তাঁর জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্দে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নানা আয়োজন করা হয়। স্মৃতিকেন্দ্র ও বেগম রোকেয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত জন্মভিটায় চলে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। তবে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন এবং নির্মিত রোকেয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স দুই যুগেও পূর্ণতা পায়নি। উন্নয়ন, সংস্কার ও সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে লেখেন ‘মতিচূর’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’ এবং ‘সুলতানা’স ড্রিম’ প্রভৃতি। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার সোদপুরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষ তাঁর দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার দাবি করছেন।
যে বাড়িতে জন্মেছিলেন উপমহাদেশের নারী জাগরণের আলোকবর্তিকা, সেই বাড়িটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। স্থানীয়দের উদ্যোগে মাত্র তিন শতাংশ জমি ঘিরে সীমানা প্রাচীর নির্মিত হলেও আঁতুড়ঘর, পুরোনো স্থাপনা এবং রোকেয়ার স্মৃতি বহনকারী অংশগুলো রয়ে গেছে ধ্বংসপ্রায় অবস্থায়। বেদখল হয়ে আছে পৈত্রিক অনেক সম্পদ।
বাইরে ঝকঝকে, ভেতরে নীরব স্মৃতি কমপ্লেক্স
বেগম রোকেয়ার স্মৃতি ধরে রাখতে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন কেন্দ্রটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয় ২০০১ সালের ১ জুলাই। রোকেয়ার বসতভিটার সোয়া তিন একর জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটির ব্যয় ছিল ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প ছিল। বাংলা একাডেমি প্রকল্পটি পরিচালনা করত। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০০৪ সালের ৫ অক্টোবর স্মৃতিকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।
রোকেয়া দিবস উপলক্ষে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে স্মৃতি সংসদে। সাম্প্রতিক ছবিপরবর্তী সময়ে স্মৃতিকেন্দ্রটি বিকেএমইর শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এতে স্মৃতিকেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল এবং হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বিকেএমইকে উচ্ছেদের জন্য ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করেন।
উচ্চ আদালত স্মৃতিকেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শ্রমিক তৈরির কারখানা বন্ধ করার আদেশ দেন। এরপর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ২০১২ সালের ১ মে বিকেএমইকে সরিয়ে দেয়। ওই সময় থেকে স্মৃতিকেন্দ্রের কাজ বন্ধ ছিল।
পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, আদালতের রায়ের পর ২০১৮ সালে স্মৃতিকেন্দ্র, বাস্তুভিটা এবং পুরো কমপ্লেক্সের দায়িত্ব গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি। তবে সাত বছর পার হলেও এটি পুরোপুরি চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অবশেষে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির শুরুতে আজ এটি পুনরায় চালু করা হচ্ছে।
বন্ধ হয়ে আছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। স্ট্রিম ছবিএদিকে স্মৃতি সংসদের পাঠাগারে বই থাকলেও পাঠকের বসার পর্যাপ্ত স্থান নেই। নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য থাকা সেলাই মেশিন সারা বছর বাক্সবন্দী থাকে। ব্যবহার হয় শুধু রোকেয়া দিবসের আগে দেখানোর উদ্দেশ্যে। দিবস এলেই আয়োজন, সেমিনার, বক্তৃতা হয়। বছরের বাকি সময় স্মৃতি কমপ্লেক্স থাকে নির্জন।
স্মৃতি কমপ্লেক্সের সহকারী পরিচালক আবিদ করিম মুন্না বলেন, আগামীকাল অর্থাৎ আজ থেকেই সেলাই প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে। শিশু–কিশোরদের জন্য আর্ট ও সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
রোকেয়ার আদর্শ বাস্তবায়ন হয় না, শিক্ষার্থীদের হতাশা
পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জেমি আক্তার বলেন, আমরা নিয়মিত আসি। কিন্তু রোকেয়ার দর্শন বা ভাবনা এখানে অনুসরণ করা হয় না। পাঠাগারে বসার জায়গা নেই, বই নড়ানো যায় না। সেলাই মেশিন সব সময় বাক্সবন্দী। দিবস এলেই শুধু পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার আয়োজন দেখা যায়।
ঢাকা থেকে আসা দর্শনার্থী সিরাজুম মনিরা বলেন, এখানে এসে মনে হয়েছে পরিত্যক্ত কোনো স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। রোকেয়ার মতো একজন মহীয়সী নারীর স্মৃতি এভাবে অবহেলায় থাকবে, তা কল্পনা করিনি।
পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে আবিদ করিম মুন্না বলেন, ‘পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা সারা বছরই করা হয়।’
১৭ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠাগার চালাচ্ছেন এক নারী
পায়রাবন্দ রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের স্বেচ্ছাসেবী বিউটি আক্তার বলেন, সরকারি কোনো অনুদান নেই। মানুষের সহযোগিতায় বছর চলে। সেপ্টেম্বরে থেকে ডিসেম্বরে সবাই আসে, ছবি তোলে। কিন্তু রোকেয়ার মূল জন্মঘর এখনো অরক্ষিত। তাঁর বাবার জমি মানুষের দখলে। যে স্মৃতি আছে, একটি ভূমিকম্পেই ধসে পড়বে।
১৭ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠাগার চালাচ্ছেন এক নারীপায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘দুই যুগেও পায়রাবন্দে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। হাসপাতাল আছে, কলেজ আছে কিন্তু শিক্ষক নেই। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর ওপর বাধ্যতামূলক কোর্স নেই। রোকেয়ার নামে এক শতাংশ জমিও রেকর্ড নয়।’
তিনি প্রশ্ন করেন, ‘রোকেয়ার বাবার জমি কোথায় গেল? লাখেরাজ সম্পত্তি গেল কোথায়? পাঠ্যসূচিতে রোকেয়ার দর্শন বাধ্যতামূলক করলে যুবসমাজ তাঁকে জানত।’
দেহাবশেষ আনার দাবিও বছরের পর বছর ফাইলবন্দি
২০০৬ সালে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের লাশ দেশে ফেরার পর থেকেই রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার দাবি ওঠে। ২০০৯ এবং ২০১১ সালে ঘোষণা এলেও ১৪ বছরে কোনো প্রক্রিয়া এগোয়নি। সরকারি বা মন্ত্রণালয় পর্যায়ে কার্যক্রমও নেই।
স্থানীয়দের মতে, জন্মভিটা ও আঁতুড়ঘরের জরুরি সংস্কার, বেদখল হওয়া ৩৫০ বিঘা লাখেরাজ সম্পত্তি উদ্ধার, স্মৃতি কমপ্লেক্সকে কার্যকর গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে রূপান্তর, পাঠাগারের আধুনিকায়ন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তাঁর দর্শন বাধ্যতামূলক করা এবং সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষা সম্ভব নয়। গবেষক ও স্থানীয়দের মতে, দেহাবশেষ এনে সম্মানের সঙ্গে সংরক্ষণ করাও জরুরি।
স্মৃতি কমপ্লেক্সের সহকারী পরিচালক আবিদ করিম মুন্না বলেন, বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। প্রস্তাবে আছে, বেদিতেই দেহাবশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
স্থানীয়দের দাবি, রোকেয়ার ঐতিহাসিক অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে তার জন্মভিটাকে আধুনিক জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্রে রূপান্তর করা প্রয়োজন।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, বেগম রোকেয়ার স্মৃতিচিহ্নগুলো আজ ধ্বংসের মুখে। জমি বেদখল, বাড়ি জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। না হলে একদিন ইতিহাসটাই হারিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন বলেছেন, রোকেয়ার জন্মভিটা এখন বেদখল ও ঝুঁকিতে। তার জমি উদ্ধার না হলে রোকেয়ার ইতিহাস হারিয়ে যাবে। তার দেহাবশেষও জন্মভূমিতে আনা দরকার। তার স্মৃতিকেন্দ্র সংস্কার করা জরুরি। রোকেয়ার স্মৃতিস্থান আজও অবহেলায় পড়ে আছে। এগুলো সংস্কারের দাবি জানান তিনি।
এদিকে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. পারভেজ বলেন, জমি উদ্ধারসহ রোকেয়ার স্মৃতিসংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শওকাত আলী বলেন, বেগম রোকেয়ার কারণেই সারাদেশের নারীরা পর্দার অন্তরাল থেকে বের হতে পেরেছে। শিগগির রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণাগার খোলা হবে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়াকে গভীরভাবে স্মরণ করছেন।