leadT1ad

এনডিটিভির বিশ্লেষণ

তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ভারতের জন্য কী বার্তা

তারেক রহমান এমন একজন নেতা, যিনি বাংলাদেশকে সবার আগে রাখার কথা বলেন। তবে একই সঙ্গে তিনি ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের গুরুত্বও স্বীকার করেন। তিনি আঞ্চলিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের গুরুত্ব বোঝেন।

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ২৫
তারেক রহমান ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মান ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছর লন্ডনে নির্বাসনে থাকার পর গত ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন। তার প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে বিপুল জনসমাগম দেখা যায়। ২০২৬ সালের শুরুতে সম্ভাব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশে ফিরে তারেক রহমান উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের সামনে প্রথম ভাষণ দেন। ভাষণে তারেক রহমান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের অঙ্গীকার করেন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তার কথা বলেন। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি এগিয়ে রয়েছে। দলটি যদি সংসদ নির্বাচনে সর্বাধিক আসন পায়, তাহলে তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী পদে অন্যতম প্রধান প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

ভারতের জন্য তারেক রহমান কেমন নেতা

তারেক রহমান এমন একজন নেতা, যিনি বাংলাদেশকে সবার আগে রাখার কথা বলেন। তবে একই সঙ্গে তিনি ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের গুরুত্বও স্বীকার করেন। তিনি আঞ্চলিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের গুরুত্ব বোঝেন।

এর বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী শুধু ভারতবিরোধী। অভিযোগ রয়েছে, দলটি নিরাপত্তা, জনকল্যাণ, শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনের মতো বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয় না—যে বিষয়গুলো তারেক রহমান তার বাংলাদেশের ভাবনায় তুলে ধরেছেন।

তারেক রহমান ইসলামী মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে দৃঢ় আস্থা রাখেন। তবে তিনি বাংলাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদের পথে নেওয়ার পক্ষে নন। বরং তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের কল্পনা করেন, যেখানে সব ধর্মের মানুষের জন্য জায়গা ও নিরাপত্তা থাকবে। তারেক রহমান পররাষ্ট্রনীতিতেও একটি স্পষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরেছেন।

দেশে ফিরে দেওয়া প্রথম ভাষণে তিনি বলেন, এই দেশে যেমন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী রয়েছে, তেমনি সমতলের মানুষও রয়েছে। মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একসঙ্গে এই দেশে বসবাস করে। সবাইকে নিয়েই তিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ, একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে চান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান দলের রাজনৈতিক দর্শনও স্পষ্ট করেন। তিনি জানান, তাঁর নীতিতে বাংলাদেশই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। তারেক রহমান স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বাংলাদেশ দিল্লি বা রাওয়ালপিন্ডির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর রাজনীতিতে যাবে না।

তাঁর ভাষায়, ‘দিল্লি নয়, পিন্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ।’ ঢাকার নয়াপল্টনে এক বিশাল সমাবেশে তিনি এই স্লোগান দেন এবং সমর্থকদের তা পুনরাবৃত্তি করতে আহ্বান জানান।

এই অবস্থান জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভিন্ন। জামায়াতে ইসলামীর একটি ভারতবিরোধী এজেন্ডা রয়েছে, যা পাকিস্তানকেন্দ্রিক এবং ভারতের জন্য অস্থিতিশীলতা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফারাক্কা পানি চুক্তিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর। ২০২৬ সালে চুক্তিটির নবায়নের সময় আসবে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি নবায়নে সংবেদনশীল ও দক্ষ কূটনীতি প্রয়োজন হবে। আগামী সরকারকে দিল্লির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এমন একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে, যা উভয় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়।

ইতিহাসের উল্লেখ ও জামায়াতের অস্বস্তি

তারেক রহমানের বক্তব্যে ইতিহাসের উল্লেখ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। জামায়াতে ইসলামী চায় এসব ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে। তাদের লক্ষ্য হলো নিজেদের উগ্র ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়া।

বাংলাদেশের মাটিতে দেওয়া প্রথম ভাষণে তারেক রহমান দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই প্রিয় মাতৃভূমি অর্জিত হয়েছে। তিনি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের কথাও উল্লেখ করেন। তার ভাষায়, ওই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশকে আধিপত্যের কবল থেকে রক্ষা করা হয়েছিল।

তারেক রহমান আরও বলেন, পরে ১৯৯০ সালে এ দেশের জনগণ, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করে। তবে এসব অর্জনের পরও ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

দেশে আইনশৃঙ্খলার গুরুত্ব তুলে ধরে বিএনপির এই নেতা বলেন, যেকোনো মূল্যে দেশে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। তিনি সবাইকে উসকানির মুখে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানান।

যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব যুবকদের হাতেই থাকবে। দেশ গঠনের দায়িত্বও তাদের কাঁধে পড়বে। আজ থেকেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, যাতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তি ও মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর সুন্দরভাবে দেশ গড়ে তোলা যায়।

কেন তারেক রহমান জামায়াতের জন্য অস্বস্তির কারণ

তারেক রহমানের বক্তব্যে আইনশৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের ওপর জোর জামায়াতে ইসলামীর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও গণপিটুনির মতো কর্মকাণ্ড উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের হাতে সংখ্যালঘু, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ওপর হামলার প্রতিবাদ করায় সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হন। এক্ষেত্রেও ভারতকে জড়িয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করা হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরেই ভারতবিরোধী বিদ্বেষ উসকে দিতে এই ধারণা ছড়িয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন বাড়তে শুরু করেছে। এই অবস্থায় জামায়াত-সংশ্লিষ্ট মহল তারেক রহমানকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে তারেক রহমান নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন নির্বাসনে ছিলেন। এই কারণে তিনি অনেকের চোখে একজন ভুক্তভোগী হিসেবেও বিবেচিত হন।

তারেক রহমান শেখ হাসিনাবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত। এই পরিচয়ের কারণে জামায়াতে ইসলামী তাকে আওয়ামী লীগের মতো করে সরাসরি আক্রমণ করতে পারছে না। এ বিষয়টি জামায়াতের মধ্যে আরও সতর্কতা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

একসময় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে রাজনৈতিক জোট ছিল। তবে এবার বিএনপি ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। বিএনপি জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম (জেইউআই)-এর সঙ্গে জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম আদর্শগতভাবে জামায়াতে ইসলামীর থেকে ভিন্ন। দুটি দলই ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও তাদের দর্শন এক নয়। জেইউআই মূলত ধর্মীয় আলেম ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামী আইনের চর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে থাকে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা শিক্রি বলেন, তারেক রহমান ১৭ বছর ধরে লন্ডনে নির্বাসনে ছিলেন। এই পুরো সময়েই তাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। এমনকি মায়ের অসুস্থতার কারণে তিনি যখন কিছুটা আগে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন, তখনও সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল—চাইলে তিনি একবারের জন্য ভ্রমণ অনুমতি নিতে পারেন। এর অর্থ হলো, তার দেশে ফেরার বিষয়টি সরকার নিয়ন্ত্রণ করছিল।

তিনি আরও বলেন, এখন তাকে সেই ভ্রমণ অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং তিনি বাংলাদেশে পৌঁছেছেন। ১৭ বছর পর তার প্রত্যাবর্তনের ফলে বিএনপির জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের উত্থান ঘটবে বলে তিনি মনে করেন।

তার ভাষায়, বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির পক্ষে খুব একটা অনুকূল অবস্থানে নেই। অতীতে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। কিন্তু এখন তারা অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোকে একত্র করার দিকেই বেশি ঝুঁকছে।

(ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিতে প্রকাশিত সৌরভ গুপ্তের লেখা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ)

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত