মেসির পাশে তখন অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে তৃণমূলের বড় বড় অনেক নেতা ছিলেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোকজনও ছিলেন। মেসি ধৈর্য ধরে ছিলেন। ভক্তদের উদ্দেশে হাত নাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ভক্তরা তার হাত দেখতে না পেরে ধৈর্যহারা হয়ে যান।
অর্ক দেব

আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির বহুল প্রতীক্ষিত সফর কলকাতার জন্য অস্বস্তিকর স্মৃতি হয়ে থাকল। পরিকল্পনার ঘাটতি, ভিআইপি হস্তক্ষেপ আর ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল কলকাতায় সেদিন। শুধু তাই নয়, স্টেডিয়ামেও ভাঙচুর হয়েছে। উচ্চ প্রত্যাশা এবং ব্যয়বহুল টিকিটের পরও অনুষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়েছে। আরও ভালো পরিকল্পনা আর ভিআইপিদের উৎপাত একটু কম হলে কি এসব এড়ানো যেত?
অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী ব্যাংকার শতদ্রু দত্ত এখন বড় স্পোর্টস কন্ট্রাক্টর। তিনিই মেসিকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। এর আগেও তিনি ফুটবল তারকা কাফু, রোনালদিনহো, বেবেতো, ম্যারাডোনা ও মার্তিনেজকে কলকাতায় এনেছিলেন। কয়েক মাসের টানা চেষ্টায় মেসিকে এনেছিলেন। সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয় সেজন্য তিনি রাজনৈতিক মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন।
১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় আসেন মেসি। এই শহরে মেসির লাখ লাখ পাড় ভক্ত সমর্থক রয়েছে। ইতোমধ্যে শতদ্রু দত্ত পর্তুগিজ ফুটবল তারকা রোনালদোকে কলকাতায় আনারও স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু মেসির সফরের হাঙ্গামার জেরে আদালতের নির্দেশে তিনি এখন ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
কলকাতা ভারতীয় ফুটবলের মক্কা হিসেবে পরিচিতি। সেই শহরে মেসির জন্য লাল গালিচা বিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দত্ত। কিন্তু ঘটলো উল্টোটা।
হায়দরাবাদ এবং মুম্বাই শহরে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে খুব দারুণভাবে স্বাগত জানাল। কিন্তু ১৩ ডিসেম্বর সল্টলেক স্টেডিয়াম বিশৃঙ্খল স্থানে পরিণত হলো। তার তিন দিন পরও সেই রাতের উন্মাদনার ক্ষত রয়ে গেছে এবং বিবেকানন্দ যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনজুড়েও তা স্পষ্ট ছিল। এখানেই ভক্তরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন এবং স্টেডিয়ামের কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম নষ্ট হয়। এই ঘটনার জেরে মঙ্গলবার বিকেলে পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কিন্তু অন্যান্য শহরের মতো কলকাতা কেন সুন্দর একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারল না? কার ওপর এর দায় বর্তায়, সংগঠকদের ওপর, রাজনীতিবিদদের ওপর, নাকি তাদের যৌথ ব্যর্থতায় শহরটার গৌরব ধূলিসাৎ হলো?
শনিবার মধ্যরাতে রুদিগ্রো দি পল এবং লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে মেসি কলকাতায় আসেন। পরিকল্পনা ছিল খুবই সাধারণ—পরেরদিন সকালে বিবেকানন্দ যুব ভারতী স্টেডিয়ামে ভার্চুয়ালি মূর্তি উদ্বোধনের পর ভক্তরা তাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
ওই ইভেন্টের জন্য টিকিটের মূল্য তিন হাজার ৮৫৩ থেকে ১৪ হাজার ৭৫০ রুপি পর্যন্ত রাখা হয়। তারপরও এক সপ্তাহ আগেই টিকিট শেষ হয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ৬৫ হাজার সিটের স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মেসির গাড়ি স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর পরই ঘটনার শুরু। তিনি যখন গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন তখন, ক্ষমতাসীন নেতারা, মন্ত্রীরা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির এতো কাছে চলে যান, যেন মানবপ্রাচীর তৈরি করেছেন তাঁরা। আর এতে করে স্টেডিয়াম থেকে দর্শকরা মেসিকে এক নজর দেখারও সুযোগ পাননি।
মেসির পাশে তখন অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে তৃণমূলের বড় বড় অনেক নেতা ছিলেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোকজনও ছিলেন। মেসি ধৈর্য ধরে ছিলেন। ভক্তদের উদ্দেশে হাত নাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ভক্তরা তার হাত দেখতে না পেরে ধৈর্যহারা হয়ে যান।
