তারেক রহমানের সাফল্য নির্ভর করবে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতার ওপর। তাকে চীনের অর্থায়ন কাজে লাগাতে হবে, কিন্তু ঋণের ফাঁদে পড়া যাবে না। ভারতের সঙ্গে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে, কিন্তু এমনভাবে নয় যাতে অবরোধের ঝুঁকি তৈরি হয়। একই সঙ্গে ইসলামপন্থী মিত্রদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে, তবে পশ্চিমা বিশ্বকে দূরে ঠেলে না দিয়ে।
মাহবুবুল আলম তারেক

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরছেন। এই প্রত্যাবর্তন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন দেশে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি নির্বাচনী লড়াইয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা আঞ্চলিক রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বড় বড় শক্তিধর দেশের প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশ তিনদিকে ভারতঘেরা হলেও বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার রয়েছে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ সমবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে। বিপরীতে, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে উষ্ণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র জোরদারের কথা বলছে। তবে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তারা সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কাঠামো একটি বড় ধরনের পুনর্বিন্যাসের মুখে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির সম্পর্ক নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যে ‘স্বর্ণযুগ’ ছিল, তা কার্যত শেষ হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে একটি বহুমুখী ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির পথ তৈরি হচ্ছে, যা তারেক রহমান ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এই নীতিতে কোনো আঞ্চলিক শক্তির অধীনতা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এই নীতির মূল কথা হবে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কোনো একক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়ানো। ‘দিল্লিও নয়, পিন্ডিও নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ’, এই স্লোগান তার নীতির কেন্দ্রবিন্দু। এর মাধ্যমে তিনি দুটি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চান। একদিকে তিনি বিএনপির ওপর থাকা পাকিস্তানপন্থী তকমা ঝেড়ে ফেলতে চান। অন্যদিকে তিনি ভারতের আধিপত্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করছেন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপি ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন অংশীদার খুঁজতে চায়। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় পররাষ্ট্রনীতি হবে বাস্তবভিত্তিক ও সংযত। অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের দিকে ঝোঁক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সতর্ক সম্পর্ক উন্নয়ন বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রা দেবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের সম্ভাব্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই সমীকরণে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যই আগামী দিনের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বাস্তবতা নির্ধারণ করবে।
ভারতের অবস্থান: সম্পর্কের টানাপোড়েন ও প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখেছে। শেখ হাসিনার ভারত অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। তারেক রহমান নিজেও এ বিষয়ে সরব ছিলেন। গত অক্টোবরে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভারত যদি একজন স্বৈরশাসককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরাগভাজন হয়, তবে এতে তাদের কিছু করার নেই। বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করেছে যে সম্পর্ক শীতল থাকবে।
তবে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি সরকারে এলে ভারতের সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা হতে পারে। যদিও সেখানে সার্বভৌমত্বকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নতুন করে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ এনে দেবে।
ভারতকে পরমার্শ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন এই সম্পর্ককে নতুন করে ঢেলে সাজানোর একটি সুযোগ এনে দেবে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত ও বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির স্বার্থ রক্ষার জন্য এই দলটিই সম্ভবত এখন সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষক চিয়েতিজ বাজপাইয়ের মতে, আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত থাকায় ভারত বাধ্য হয়েই বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে পারে। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক আর কৌশলগত অংশীদারত্বে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি হবে স্বার্থভিত্তিক ও লেনদেননির্ভর সহাবস্থান।
তবে এর জন্য ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ বা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ কমানোর মতো পদক্ষেপ আশা করা হতে পারে। এসব বিষয়ে অগ্রগতি না হলে সম্পর্ক দীর্ঘদিন শীতল থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিকল্প অংশীদার খোঁজার পথে এগোতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র: গণতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন, তবে কৌশলগত সতর্কতা
যুক্তরাষ্ট্র অতীতে তারেক রহমানসহ বিএনপির অনেক নেতার বিষয়ে সমালোচনামুখর ছিল। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে একটি সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক বিকল্প হিসেবে দেখছে। তারেক রহমান এবং বিএনপি নেতারাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, এতে ভারত ও চীনের প্রভাবে ভারসাম্য আনা সম্ভব।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশকে বহুমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তার ভাষায়, নির্বাচিত বিএনপি সরকার শক্ত অবস্থান থেকে বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব স্বীকার করে। তবে তারা দ্রুত কোনো একপাক্ষিক জোটে জড়াতে চায় না। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা, ইসলামপন্থী উগ্রবাদ ঠেকানো এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখা। তারেক রহমান পশ্চিমা সমর্থন আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক শক্তি।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হোক। তবে তারেক রহমানের সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে সরাসরি কোনো জোটে যোগদানে অনীহা থাকতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সীমিত সহযোগিতার পথ বেছে নেওয়া হতে পারে। এতে উন্নয়ন সহায়তা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ থাকবে, কিন্তু চীনবিরোধী জোটে আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ নাও থাকতে পারে।
চীনের দৃষ্টিভঙ্গি: সব পরিস্থিতিতে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক জোরদার
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অবনতির ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। বেইজিং ‘সব পরিস্থিতির বন্ধুত্ব’ নীতিতে বিশ্বাস করে। ঢাকায় যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের সঙ্গেই কাজ করার কৌশল নিয়েছে চীন। ভারতের সঙ্গে তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও গভীর হওয়ার পথে রয়েছে।
চীন বিএনপি সরকারের সম্ভাবনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। এর পেছনে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিএনপি সরকার এলে এই প্রবণতা আরও জোরদার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের জুন মাসে চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুন ওয়েইদং একটি বিএনপি প্রতিনিধিদলকে বলেন, চীন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুর্বল হওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, চীন তা পূরণ করতে চাইছে।
তারেক রহমানও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচিত হলে চীনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবুল মঈন খান বলেন, বিএনপির প্রথম পদক্ষেপ হবে চীনের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী করা।
চীন মনে করে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন তাদের বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রভাব মোকাবিলাও চীনের কৌশলগত লক্ষ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের নীরব ও ধারাবাহিক কূটনীতি তাদের বড় শক্তিতে পরিণত করেছে। নির্বাচনের আগেই তারা বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চীন নিজেকে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকারী শক্তি হিসেবে নয়।
পাকিস্তানের অবস্থান: উষ্ণ সম্পর্ক ও ইতিহাসের নতুন মূল্যায়ন
তারেক রহমান বলেছেন বিএনপি ভারত বা পাকিস্তান কারও সঙ্গেই বিশেষ ঘনিষ্ঠতা চাইবে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে বাংলাদেশের স্বার্থ। সে হিসেবেই একটি বাস্তবভিত্তিক সমন্বয়ের পথ তৈরি হচ্ছে। এখানে নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা একটি বড় ভূমিকা রাখছে। গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক উষ্ণ হয়েছে। এই পরিবর্তন দুই দেশের কূটনীতিতে নতুন গতি এনেছে।
পাকিস্তান বিএনপিকে ইতিবাচকভাবে দেখে। তারা মনে করে, বিএনপি বাস্তবভিত্তিক কূটনীতি অনুসরণ করবে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগও এখানে ভূমিকা রাখছে। পাকিস্তান শেখ হাসিনাবিরোধী জনমতকে কাজে লাগিয়েছে। তারা ‘জুলাই বিপ্লব’-এর প্রতি সমর্থন দেখিয়ে নতুন অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানের হাইকমিশনারসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
এই সম্পর্কোন্নয়ন ভারতের জন্য নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে। দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এতে পুরোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি আবার মাথাচাড়া দিতে পারে। ভারতের আশঙ্কা, সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে পাকিস্তানের আইএসআই বাংলাদেশে আবার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির ঝুঁকি বাড়তে পারে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক ধীরে ও সতর্কভাবে এগোচ্ছে। এটি প্রকাশ্য কোনো জোট নয়। বরং নীরব কূটনীতির মাধ্যমে গড়ে ওঠা একটি সীমিত সমন্বয়। এই পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও শক্তির ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
সামগ্রিক সমীকরণ ও বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বহুমুখী কূটনীতির দিকে এগোচ্ছে। ভারতের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে চীন, পাকিস্তান এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো হচ্ছে। চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতায় বিএনপি সরকারের সময়ও বেইজিং, ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ প্রভীন দোন্থি সতর্ক করেছেন, আঞ্চলিক উদ্যোগ থেকে ভারতকে বাদ দিলে ব্যবধান আরও বাড়তে পারে। এতে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা তীব্র হতে পারে। অন্যদিকে, স্টিমসন সেন্টারের আলোচনায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি নিয়মিত মনোযোগ রাখা জরুরি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। এজন্য ভারতকেও তাদের আধিপত্যবাদী মনোভাব বদলাতে হবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ভারতের ওপর একক নির্ভরতা থেকে সরে এসে বহুমুখী ও অস্থির শক্তির ভারসাম্যের দিকে এগোচ্ছে। ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি বাস্তবে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা আছে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগিতা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমিত ও কৌশলগত সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা চলবে।
এই পরিবর্তনে বড় শক্তিগুলোর কৌশলও বদলে যাচ্ছে। ভারত তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অবস্থান হারানোর আশঙ্কায় পড়েছে। ফলে তারা সংযম ও নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি নিতে পারে। চীন এই পরিস্থিতিকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে তারা কেবল বাণিজ্যিক অংশীদার নয়, বরং একটি কৌশলগত ভিত্তি গড়ে তুলতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে রয়েছে ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতাকে তারা বেশি গুরুত্ব দিতে পারে।
তারেক রহমানের সাফল্য নির্ভর করবে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতার ওপর। তাকে চীনের অর্থায়ন কাজে লাগাতে হবে, কিন্তু ঋণের ফাঁদে পড়া যাবে না। ভারতের সঙ্গে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে, কিন্তু এমনভাবে নয় যাতে অবরোধের ঝুঁকি তৈরি হয়। একই সঙ্গে ইসলামপন্থী মিত্রদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে, তবে পশ্চিমা বিশ্বকে দূরে ঠেলে না দিয়ে।
বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর ২০২৫) ঢাকায় পা রাখার সময় তারেক রহমান শুধু একটি দলের আশা নয়, পুরো অঞ্চলের উদ্বেগও সঙ্গে করে আনছেন। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ এখন আর স্থির নয়। এটি নতুন করে লেখা হচ্ছে।
বড় শক্তিগুলো এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ খুঁজছে। চীন সক্রিয়ভাবে এগোচ্ছে। পাকিস্তান বেশ উৎসাহী। শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন এবং চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণের ওপর।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরছেন। এই প্রত্যাবর্তন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন দেশে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি নির্বাচনী লড়াইয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা আঞ্চলিক রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বড় বড় শক্তিধর দেশের প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশ তিনদিকে ভারতঘেরা হলেও বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার রয়েছে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ সমবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে। বিপরীতে, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে উষ্ণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র জোরদারের কথা বলছে। তবে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তারা সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কাঠামো একটি বড় ধরনের পুনর্বিন্যাসের মুখে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির সম্পর্ক নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যে ‘স্বর্ণযুগ’ ছিল, তা কার্যত শেষ হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে একটি বহুমুখী ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির পথ তৈরি হচ্ছে, যা তারেক রহমান ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এই নীতিতে কোনো আঞ্চলিক শক্তির অধীনতা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এই নীতির মূল কথা হবে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কোনো একক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়ানো। ‘দিল্লিও নয়, পিন্ডিও নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ’, এই স্লোগান তার নীতির কেন্দ্রবিন্দু। এর মাধ্যমে তিনি দুটি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চান। একদিকে তিনি বিএনপির ওপর থাকা পাকিস্তানপন্থী তকমা ঝেড়ে ফেলতে চান। অন্যদিকে তিনি ভারতের আধিপত্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করছেন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপি ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন অংশীদার খুঁজতে চায়। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় পররাষ্ট্রনীতি হবে বাস্তবভিত্তিক ও সংযত। অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের দিকে ঝোঁক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সতর্ক সম্পর্ক উন্নয়ন বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রা দেবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের সম্ভাব্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই সমীকরণে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যই আগামী দিনের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বাস্তবতা নির্ধারণ করবে।
ভারতের অবস্থান: সম্পর্কের টানাপোড়েন ও প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখেছে। শেখ হাসিনার ভারত অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। তারেক রহমান নিজেও এ বিষয়ে সরব ছিলেন। গত অক্টোবরে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভারত যদি একজন স্বৈরশাসককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরাগভাজন হয়, তবে এতে তাদের কিছু করার নেই। বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করেছে যে সম্পর্ক শীতল থাকবে।
তবে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি সরকারে এলে ভারতের সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা হতে পারে। যদিও সেখানে সার্বভৌমত্বকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নতুন করে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ এনে দেবে।
ভারতকে পরমার্শ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন এই সম্পর্ককে নতুন করে ঢেলে সাজানোর একটি সুযোগ এনে দেবে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত ও বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির স্বার্থ রক্ষার জন্য এই দলটিই সম্ভবত এখন সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষক চিয়েতিজ বাজপাইয়ের মতে, আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত থাকায় ভারত বাধ্য হয়েই বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে পারে। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক আর কৌশলগত অংশীদারত্বে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি হবে স্বার্থভিত্তিক ও লেনদেননির্ভর সহাবস্থান।
তবে এর জন্য ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ বা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ কমানোর মতো পদক্ষেপ আশা করা হতে পারে। এসব বিষয়ে অগ্রগতি না হলে সম্পর্ক দীর্ঘদিন শীতল থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিকল্প অংশীদার খোঁজার পথে এগোতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র: গণতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন, তবে কৌশলগত সতর্কতা
যুক্তরাষ্ট্র অতীতে তারেক রহমানসহ বিএনপির অনেক নেতার বিষয়ে সমালোচনামুখর ছিল। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে একটি সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক বিকল্প হিসেবে দেখছে। তারেক রহমান এবং বিএনপি নেতারাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, এতে ভারত ও চীনের প্রভাবে ভারসাম্য আনা সম্ভব।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশকে বহুমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তার ভাষায়, নির্বাচিত বিএনপি সরকার শক্ত অবস্থান থেকে বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব স্বীকার করে। তবে তারা দ্রুত কোনো একপাক্ষিক জোটে জড়াতে চায় না। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা, ইসলামপন্থী উগ্রবাদ ঠেকানো এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখা। তারেক রহমান পশ্চিমা সমর্থন আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক শক্তি।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হোক। তবে তারেক রহমানের সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে সরাসরি কোনো জোটে যোগদানে অনীহা থাকতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সীমিত সহযোগিতার পথ বেছে নেওয়া হতে পারে। এতে উন্নয়ন সহায়তা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ থাকবে, কিন্তু চীনবিরোধী জোটে আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ নাও থাকতে পারে।
চীনের দৃষ্টিভঙ্গি: সব পরিস্থিতিতে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক জোরদার
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অবনতির ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। বেইজিং ‘সব পরিস্থিতির বন্ধুত্ব’ নীতিতে বিশ্বাস করে। ঢাকায় যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের সঙ্গেই কাজ করার কৌশল নিয়েছে চীন। ভারতের সঙ্গে তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও গভীর হওয়ার পথে রয়েছে।
চীন বিএনপি সরকারের সম্ভাবনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। এর পেছনে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিএনপি সরকার এলে এই প্রবণতা আরও জোরদার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের জুন মাসে চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুন ওয়েইদং একটি বিএনপি প্রতিনিধিদলকে বলেন, চীন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুর্বল হওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, চীন তা পূরণ করতে চাইছে।
তারেক রহমানও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচিত হলে চীনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবুল মঈন খান বলেন, বিএনপির প্রথম পদক্ষেপ হবে চীনের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী করা।
চীন মনে করে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন তাদের বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রভাব মোকাবিলাও চীনের কৌশলগত লক্ষ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের নীরব ও ধারাবাহিক কূটনীতি তাদের বড় শক্তিতে পরিণত করেছে। নির্বাচনের আগেই তারা বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চীন নিজেকে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকারী শক্তি হিসেবে নয়।
পাকিস্তানের অবস্থান: উষ্ণ সম্পর্ক ও ইতিহাসের নতুন মূল্যায়ন
তারেক রহমান বলেছেন বিএনপি ভারত বা পাকিস্তান কারও সঙ্গেই বিশেষ ঘনিষ্ঠতা চাইবে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে বাংলাদেশের স্বার্থ। সে হিসেবেই একটি বাস্তবভিত্তিক সমন্বয়ের পথ তৈরি হচ্ছে। এখানে নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা একটি বড় ভূমিকা রাখছে। গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক উষ্ণ হয়েছে। এই পরিবর্তন দুই দেশের কূটনীতিতে নতুন গতি এনেছে।
পাকিস্তান বিএনপিকে ইতিবাচকভাবে দেখে। তারা মনে করে, বিএনপি বাস্তবভিত্তিক কূটনীতি অনুসরণ করবে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগও এখানে ভূমিকা রাখছে। পাকিস্তান শেখ হাসিনাবিরোধী জনমতকে কাজে লাগিয়েছে। তারা ‘জুলাই বিপ্লব’-এর প্রতি সমর্থন দেখিয়ে নতুন অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানের হাইকমিশনারসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
এই সম্পর্কোন্নয়ন ভারতের জন্য নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে। দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এতে পুরোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি আবার মাথাচাড়া দিতে পারে। ভারতের আশঙ্কা, সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে পাকিস্তানের আইএসআই বাংলাদেশে আবার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির ঝুঁকি বাড়তে পারে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক ধীরে ও সতর্কভাবে এগোচ্ছে। এটি প্রকাশ্য কোনো জোট নয়। বরং নীরব কূটনীতির মাধ্যমে গড়ে ওঠা একটি সীমিত সমন্বয়। এই পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও শক্তির ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
সামগ্রিক সমীকরণ ও বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বহুমুখী কূটনীতির দিকে এগোচ্ছে। ভারতের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে চীন, পাকিস্তান এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো হচ্ছে। চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতায় বিএনপি সরকারের সময়ও বেইজিং, ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ প্রভীন দোন্থি সতর্ক করেছেন, আঞ্চলিক উদ্যোগ থেকে ভারতকে বাদ দিলে ব্যবধান আরও বাড়তে পারে। এতে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা তীব্র হতে পারে। অন্যদিকে, স্টিমসন সেন্টারের আলোচনায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি নিয়মিত মনোযোগ রাখা জরুরি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। এজন্য ভারতকেও তাদের আধিপত্যবাদী মনোভাব বদলাতে হবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ভারতের ওপর একক নির্ভরতা থেকে সরে এসে বহুমুখী ও অস্থির শক্তির ভারসাম্যের দিকে এগোচ্ছে। ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি বাস্তবে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা আছে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগিতা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমিত ও কৌশলগত সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা চলবে।
এই পরিবর্তনে বড় শক্তিগুলোর কৌশলও বদলে যাচ্ছে। ভারত তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অবস্থান হারানোর আশঙ্কায় পড়েছে। ফলে তারা সংযম ও নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি নিতে পারে। চীন এই পরিস্থিতিকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে তারা কেবল বাণিজ্যিক অংশীদার নয়, বরং একটি কৌশলগত ভিত্তি গড়ে তুলতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে রয়েছে ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতাকে তারা বেশি গুরুত্ব দিতে পারে।
তারেক রহমানের সাফল্য নির্ভর করবে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতার ওপর। তাকে চীনের অর্থায়ন কাজে লাগাতে হবে, কিন্তু ঋণের ফাঁদে পড়া যাবে না। ভারতের সঙ্গে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে, কিন্তু এমনভাবে নয় যাতে অবরোধের ঝুঁকি তৈরি হয়। একই সঙ্গে ইসলামপন্থী মিত্রদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে, তবে পশ্চিমা বিশ্বকে দূরে ঠেলে না দিয়ে।
বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর ২০২৫) ঢাকায় পা রাখার সময় তারেক রহমান শুধু একটি দলের আশা নয়, পুরো অঞ্চলের উদ্বেগও সঙ্গে করে আনছেন। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ এখন আর স্থির নয়। এটি নতুন করে লেখা হচ্ছে।
বড় শক্তিগুলো এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ খুঁজছে। চীন সক্রিয়ভাবে এগোচ্ছে। পাকিস্তান বেশ উৎসাহী। শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন এবং চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণের ওপর।

দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
২ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের গুলিতে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম সারির নেতা শরিফ ওসমান হাদির নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর জেরে বাংলাদেশজুড়ে ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের আশপাশেও বিক্ষোভ হয়।
২ দিন আগে
সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব আয়োজিত ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভাটি বাংলাদেশের সমকালীন সমাজ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
৩ দিন আগে
জাতীয় সঞ্চয়পত্র হলো সরকারের একটি ঋণ নেওয়ার মাধ্যম। সরকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়। এর বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা দেয়। এই মুনাফার হার স্থায়ী নয়। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী তা বাড়ে বা কমে। ডাকঘর ও ব্যাংকের মাধ্যমে এসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়। এতে মুনাফা নিশ্চিত থাকে।
৩ দিন আগে