মাহবুবুল আলম তারেক

বিশ্ব রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন আরও তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশের পর এ আলোচনা আরও জোরালো হয়। ওই নথি প্রকাশের পর ইউরোপকে বহু দিক থেকে অভূতপূর্ব চাপের মুখে থাকা একটি মহাদেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা হ্রাস, রাশিয়ার আগ্রাসী পদক্ষেপ, এবং চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে ইউরোপ এই পরিস্থিতে পড়েছে।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ নোয়াহ স্মিথ ইউরোপের বর্তমান অবস্থাকে ১৭ শতকের ‘ডেলিউজ’–এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেসময় ১৬৪৮ থেকে ১৬৬৭ সালের মধ্যে সংঘটিত এক ধারাবাহিক যুদ্ধ পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথকে বিধ্বস্ত করেছিল। সুইডেন ও রাশিয়া ব্যাপক সামরিক আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি খমেলনিতস্কি বিদ্রোহও অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ঘটনাগুলো কমনওয়েলথকে গভীরভাবে দুর্বল করে এবং ভেঙে দেয়। বর্তমান ইউরোপও একই পরিস্থিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো কনস্টানৎসে স্টেলৎসেনমুলার ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে ‘মিত্রতার নীতি থেকে সম্পূর্ণ সরে আসার ঘোষণা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, নথিটি মিত্রদেশগুলোর জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয়কে বাড়তি বোঝা হিসেবে বিবেচনা করে। একই সঙ্গে অভিবাসনকে প্রধান হুমকি হিসেবে তুলে ধরে। এসব অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা কমিয়ে ইউরোপকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো জুডি ডেম্পসি সতর্ক করেছেন, ইউরোপের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ট্রাম্পের অবজ্ঞা এবং চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন পশ্চিমা জোটের ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে। তাঁর মতে, এসব অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের এমন হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করে যা পশ্চিমা জোটের মূল মূল্যবোধকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইউরোপের একা হওয়ার অর্থ কী?
ইউরোপের একা হওয়া বলতে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হওয়াকে বোঝায়। ন্যাটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের নিরাপত্তার প্রধান গ্যারান্টার ছিল। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মহাদেশের অর্থনৈতিক সংহতির ভিত শক্ত করেছে।
তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বদেশমুখী নীতি, রাশিয়ার চলমান ইউক্রেন আগ্রাসন এবং চীনের উত্থান ইউরোপকে বড় শক্তির প্রতিযোগিতার প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
নোয়াহ স্মিথ বলেন, দুর্বল ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক, রাশিয়ার হাইব্রিড হুমকি (যেমন নাশকতা ও ড্রোন অনুপ্রবেশ), এবং চীনের বাণিজ্যিক আধিপত্য ইউরোপের অবস্থানকে আরও বিপন্ন করেছে।
কিছু আলোচনায়ও ইউরোপকে নতুন যুগে ‘সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত’ খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি, চীনের বাণিজ্যিক দখল এবং রাশিয়ার যুদ্ধ—এ তিন চাপ একসঙ্গে ইউরোপকে সংকটে ফেলেছে।
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসন এটিকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি’ বলে মন্তব্য করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া: মিত্র থেকে সমালোচক
ইউরোপের বিচ্ছিন্নতা বাড়ার অন্যতম কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে প্রকাশিত এই কৌশলে সম্পর্কে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভিনদেশি হুমকি হিসেবে ‘অতিরিক্ত অভিবাসন’-কে তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি চীন, রাশিয়া বা সন্ত্রাসবাদ থেকেও বড় হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে ইউরোপ সভ্যতাগত দিক থেকে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে বলে সমালোচনা করা হয়েছে। অভিবাসন নীতির কারণে পশ্চিমা ‘সভ্যতার ক্ষয়’ ঘটছে এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। নথিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিগুলোকেও ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বিপরীতে রাশিয়ার প্রতি তুলনামূলকভাবে কম কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এবং ‘কৌশলগত স্থিতি’ অর্জনের জন্য অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ক্রেমলিনের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
নোয়াহ স্মিথের বিশ্লেষণ বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে ইউরোপকে সমর্থন করেছিল, যেমন কমিউনিজমবিরোধিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ‘শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান’ ঐতিহ্য, সেগুলোও এখন দুর্বল হয়ে গেছে। ট্রাম্পের কৌশলে ইউরোপকে অভিবাসী বহিষ্কার ও ‘খ্রিস্টান মূল্যবোধ’ পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর থেকে জরিমানা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের গবেষকদের মতে, এটি ‘পশ্চিমা জোটের অবসান’-এর ইঙ্গিত দেয় এবং ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় ‘চতুর্থ স্থানে’ নামিয়ে আনে। তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন ধরণের সম্পর্ক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।
রাশিয়া ও চীন থেকে আসা হুমকি: পূর্ব দিকের অবরোধ
২০২২ সাল থেকে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন ইউরোপের ওপর ‘অবরোধ’ ধরনের চাপ তৈরি করে। নোয়াহ স্মিথের মতে, রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো বা পোল্যান্ড।
অসলো-ভিত্তিক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অধ্যাপক পাওয়েল কে বায়েভ বলেন, ট্রাম্পের কৌশলে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নথিটি রাশিয়ার ভূমিকা ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট করে দেখিয়েছে, যা রাশিয়াকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ সীমানায় ঠেলে দিতে পারে। এতে ইউরোপ আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
লাটভিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্রিশিয়ানিস কারিন্স বলেছেন, ‘নথিটি পড়ে সবচেয়ে খুশি হবে রাশিয়া।’ তাঁর মতে, মস্কো বহুদিন ধরে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক দুর্বল করার চেষ্টা করছে, আর বর্তমানে মনে হচ্ছে সেই প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে উঠেছে।
চীন এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। দেশটি রাশিয়াকে প্রযুক্তি, ড্রোন এবং গোয়েন্দা সহায়তা দিচ্ছে। পাশাপাশি চীন ইউরোপের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়ও আধিপত্য বজায় রেখেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের ভর্তুকি ও নিষেধাজ্ঞা ইউরোপের শিল্প খাতকে দুর্বল করছে।
অনেকেই বলছেন, চীন ইউরোপকে ‘গলা টিপে ধরেছে’। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীন বিষয়ে নমনীয় অবস্থান নেওয়া হয়েছে এবং বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে, যা ইউরোপকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড্যানি হাইফং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ইউরোপকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘এক ব্যর্থ যুদ্ধের’ কারণে নিজের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করতে বাধ্য করেছে। এখন ইউরোপ আবার যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে চীন থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের ‘মিত্র নয়, বরং কবর খননকারী’র ভূমিকা পালন করছে।
হাঙ্গেরির রাজনীতিবিদ বালাজ ওরবান, রাশিয়ার সঙ্গে শক্তি-সম্পর্ক ছিন্ন করা, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ঝুঁকিকে এই বিচ্ছিন্নতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ডট ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের ভাষাকে তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এ ধরনের ভাষা সাধারণত ‘ক্রেমলিনের অদ্ভুত চিন্তাধারার’ কাছ থেকে শোনা যায়। তাঁর বক্তব্য, নথিটির অবস্থান ‘ইউরোপের অতি-ডানপন্থী রাজনীতির ডানদিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে।’
তবে অনেকে দাবি করেছেন, স্থিতিশীলতার জন্য ইউরোপ ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর বেইজিং সফরকে এই প্রবণতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা: বিভাজন ও অকার্যকারিতা
ইউরোপের বিচ্ছিন্নতার একটি বড় কারণ হলো মহাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। ইতালীয় রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ মারিও দ্রাঘির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজার বিচ্ছিন্নতার কারণে ইইউ মোট সম্ভাব্য জিডিপির ১০ শতাংশ হারাচ্ছে। সামরিক ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। পুরোনো অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা এবং দেশভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব ইউরোপকে দুর্বল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৭ সালের মধ্যে ন্যাটোর নিরাপত্তা নেতৃত্ব ইউরোপের হাতে তুলে দিতে বলেছে।
হাঙ্গেরি ও ইতালির মতো দেশগুলোতে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি একতা নষ্ট করছে। ‘ইউরোস্ক্লেরোসিস’, অর্থাৎ নীতিনির্ধারণে জড়তা উদ্ভাবন ও অগ্রগতি ব্যাহত করছে। আলোচনায় অনেকেই ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদানে বিলম্বকে ‘কৌশলগত অন্ধত্ব’ বলে মন্তব্য করছেন। বিশেষ করে জার্মানির টরাস ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহে দেরি করার সমালোচনা হয়েছে।
ইতালিয়ান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইস্তিতুতো আফফারি ইন্টারনাজিওনালির পরিচালক নাটালি তোচি মন্তব্য করেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলে স্পষ্ট হয়েছে, তারা রাশিয়া-সমর্থিত চরম দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সমর্থন করে ইউরোপকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে তুলতে চাইছে। তাঁর মতে, এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন ইউরোপের বিচ্ছিন্নতাকে আরও তীব্র করবে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভেলিনা চাকারোভা এই মূল্যায়নের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপের ‘নিষ্ক্রিয়তা স্ব-সৃষ্ট হলেও তা পরিবর্তনযোগ্য।’ তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে ইউরোপ ‘বিশ্ব রাজনীতির পেছনের উঠোনে’ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল আসলে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা। তাঁর মতে, এটি ইউক্রেনের স্বাধীনতার লড়াইকে উপেক্ষা করে এবং ইউরোপকে নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো ইউরোপের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল করে একটি অ-উদার জনতুষ্টিবাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।
পরিস্থিতি কি অনিবার্য?
সব বিশ্লেষকই যে ইউরোপের দুরবস্থাকে চূড়ান্ত মনে করছেন, তা নয়। আশাবাদী মহল মনে করে ইউরোপ এখন ‘জেগে উঠছে।’ মহাদেশটি স্নায়ু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের তুলনায় দ্রুত পুনরায় অস্ত্রসজ্জিত হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নির্ভরযোগ্য অংশীদার খুঁজছে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক বিশ্লেষণে ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে ইউরোপের ‘কৌশলগত স্বনির্ভরতা’ অর্জনের জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ককে যে চাপের মুখে ফেলেছে, তা স্পষ্ট। এখন ইউরোপের প্রতিক্রিয়া, অর্থাৎ ঐক্য সুদৃঢ় করা, প্রতিরক্ষা জোরদার করা এবং অংশীদারত্ব বৈচিত্র্যময় করার মতো বিষয়ই নির্ধারণ করবে বিচ্ছিন্নতা কতটা স্থায়ী হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ছে, তবে এখনও অপ্রতিরোধ্য বা অপরিবর্তনীয় বলে মনে হয় না।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্যারিস অফিস প্রধান তারার ভার্মা মন্তব্য করেছেন যে ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ইউরোপকে ভয়-ভীতি, চাপ এবং প্রভাব বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হতে উৎসাহিত করছে। তাঁর মতে, এটি ইঙ্গিত করে যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় ইউরোপ নিজেকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের বিশ্লেষকরা উপসংহারে বলেছেন, ‘সমাধান হলো আরও বেশি ইউরোপ—কম নয়।’ তাঁদের মতে, ইউরোপের সমন্বয় ও উদার গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে দৃশ্যমান হুমকির মুখে ঐক্য আরও জোরদার করা জরুরি। তারা মনে করেন, ইউরোপের আছে পর্যাপ্ত অর্থ, মেধা, প্রযুক্তি এবং জনসংখ্যাগত শক্তি—যা বিশ্ব-বিন্যাস বদলে দিতে পারে। তবুও ইউরোপ দ্বিধা–দ্বন্দ্বে ভুগছে। তাঁদের ভাষায়, ২০২০-এর দশক একটি ‘সন্ধিক্ষণ’ এবং ইউরোপকে ‘জেগে উঠে সত্যিকারের মহাশক্তির মতো আচরণ’করতে হবে।
ভারত, জাপান বা পুনরায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে জোট গড়ে তোলার সম্ভাবনাও আলোচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপকে ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ গ্রহণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে, নচেৎ বিশ্ব রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে।
সবশেষে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দৃশ্যপটে দুটি দিক দেখা যায়: একদিকে, শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ, যা বড় শক্তিগুলোর চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম; অন্যদিকে, রাশিয়া-চীন প্রভাববলয়ে ইউরোপের ধীরে ধীরে অধস্তন ভূমিকা।
তথ্যসূত্র: এশিয়া টাইমস, আল-জাজিরা নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স

বিশ্ব রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন আরও তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশের পর এ আলোচনা আরও জোরালো হয়। ওই নথি প্রকাশের পর ইউরোপকে বহু দিক থেকে অভূতপূর্ব চাপের মুখে থাকা একটি মহাদেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা হ্রাস, রাশিয়ার আগ্রাসী পদক্ষেপ, এবং চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে ইউরোপ এই পরিস্থিতে পড়েছে।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ নোয়াহ স্মিথ ইউরোপের বর্তমান অবস্থাকে ১৭ শতকের ‘ডেলিউজ’–এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেসময় ১৬৪৮ থেকে ১৬৬৭ সালের মধ্যে সংঘটিত এক ধারাবাহিক যুদ্ধ পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথকে বিধ্বস্ত করেছিল। সুইডেন ও রাশিয়া ব্যাপক সামরিক আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি খমেলনিতস্কি বিদ্রোহও অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ঘটনাগুলো কমনওয়েলথকে গভীরভাবে দুর্বল করে এবং ভেঙে দেয়। বর্তমান ইউরোপও একই পরিস্থিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো কনস্টানৎসে স্টেলৎসেনমুলার ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে ‘মিত্রতার নীতি থেকে সম্পূর্ণ সরে আসার ঘোষণা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, নথিটি মিত্রদেশগুলোর জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয়কে বাড়তি বোঝা হিসেবে বিবেচনা করে। একই সঙ্গে অভিবাসনকে প্রধান হুমকি হিসেবে তুলে ধরে। এসব অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা কমিয়ে ইউরোপকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো জুডি ডেম্পসি সতর্ক করেছেন, ইউরোপের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ট্রাম্পের অবজ্ঞা এবং চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন পশ্চিমা জোটের ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে। তাঁর মতে, এসব অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের এমন হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করে যা পশ্চিমা জোটের মূল মূল্যবোধকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইউরোপের একা হওয়ার অর্থ কী?
ইউরোপের একা হওয়া বলতে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হওয়াকে বোঝায়। ন্যাটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের নিরাপত্তার প্রধান গ্যারান্টার ছিল। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মহাদেশের অর্থনৈতিক সংহতির ভিত শক্ত করেছে।
তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বদেশমুখী নীতি, রাশিয়ার চলমান ইউক্রেন আগ্রাসন এবং চীনের উত্থান ইউরোপকে বড় শক্তির প্রতিযোগিতার প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
নোয়াহ স্মিথ বলেন, দুর্বল ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক, রাশিয়ার হাইব্রিড হুমকি (যেমন নাশকতা ও ড্রোন অনুপ্রবেশ), এবং চীনের বাণিজ্যিক আধিপত্য ইউরোপের অবস্থানকে আরও বিপন্ন করেছে।
কিছু আলোচনায়ও ইউরোপকে নতুন যুগে ‘সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত’ খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি, চীনের বাণিজ্যিক দখল এবং রাশিয়ার যুদ্ধ—এ তিন চাপ একসঙ্গে ইউরোপকে সংকটে ফেলেছে।
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসন এটিকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি’ বলে মন্তব্য করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া: মিত্র থেকে সমালোচক
ইউরোপের বিচ্ছিন্নতা বাড়ার অন্যতম কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে প্রকাশিত এই কৌশলে সম্পর্কে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভিনদেশি হুমকি হিসেবে ‘অতিরিক্ত অভিবাসন’-কে তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি চীন, রাশিয়া বা সন্ত্রাসবাদ থেকেও বড় হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে ইউরোপ সভ্যতাগত দিক থেকে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে বলে সমালোচনা করা হয়েছে। অভিবাসন নীতির কারণে পশ্চিমা ‘সভ্যতার ক্ষয়’ ঘটছে এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। নথিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিগুলোকেও ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বিপরীতে রাশিয়ার প্রতি তুলনামূলকভাবে কম কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এবং ‘কৌশলগত স্থিতি’ অর্জনের জন্য অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ক্রেমলিনের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
নোয়াহ স্মিথের বিশ্লেষণ বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে ইউরোপকে সমর্থন করেছিল, যেমন কমিউনিজমবিরোধিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ‘শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান’ ঐতিহ্য, সেগুলোও এখন দুর্বল হয়ে গেছে। ট্রাম্পের কৌশলে ইউরোপকে অভিবাসী বহিষ্কার ও ‘খ্রিস্টান মূল্যবোধ’ পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর থেকে জরিমানা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের গবেষকদের মতে, এটি ‘পশ্চিমা জোটের অবসান’-এর ইঙ্গিত দেয় এবং ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় ‘চতুর্থ স্থানে’ নামিয়ে আনে। তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন ধরণের সম্পর্ক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।
রাশিয়া ও চীন থেকে আসা হুমকি: পূর্ব দিকের অবরোধ
২০২২ সাল থেকে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন ইউরোপের ওপর ‘অবরোধ’ ধরনের চাপ তৈরি করে। নোয়াহ স্মিথের মতে, রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো বা পোল্যান্ড।
অসলো-ভিত্তিক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অধ্যাপক পাওয়েল কে বায়েভ বলেন, ট্রাম্পের কৌশলে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নথিটি রাশিয়ার ভূমিকা ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট করে দেখিয়েছে, যা রাশিয়াকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ সীমানায় ঠেলে দিতে পারে। এতে ইউরোপ আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
লাটভিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্রিশিয়ানিস কারিন্স বলেছেন, ‘নথিটি পড়ে সবচেয়ে খুশি হবে রাশিয়া।’ তাঁর মতে, মস্কো বহুদিন ধরে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক দুর্বল করার চেষ্টা করছে, আর বর্তমানে মনে হচ্ছে সেই প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে উঠেছে।
চীন এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। দেশটি রাশিয়াকে প্রযুক্তি, ড্রোন এবং গোয়েন্দা সহায়তা দিচ্ছে। পাশাপাশি চীন ইউরোপের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়ও আধিপত্য বজায় রেখেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের ভর্তুকি ও নিষেধাজ্ঞা ইউরোপের শিল্প খাতকে দুর্বল করছে।
অনেকেই বলছেন, চীন ইউরোপকে ‘গলা টিপে ধরেছে’। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীন বিষয়ে নমনীয় অবস্থান নেওয়া হয়েছে এবং বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে, যা ইউরোপকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড্যানি হাইফং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ইউরোপকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘এক ব্যর্থ যুদ্ধের’ কারণে নিজের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করতে বাধ্য করেছে। এখন ইউরোপ আবার যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে চীন থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের ‘মিত্র নয়, বরং কবর খননকারী’র ভূমিকা পালন করছে।
হাঙ্গেরির রাজনীতিবিদ বালাজ ওরবান, রাশিয়ার সঙ্গে শক্তি-সম্পর্ক ছিন্ন করা, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ঝুঁকিকে এই বিচ্ছিন্নতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ডট ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের ভাষাকে তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এ ধরনের ভাষা সাধারণত ‘ক্রেমলিনের অদ্ভুত চিন্তাধারার’ কাছ থেকে শোনা যায়। তাঁর বক্তব্য, নথিটির অবস্থান ‘ইউরোপের অতি-ডানপন্থী রাজনীতির ডানদিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে।’
তবে অনেকে দাবি করেছেন, স্থিতিশীলতার জন্য ইউরোপ ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর বেইজিং সফরকে এই প্রবণতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা: বিভাজন ও অকার্যকারিতা
ইউরোপের বিচ্ছিন্নতার একটি বড় কারণ হলো মহাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। ইতালীয় রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ মারিও দ্রাঘির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজার বিচ্ছিন্নতার কারণে ইইউ মোট সম্ভাব্য জিডিপির ১০ শতাংশ হারাচ্ছে। সামরিক ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। পুরোনো অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা এবং দেশভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব ইউরোপকে দুর্বল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৭ সালের মধ্যে ন্যাটোর নিরাপত্তা নেতৃত্ব ইউরোপের হাতে তুলে দিতে বলেছে।
হাঙ্গেরি ও ইতালির মতো দেশগুলোতে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি একতা নষ্ট করছে। ‘ইউরোস্ক্লেরোসিস’, অর্থাৎ নীতিনির্ধারণে জড়তা উদ্ভাবন ও অগ্রগতি ব্যাহত করছে। আলোচনায় অনেকেই ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদানে বিলম্বকে ‘কৌশলগত অন্ধত্ব’ বলে মন্তব্য করছেন। বিশেষ করে জার্মানির টরাস ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহে দেরি করার সমালোচনা হয়েছে।
ইতালিয়ান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইস্তিতুতো আফফারি ইন্টারনাজিওনালির পরিচালক নাটালি তোচি মন্তব্য করেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলে স্পষ্ট হয়েছে, তারা রাশিয়া-সমর্থিত চরম দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সমর্থন করে ইউরোপকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে তুলতে চাইছে। তাঁর মতে, এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন ইউরোপের বিচ্ছিন্নতাকে আরও তীব্র করবে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভেলিনা চাকারোভা এই মূল্যায়নের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপের ‘নিষ্ক্রিয়তা স্ব-সৃষ্ট হলেও তা পরিবর্তনযোগ্য।’ তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে ইউরোপ ‘বিশ্ব রাজনীতির পেছনের উঠোনে’ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল আসলে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা। তাঁর মতে, এটি ইউক্রেনের স্বাধীনতার লড়াইকে উপেক্ষা করে এবং ইউরোপকে নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো ইউরোপের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল করে একটি অ-উদার জনতুষ্টিবাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।
পরিস্থিতি কি অনিবার্য?
সব বিশ্লেষকই যে ইউরোপের দুরবস্থাকে চূড়ান্ত মনে করছেন, তা নয়। আশাবাদী মহল মনে করে ইউরোপ এখন ‘জেগে উঠছে।’ মহাদেশটি স্নায়ু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের তুলনায় দ্রুত পুনরায় অস্ত্রসজ্জিত হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নির্ভরযোগ্য অংশীদার খুঁজছে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক বিশ্লেষণে ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে ইউরোপের ‘কৌশলগত স্বনির্ভরতা’ অর্জনের জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ককে যে চাপের মুখে ফেলেছে, তা স্পষ্ট। এখন ইউরোপের প্রতিক্রিয়া, অর্থাৎ ঐক্য সুদৃঢ় করা, প্রতিরক্ষা জোরদার করা এবং অংশীদারত্ব বৈচিত্র্যময় করার মতো বিষয়ই নির্ধারণ করবে বিচ্ছিন্নতা কতটা স্থায়ী হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ছে, তবে এখনও অপ্রতিরোধ্য বা অপরিবর্তনীয় বলে মনে হয় না।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্যারিস অফিস প্রধান তারার ভার্মা মন্তব্য করেছেন যে ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ইউরোপকে ভয়-ভীতি, চাপ এবং প্রভাব বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হতে উৎসাহিত করছে। তাঁর মতে, এটি ইঙ্গিত করে যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় ইউরোপ নিজেকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের বিশ্লেষকরা উপসংহারে বলেছেন, ‘সমাধান হলো আরও বেশি ইউরোপ—কম নয়।’ তাঁদের মতে, ইউরোপের সমন্বয় ও উদার গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে দৃশ্যমান হুমকির মুখে ঐক্য আরও জোরদার করা জরুরি। তারা মনে করেন, ইউরোপের আছে পর্যাপ্ত অর্থ, মেধা, প্রযুক্তি এবং জনসংখ্যাগত শক্তি—যা বিশ্ব-বিন্যাস বদলে দিতে পারে। তবুও ইউরোপ দ্বিধা–দ্বন্দ্বে ভুগছে। তাঁদের ভাষায়, ২০২০-এর দশক একটি ‘সন্ধিক্ষণ’ এবং ইউরোপকে ‘জেগে উঠে সত্যিকারের মহাশক্তির মতো আচরণ’করতে হবে।
ভারত, জাপান বা পুনরায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে জোট গড়ে তোলার সম্ভাবনাও আলোচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপকে ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ গ্রহণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে, নচেৎ বিশ্ব রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে।
সবশেষে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দৃশ্যপটে দুটি দিক দেখা যায়: একদিকে, শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ, যা বড় শক্তিগুলোর চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম; অন্যদিকে, রাশিয়া-চীন প্রভাববলয়ে ইউরোপের ধীরে ধীরে অধস্তন ভূমিকা।
তথ্যসূত্র: এশিয়া টাইমস, আল-জাজিরা নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ) তাদের বহর আধুনিকায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। শক্তিশালী অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ইউরোফাইটার টাইফুন কিনতে ইতালীয় প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিও’র সঙ্গে চুক্তি করেছে। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিমানবাহিনী সদর দপ্তরে এই সম্মতিপত্র সই করা হয়।
১ দিন আগে
চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ৩৩ পৃষ্ঠার নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) প্রকাশ করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকা সবার আগে’ ধারণাকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে।
২ দিন আগে
ইসরায়েল গাজাকে নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখছে, আর ফিলিস্তিনিরা একে দেখছে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মেরুকরণ যতদিন না কমবে, ততদিন যেকোনো যুদ্ধবিরতিই হবে ক্ষণস্থায়ী।
৩ দিন আগে
ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু বিনোদন নয়—মত প্রকাশ, পরিচয় নির্মাণ ও বিশ্বসংযোগেরও প্রধান মাধ্যম। এমন এক সময়ে অস্ট্রেলিয়া ১৬ বছরের নিচের ব্যবহারকারীদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার ঐতিহাসিক আইন পাস করেছে।
৩ দিন আগে