মাত্র ১৭ মিনিট! তারপর মেসি বিমানবন্দরে চলে যান। আর তখনই স্টেডিয়ামে দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ক্ষুব্ধ সমর্থকরা মাঠে তাণ্ডব চালায়। লাথি ও ধাক্কা-ধাক্কাতি লোহার গেটগুলো বেঁকে যায়। গ্যালারি থেকে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো পানির বোতল উড়ে আসতে থাকে।
গোলপোস্টের জাল ছিঁড়ে তছনছ করে ফেলা হয়। কেউ কেউ ভিআইপি লাউঞ্জের সোফায় আগুন ধরিয়ে দেন। আবার অনেকে এমনভাবে নানা সরঞ্জাম নিয়ে চলে যায়, যেন কোনো ফ্লি মার্কেট থেকে জিনিস কুড়াচ্ছেন। এই বিশৃঙ্খলা দেখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর গণভবনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ও বিশৃঙ্খলার খবর পৌঁছানোর পর তাঁর নিরাপত্তা দল সেই পরিকল্পনা বাতিল করে। তবে সেদিন সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেন, সল্টলেক স্টেডিয়ামে আজ যে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে, তাতে আমি গভীরভাবে বিচলিত ও মর্মাহত।
তবে এতেও ক্ষত সারেনি। শনিবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে অরূপ বিশ্বাসের পদত্যাগের দাবি উঠতে শুরু করে। বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী লেখেন, লিওনেল মেসির এক ঝলক দেখার আশায় দর্শকেরা চড়া দামের টিকিট কেটেছিলেন। কিন্তু তার বদলে তাঁদের ঠাসাঠাসি করে রেখে মন্ত্রীদের বহর মেসিকে দেখে। দর্শকদের দৃষ্টিসীমা আটকে দিয়ে এবং পুরো মাঠ নিজেদের একচেটিয়া দখলে নিয়ে ভিআইপি দরবারে পরিণত করে।
শামিক ভট্টাচার্য ঘটনাটিকে ‘শাসক দলের লুট’ বলে আখ্যা দেন। তাঁর অভিযোগ, শাসক দলের নেতারা পুরো আয়োজনকে নিজেদের ব্যক্তিগত ফটোসেশনের সুযোগে পরিণত করেছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিআইপিদের ভিড় এতটাই ছিল যে সেটি এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। মেসি, সুয়ারেজ ও দে পল এক মুহূর্তের জন্যও প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। সদ্য পদত্যাগ করা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বারবার মেসিকে খুব কাছ থেকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেসির নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ মানতেও তাঁকে অস্বীকৃতি জানাতে দেখা গেছে।
এই তুলকালাম কাণ্ড আয়োজকদের প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কলকাতা পুলিশের কাছে মেসির পাশাপাশি শাহরুখ খানের আগমনের তথ্য কয়েক সপ্তাহ ধরেই ছিল। তা সত্ত্বেও কেন কোনো মক ড্রিল বা ভিড় নিয়ন্ত্রণের মহড়া আয়োজন করা হয়নি—সে প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঘটনাস্থলে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) পদমর্যাদার ছয়জন কর্মকর্তা, আটজন পুলিশ সুপার (এসপি) এবং প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। তবে মাঠের ভেতরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভিড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি বা পদদলিত হওয়ার আশঙ্কা এড়াতেই আমরা নীরব ছিলাম।
বক্তব্যটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত মনে হলেও বাস্তবতা হলো—পুলিশ স্পষ্টতই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছানোর পরই রাজ্য পুলিশ শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে। অনুষ্ঠানের আয়োজক দত্তকে মেসির ফ্লাইট থেকেই আটক করা হয়।
সেদিন সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার সাংবাদিকদের বলেন, আয়োজকরা লিখিতভাবে টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা তা তদারকি করব।
কিন্তু কীভাবে সেই টাকা ফেরত দেওয়া হবে—তা এখনো প্রশ্নই রয়ে গেছে।
শনিবারের এই বিশৃঙ্খলা পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির কলুষিত প্রভাবকে খোলাখুলি সামনে নিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল কংগ্রেসের যেমন দত্তের তারকাখ্যাতির প্রয়োজন ছিল, তেমনি দত্তেরও প্রয়োজন ছিল শাসকদলের অনুমোদন।
আয়োজনের স্বপ্নটা ছিল এমন—একই মঞ্চে লিওনেল মেসি, শাহরুখ খান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে গ্যালারিতে ৬৫ হাজার দর্শক। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউই যে এর অন্তর্নিহিত ঝুঁকিগুলো আঁচ করতে পারেননি, সেটাই শেষ পর্যন্ত এই তুলকালাম কাণ্ডের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠতেই ঊর্ধ্বতন মহল থেকে দ্রুত তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। সেদিন রাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। বারাসতের একটি আদালত তাঁদের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠান।
এই প্রেক্ষাপটেই ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পদত্যাগপত্রে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘দিদি’ সম্বোধন করেন। পরে মুখ্যমন্ত্র্যী তাঁর পদত্যাগ গ্রহণ করেন।
তবে ভক্তদের মতে, এই পদক্ষেপগুলো ‘খুব কম, খুব দেরিতে’ হয়েছে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সফর তাঁদের কাছে রেখে গেছে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা। তথাকথিত ‘ভিআইপি সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ জানিয়েছেন তারা।
তীর্থেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক আলোকচিত্রী বলেন, মনে হয়েছিল, আমাদের কলার ধরে মাটিতে মুখ ঠেসে বলা হচ্ছে—তোমরা কেউ নও, কোনো যোগাযোগ নেই, তাই মেসিকে কাছ থেকে দেখার যোগ্য নও। আমরা তো সাধারণ মানুষ, কোনোমতে দিন পার করি। মেসি কখনো আমাদের হতাশ করেননি, গতকালও করেননি। কিন্তু যাঁরা তাঁকে ঘেরাটোপে বন্দি করলেন, তাঁরা কখনো বুঝবেন না—এটা আমাদের কতটা কষ্ট দিয়েছে।
অর্ক দেব: সম্পাদক, ইনস্ক্রিপ্ট। দ্য কুইন্ট প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনূদিত।

আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির বহুল প্রতীক্ষিত সফর কলকাতার জন্য অস্বস্তিকর স্মৃতি হয়ে থাকল। পরিকল্পনার ঘাটতি, ভিআইপি হস্তক্ষেপ আর ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল কলকাতায় সেদিন। শুধু তাই নয়, স্টেডিয়ামেও ভাঙচুর হয়েছে। উচ্চ প্রত্যাশা এবং ব্যয়বহুল টিকিটের পরও অনুষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়েছে। আরও ভালো পরিকল্পনা আর ভিআইপিদের উৎপাত একটু কম হলে কি এসব এড়ানো যেত?
অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী ব্যাংকার শতদ্রু দত্ত এখন বড় স্পোর্টস কন্ট্রাক্টর। তিনিই মেসিকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। এর আগেও তিনি ফুটবল তারকা কাফু, রোনালদিনহো, বেবেতো, ম্যারাডোনা ও মার্তিনেজকে কলকাতায় এনেছিলেন। কয়েক মাসের টানা চেষ্টায় মেসিকে এনেছিলেন। সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয় সেজন্য তিনি রাজনৈতিক মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন।
১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় আসেন মেসি। এই শহরে মেসির লাখ লাখ পাড় ভক্ত সমর্থক রয়েছে। ইতোমধ্যে শতদ্রু দত্ত পর্তুগিজ ফুটবল তারকা রোনালদোকে কলকাতায় আনারও স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু মেসির সফরের হাঙ্গামার জেরে আদালতের নির্দেশে তিনি এখন ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
কলকাতা ভারতীয় ফুটবলের মক্কা হিসেবে পরিচিতি। সেই শহরে মেসির জন্য লাল গালিচা বিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দত্ত। কিন্তু ঘটলো উল্টোটা।
হায়দরাবাদ এবং মুম্বাই শহরে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে খুব দারুণভাবে স্বাগত জানাল। কিন্তু ১৩ ডিসেম্বর সল্টলেক স্টেডিয়াম বিশৃঙ্খল স্থানে পরিণত হলো। তার তিন দিন পরও সেই রাতের উন্মাদনার ক্ষত রয়ে গেছে এবং বিবেকানন্দ যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনজুড়েও তা স্পষ্ট ছিল। এখানেই ভক্তরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন এবং স্টেডিয়ামের কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম নষ্ট হয়। এই ঘটনার জেরে মঙ্গলবার বিকেলে পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কিন্তু অন্যান্য শহরের মতো কলকাতা কেন সুন্দর একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারল না? কার ওপর এর দায় বর্তায়, সংগঠকদের ওপর, রাজনীতিবিদদের ওপর, নাকি তাদের যৌথ ব্যর্থতায় শহরটার গৌরব ধূলিসাৎ হলো?
শনিবার মধ্যরাতে রুদিগ্রো দি পল এবং লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে মেসি কলকাতায় আসেন। পরিকল্পনা ছিল খুবই সাধারণ—পরেরদিন সকালে বিবেকানন্দ যুব ভারতী স্টেডিয়ামে ভার্চুয়ালি মূর্তি উদ্বোধনের পর ভক্তরা তাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
ওই ইভেন্টের জন্য টিকিটের মূল্য তিন হাজার ৮৫৩ থেকে ১৪ হাজার ৭৫০ রুপি পর্যন্ত রাখা হয়। তারপরও এক সপ্তাহ আগেই টিকিট শেষ হয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ৬৫ হাজার সিটের স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মেসির গাড়ি স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর পরই ঘটনার শুরু। তিনি যখন গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন তখন, ক্ষমতাসীন নেতারা, মন্ত্রীরা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির এতো কাছে চলে যান, যেন মানবপ্রাচীর তৈরি করেছেন তাঁরা। আর এতে করে স্টেডিয়াম থেকে দর্শকরা মেসিকে এক নজর দেখারও সুযোগ পাননি।
মেসির পাশে তখন অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে তৃণমূলের বড় বড় অনেক নেতা ছিলেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোকজনও ছিলেন। মেসি ধৈর্য ধরে ছিলেন। ভক্তদের উদ্দেশে হাত নাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ভক্তরা তার হাত দেখতে না পেরে ধৈর্যহারা হয়ে যান।
মাত্র ১৭ মিনিট! তারপর মেসি বিমানবন্দরে চলে যান। আর তখনই স্টেডিয়ামে দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ক্ষুব্ধ সমর্থকরা মাঠে তাণ্ডব চালায়। লাথি ও ধাক্কা-ধাক্কাতি লোহার গেটগুলো বেঁকে যায়। গ্যালারি থেকে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো পানির বোতল উড়ে আসতে থাকে।
গোলপোস্টের জাল ছিঁড়ে তছনছ করে ফেলা হয়। কেউ কেউ ভিআইপি লাউঞ্জের সোফায় আগুন ধরিয়ে দেন। আবার অনেকে এমনভাবে নানা সরঞ্জাম নিয়ে চলে যায়, যেন কোনো ফ্লি মার্কেট থেকে জিনিস কুড়াচ্ছেন। এই বিশৃঙ্খলা দেখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর গণভবনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ও বিশৃঙ্খলার খবর পৌঁছানোর পর তাঁর নিরাপত্তা দল সেই পরিকল্পনা বাতিল করে। তবে সেদিন সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেন, সল্টলেক স্টেডিয়ামে আজ যে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে, তাতে আমি গভীরভাবে বিচলিত ও মর্মাহত।
তবে এতেও ক্ষত সারেনি। শনিবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে অরূপ বিশ্বাসের পদত্যাগের দাবি উঠতে শুরু করে। বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী লেখেন, লিওনেল মেসির এক ঝলক দেখার আশায় দর্শকেরা চড়া দামের টিকিট কেটেছিলেন। কিন্তু তার বদলে তাঁদের ঠাসাঠাসি করে রেখে মন্ত্রীদের বহর মেসিকে দেখে। দর্শকদের দৃষ্টিসীমা আটকে দিয়ে এবং পুরো মাঠ নিজেদের একচেটিয়া দখলে নিয়ে ভিআইপি দরবারে পরিণত করে।
শামিক ভট্টাচার্য ঘটনাটিকে ‘শাসক দলের লুট’ বলে আখ্যা দেন। তাঁর অভিযোগ, শাসক দলের নেতারা পুরো আয়োজনকে নিজেদের ব্যক্তিগত ফটোসেশনের সুযোগে পরিণত করেছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিআইপিদের ভিড় এতটাই ছিল যে সেটি এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। মেসি, সুয়ারেজ ও দে পল এক মুহূর্তের জন্যও প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। সদ্য পদত্যাগ করা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বারবার মেসিকে খুব কাছ থেকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেসির নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ মানতেও তাঁকে অস্বীকৃতি জানাতে দেখা গেছে।
এই তুলকালাম কাণ্ড আয়োজকদের প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কলকাতা পুলিশের কাছে মেসির পাশাপাশি শাহরুখ খানের আগমনের তথ্য কয়েক সপ্তাহ ধরেই ছিল। তা সত্ত্বেও কেন কোনো মক ড্রিল বা ভিড় নিয়ন্ত্রণের মহড়া আয়োজন করা হয়নি—সে প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঘটনাস্থলে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) পদমর্যাদার ছয়জন কর্মকর্তা, আটজন পুলিশ সুপার (এসপি) এবং প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। তবে মাঠের ভেতরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভিড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি বা পদদলিত হওয়ার আশঙ্কা এড়াতেই আমরা নীরব ছিলাম।
বক্তব্যটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত মনে হলেও বাস্তবতা হলো—পুলিশ স্পষ্টতই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছানোর পরই রাজ্য পুলিশ শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে। অনুষ্ঠানের আয়োজক দত্তকে মেসির ফ্লাইট থেকেই আটক করা হয়।
সেদিন সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার সাংবাদিকদের বলেন, আয়োজকরা লিখিতভাবে টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা তা তদারকি করব।
কিন্তু কীভাবে সেই টাকা ফেরত দেওয়া হবে—তা এখনো প্রশ্নই রয়ে গেছে।
শনিবারের এই বিশৃঙ্খলা পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির কলুষিত প্রভাবকে খোলাখুলি সামনে নিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল কংগ্রেসের যেমন দত্তের তারকাখ্যাতির প্রয়োজন ছিল, তেমনি দত্তেরও প্রয়োজন ছিল শাসকদলের অনুমোদন।
আয়োজনের স্বপ্নটা ছিল এমন—একই মঞ্চে লিওনেল মেসি, শাহরুখ খান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে গ্যালারিতে ৬৫ হাজার দর্শক। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউই যে এর অন্তর্নিহিত ঝুঁকিগুলো আঁচ করতে পারেননি, সেটাই শেষ পর্যন্ত এই তুলকালাম কাণ্ডের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠতেই ঊর্ধ্বতন মহল থেকে দ্রুত তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। সেদিন রাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। বারাসতের একটি আদালত তাঁদের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠান।
এই প্রেক্ষাপটেই ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পদত্যাগপত্রে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘দিদি’ সম্বোধন করেন। পরে মুখ্যমন্ত্র্যী তাঁর পদত্যাগ গ্রহণ করেন।
তবে ভক্তদের মতে, এই পদক্ষেপগুলো ‘খুব কম, খুব দেরিতে’ হয়েছে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সফর তাঁদের কাছে রেখে গেছে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা। তথাকথিত ‘ভিআইপি সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ জানিয়েছেন তারা।
তীর্থেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক আলোকচিত্রী বলেন, মনে হয়েছিল, আমাদের কলার ধরে মাটিতে মুখ ঠেসে বলা হচ্ছে—তোমরা কেউ নও, কোনো যোগাযোগ নেই, তাই মেসিকে কাছ থেকে দেখার যোগ্য নও। আমরা তো সাধারণ মানুষ, কোনোমতে দিন পার করি। মেসি কখনো আমাদের হতাশ করেননি, গতকালও করেননি। কিন্তু যাঁরা তাঁকে ঘেরাটোপে বন্দি করলেন, তাঁরা কখনো বুঝবেন না—এটা আমাদের কতটা কষ্ট দিয়েছে।
অর্ক দেব: সম্পাদক, ইনস্ক্রিপ্ট। দ্য কুইন্ট প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনূদিত।

মানুষ ব্যষ্টি ও সমষ্টি হিসেবে তার বোধ ও বিশ্বাসের বিশ্বেই বসবাস করতে চায়। তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরিখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। দেশ ও সমাজ-সংসারসংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যার চিন্তাধারা অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মানসচক্রবালের চৌহদ্দিভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।
১ দিন আগে
গত জুনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলা থেকে কাজের সন্ধানে দিল্লি গিয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুন ও তাঁর পরিবার। কিন্তু বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। তারপর সীমান্ত দিয়ে জোর করে ঠেলে পাঠায় (পুশ ইন) বাংলাদেশে।
২ দিন আগে
ইতিহাস সম্পর্কে যেসব ভিন্নমত আমরা দেখতে পাই, তার মধ্যে দুটো বড় ঘটনা—প্রথমত, অপারেশন সার্চলাইটের ভয়াবহতা ও হিংস্রতা পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের পাকিস্তান সম্পর্কে সামান্যতম দুর্বলতাকেও পরিহার করতে প্রণোদিত করেছিল। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিয়াজির আত্মসমর্পণ।
২ দিন আগে
তিন রকমের অন্তরায় বাংলাদেশের ভবিষ্যত যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে—রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্তরায়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না, বরং তারা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রের সঙ্গে জড়িত।
২ দিন আগে