leadT1ad

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক টেকসই হবে কীভাবে

স্ট্রিম গ্রাফিক

ঢাকার ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভিন্ন আবহে পালিত হয় ৫৪তম ‘মৈত্রী দিবস’। অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা জানান, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে স্থিতিশীল, ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক চায়। তিনি এমন সম্পর্কের ওপর জোর দেন, যেখানে মূল অংশীদ্বার হবে দুদেশের জনগণ।

ভারত ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই ঐতিহাসিক দিনকে স্মরণ করেই মৈত্রী দিবস পালিত হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের এই সময়ে দাঁড়িয়ে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়, প্রণয় ভার্মার এই বক্তব্য কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং দিল্লির পরিবর্তিত মনোভাব ও ‘রি-সেট’ বা সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত বহন করছে।

গত কয়েক মাসে দুদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভিসা জটিলতা, সীমান্তে উত্তেজনা ও গণমাধ্যমে পাল্টাপাল্টি বয়ানের পর প্রশ্ন উঠেছে– আসলেই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কীভাবে টেকসই, গঠনমূলক ও ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারে?

সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা

হাইকমিশনার তাঁর বক্তব্যে ‘সমতা’ ও ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে জোরালো ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ভারত অনেক ক্ষেত্রে একপাক্ষিক সুবিধা পেয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের মানুষ এখন এমন পররাষ্ট্রনীতি চায়, যা নতজানু নয় বরং সমমর্যাদার।

সম্পর্ক ইতিবাচক করতে হলে ভারতকে বাংলাদেশের এই নতুন মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। ‘বিগ ব্রাদার’ বা বড় ভাইসূলভ আচরণের পরিবর্তে ভারতকে ‘প্রতিবেশী ও বন্ধু’ হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পছন্দ ও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানানোই হবে এই শ্রদ্ধার মূল ভিত্তি। সম্পর্ক হতে হবে রাষ্ট্র-রাষ্ট্র, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়।

যখন ভারত দেখাবে যে তারা ঢাকার ক্ষমতায় কে আছে তার চেয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তখনই সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করবে।

আস্থার চাবি তিস্তা ও অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে বড় কাঁটা বা অস্বস্তির জায়গা হলো পানি বণ্টন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক রশি টানাটানিতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল শুকিয়ে যাচ্ছে। সম্পর্ককে গঠনমূলক করতে হলে ভারতকে পানির প্রশ্নে নমনীয় ও মানবিক হতে হবে।

কেবল তিস্তা নয়, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও আগাম তথ্য আদান-প্রদান অত্যন্ত জরুরি। বর্ষায় ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়া বা শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখার মতো ঘটনাগুলো বাংলাদেশে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি করে। ইতিবাচক সম্পর্কের জন্য যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কার্যকর ভূমিকা ও পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। পানি বণ্টন কেবল কূটনৈতিক চুক্তি নয়, বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। প্রত্যাশা করা যায়, পানি সমস্যার সমাধান হলে তা দুদেশের আস্থার ঘাটতি পূরণে ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বাস্তবতা

বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ এই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃত্যু নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভারত বারবার ‘নন-লিথাল উইপন’ বা প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। ফেলানী হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সবুজ মিয়া (৩০) হত্যা; প্রতিটি ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়।

গঠনমূলক সম্পর্কের পূর্বশর্ত হলো সীমান্তকে রক্তপাতহীন রাখা। চোরাচালান বা অবৈধ পারাপার বন্ধে আইনি প্রক্রিয়া থাকতে পারে, কিন্তু গুলি করে হত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা গেলে তা বাংলাদেশের জনমনে ভারতের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে। মানবিক সীমান্ত ব্যবস্থাপনাই পারে দুদেশের জনগণকে কাছাকাছি আনতে।

অর্থনৈতিক অংশীদ্বারত্ব ও বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস

অর্থনীতি হতে পারে দুদেশের সম্পর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাবক। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। কিন্তু বাণিজ্যের পাল্লাটা ভারতের দিকেই বেশি ভারী। এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের বাধাগুলো দূর করা ও অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটির মতো বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

