leadT1ad

সাহিত্যিকের আড়ালে প্রযুক্তিবিদ: উপেন্দ্রকিশোর রায়ের আরেকটি পরিচয়

সৈয়দ লতিফ হোসাইন
সৈয়দ লতিফ হোসাইন

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সংগৃহীত ছবি

বাঙালি পাঠক অথচ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে চেনেন না, এমনটা হয় না। এই নামটি বললেই বাংলা শিশুসাহিত্যের অগ্রদূত এক গল্পকারের ছবি ভেসে ওঠে। ছেলেদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, গুপী গাইন বাঘা বাইন, টুনটুনির বই—এগুলো তো বটেই, আরও অসংখ্য বই তাঁর হাতে লেখা। বিশেষ করে শিশুসাহিত্য। তাঁর হাতের কাজের কথা যদি বলতেই হয়, তবে বলতে হয় এই হাতে কত রকম বিচিত্র কাজই না করেছেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। তিনি ছিলেন একাধারে বেহালাবাদক, আলোকচিত্রী (ফটোগ্রাফার), চিত্রশিল্পী এবং দারুণ এক অলংকরণশিল্পী বা ইলাস্ট্রেটর। চিত্রশিল্পে তেলরঙ, জলরঙ, কালি ও কলম ব্যবহার করতেন; রীতিতে ছিলেন পাশ্চাত্য ধারার। নিজের লেখা বইগুলোর অলংকরণ তিনি নিজেই করতেন।

এত কিছুর পরও আমরা বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনি শুধু লেখক হিসেবেই। আর এই লেখক পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়—তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম মুদ্রণপ্রযুক্তিবিদ (প্রিন্টিং টেকনোলজিস্ট) ও ভিজ্যুয়াল রিপ্রোডাকশন গবেষক। কিন্তু কেন এমন বিষয়ে ঝুঁকলেন তিনি? মানের দিক থেকে ভীষণ খুঁতখুঁতে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর বইগুলোর ছাপার মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। আর তা থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যেই শুরু করেন মুদ্রণপ্রযুক্তি নিয়ে গভীর গবেষণা।

আজ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের জন্মদিনে তাঁকে শুধু গল্পকার হিসেবে স্মরণ করলে ছবিটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি সাহিত্য ও প্রযুক্তির মধ্যে কোনো দেয়াল দেখেননি। এই অচেনা পরিচয়টাই হয়তো আজকের পাঠকের জন্য সবচেয়ে বড় চমক (সারপ্রাইজ)। একটু বিস্তারিত বলা যাক।

‘এসেস অন হাফটোন ফটোগ্রাফি’। সংগৃহীত ছবি
‘এসেস অন হাফটোন ফটোগ্রাফি’। সংগৃহীত ছবি

ছবি ছাপানোর পুরোনো সংকট

ছাপাখানার ইতিহাসে লেখা ও ছবির (আলোকচিত্র) পথ দীর্ঘদিন আলাদা ছিল। লেখা ছাপানো যেত কাঠ বা ধাতব লেটার-ব্লকে। কিন্তু ছবি বলতে শুধু রেখাচিত্রই ছাপাতে হতো কাঠ বা ধাতুর প্লেটে হাতে এচিং করে। তখনো প্রচলিত ‘ব্লক’ ছাপার মতো করে কাঠের ব্লক থেকেও ছাপানো যেত। কিন্তু আলোকচিত্র? আলোকচিত্রের সূক্ষ্ম আলো-ছায়া, টোনাল গ্রেডেশন বা গভীরতা ঠিকভাবে ছাপায় ফুটিয়ে তোলা যেত না।

এই সমস্যার কার্যকর সমাধান আসে হাফটোন পদ্ধতির মাধ্যমে—যেখানে ছবিকে ভেঙে ফেলা হয় অসংখ্য ক্ষুদ্র ডটে। দূর থেকে দেখলে এই ডটগুলো মিলেই তৈরি করে আলো-ছায়ার ভ্রম। সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, একটি আলোকচিত্রকে একটি ছাঁকনি বা চালুনির ভেতর দিয়ে দেখলে ছবিটিকে মনে হবে অসংখ্য ডট দিয়ে তৈরি। ঠিক যেভাবে একটি ফিল্মের ভেতর দিয়ে পর্দায় আলো ফেলে আমরা সিনেমা হলে সিনেমা দেখি, সেভাবেই ছবির ফিল্ম বা নেগেটিভের ওপরে বা নিচে একটি চালুনি রেখে তার ভেতর দিয়ে আলো প্রক্ষেপণ করা হয় একটি ধাতব প্লেটের ওপর। আলো ফেলার এই কাজটাকেই পেশাদাররা বলেন এক্সপোজার। আলোকচিত্রশিল্পের মতোই সেই এক্সপোজার হতে হয় আলোর তীব্রতা, সময়, প্লেটে মাখানো আলোক-সংবেদনশীল রাসায়নিকের সংবেদনশীলতা—এই সবকিছুর জটিল হিসাব-নিকাশ করেই; নয়তো ছবির মান বজায় থাকবে না।

উপেন্দ্রকিশোরের গবেষণা

উনিশ শতকের শেষ ভাগে উপেন্দ্রকিশোর রায় এই হাফটোন সমস্যাটি নিয়ে গভীরভাবে কাজ শুরু করেন। আনুমানিক ১৮৯৫ সালের পর থেকে তিনি আলোকচিত্রকে সরাসরি ছাপার উপযোগী মেটাল হাফটোন ব্লক তৈরির পদ্ধতি নিয়ে ধারাবাহিক পরীক্ষা চালান। স্ক্রিন অ্যাঙ্গেল, ডট স্ট্রাকচার, ক্যামেরা অপটিকস এবং এক্সপোজারের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ—সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজস্ব উন্নয়ন সাধন করেন।

১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে তিনি ব্রিটেনের বিখ্যাত গ্রাফিক আর্টস বার্ষিকী ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’-এ একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ঔপনিবেশিক ভারতের একজন গবেষকের লেখা হিসেবে এই কাজ ইউরোপীয় মুদ্রণ মহলেও গুরুত্ব পায়। এই প্রবন্ধগুলো পরবর্তী সময়ে সংকলিত হয় ‘এসেস অন হাফটোন ফটোগ্রাফি’ নামে—যা কার্যত তাঁর প্রযুক্তিগত গবেষণার পূর্ণাঙ্গ দলিল।

বাংলা ছাপাখানায় আধুনিকতার ছোঁয়া

উপেন্দ্রকিশোরের গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ ঘটে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’-এ। বাংলা বইয়ে ছবি ও অলংকরণের মান আমূল বদলে যায়। শিশুসাহিত্যের বই শুধু পাঠযোগ্য নয়, হয়ে ওঠে দৃশ্যমানভাবেও আকর্ষণীয়। লেখা, ছবি ও ছাপা—এই তিনটি মাধ্যম একত্রে কাজ করতে শুরু করে।

এখানে লক্ষণীয়, উপেন্দ্রকিশোর প্রযুক্তিকে কখনোই আলাদা কোনো যান্ত্রিক দক্ষতা হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে ছাপাখানা ছিল সাহিত্য ও শিল্পের সম্প্রসারণ।

লেখক: গ্রাফিক ডিজাইনার, আলোকচিত্রী ও লেখক

Ad 300x250

সম্পর্কিত