তাছাড়া, প্রস্তাবিত ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ (সেপা) নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কানেক্টিভিটি বা সংযোগ এই সম্পর্কের প্রাণ। ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা বাংলাদেশ ভারতকে দিয়েছে। এখন নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির জন্য ভারতের ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের সুযোগ বাংলাদেশকে দিলে তা হবে সত্যিকারের সহযোগিতামূলক আচরণ।

জ্বালানি নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক বাণিজ্যে ভারত যদি বাংলাদেশকে সমান সুযোগ দেয়, তবে তা উভয় দেশের অর্থনীতির জন্যই গেম চেঞ্জার হতে পারে।

অপপ্রচার রোধ ও মিডিয়ার ভূমিকা

সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের সম্পর্কের অবনতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচার। বিশেষ করে, ভারতের কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অতিরঞ্জিত ও ভুয়া খবর প্রচার বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশেও ভারতবিরোধী উগ্র বয়ান অনেক সময় সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে।

সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা জরুরি। সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতনের অতিরঞ্জিত খবর প্রচার না করে বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন করা উচিত। দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত উসকানিমূলক মন্তব্য থেকে বিরত থাকা। প্রণয় ভার্মা যে ‘জনগণের অংশীদারত্বে’র কথা বলেছেন, তা তখনই সম্ভব হবে যখন দুই দেশের মানুষ একে অপরের মিডিয়াকে বিশ্বাস করতে পারবে।

ভিসা জটিলতা নিরসন ও মানুষে-মানুষে যোগাযোগ

গত কয়েক মাসে ভারতীয় ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। চিকিৎসার জন্য হাজার হাজার রোগী, শিক্ষার্থী ও পর্যটক বিপাকে পড়েছেন। ভিসা সীমিত করার এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়েছে ও ভারতের প্রতি ক্ষোভ তৈরি করেছে।

সম্পর্কের মূলে রয়েছে ‘পিপল-টু-পিপল কন্টাক্ট’। ভারত যদি দ্রুত ভিসা ব্যবস্থা স্বাভাবিক করে ও বাংলাদেশিদের ভ্রমণে অহেতুক কড়াকড়ি শিথিল করে, তবে তা ইতিবাচক বার্তা দেবে। চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মানবিক বিষয়গুলোকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। জনগণ যখন অবাধে যাতায়াত করতে পারে, তখন সাংস্কৃতিক ও মানসিক দূরত্ব কমে আসে।

রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন

ভারতকে মেনে নিতে হবে, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে বিশাল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন নেতৃত্ব বা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের সঙ্গে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।

ভারত যদি কেবল নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লেন্স দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে, তবে তা ভুল হবে। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি ও সুশীল সমাজের সঙ্গেও ভারতের এনগেজমেন্ট বা যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশকেও ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয় মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যাতে তৎপরতা চালাতে না পারে, সে বিষয়ে ঢাকাকে জিরো টলারেন্স নীতি বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ, নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনীতিতে একে অপরের ‘রেড লাইন’ বা সংবেদনশীলতাকে সম্মান জানাতে হবে।

মৈত্রী দিবসে প্রণয় ভার্মার বক্তব্য নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক শুরু। কিন্তু কথার চেয়ে কাজের গুরুত্ব বেশি। বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় দেশই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভূগোল বা ইতিহাস বদলানো যায় না, কিন্তু নীতি বদলানো যায়।

স্থিতিশীল ও ইতিবাচক সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন ‘লেনদেনভিত্তিক’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ‘অংশীদারত্বমূলক’ মানসিকতা গড়ে তোলা। ভারত যদি সমতার ভিত্তিতে হাত বাড়িয়ে দেয় ও বাংলাদেশ যদি জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে পারে, তবেই এই সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য রোল মডেল হতে পারে।

তিস্তার পানি, সীমান্তে হত্যা বন্ধ, ভিসা সহজীকরণ এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা—এই চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই গড়ে উঠতে পারে আগামীর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। মৈত্রী দিবসের চেতনা তখনই সার্থক হবে, যখন দুই দেশের জনগণ অনুভব করবে যে এই বন্ধুত্ব কেবল কূটনীতিকদের ফাইলে বন্দি নয়, বরং তাদের প্রাত্যহিক জীবনেও এর সুফল মিলছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত