leadT1ad

জন লেননের ‘ইমাজিন’ কোন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়, কেন গানটি আজও প্রাসঙ্গিক

আজ ৮ ডিসেম্বর জন লেননের মৃত্যুদিন। দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড বিটলস-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য লেনন ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, লেখক ও শান্তিকর্মী। ‘ইমাজিন’ তাঁর বিখ্যাত গান। এই গানে তিনি কোন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন? কেন গানটি আজও এত প্রাসঙ্গিক?

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ১৯
স্ট্রিম গ্রাফিক

অনেকে মনে করেন জন লেনন ১৯৭১ সালে হঠাৎ একদিন পিয়ানোতে বসে ‘ইমাজিন’ গানটি লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু সত্যি হলো, গানটি লিখতে-সুর দিতে তাঁর বেশ সময় লেগেছিল। তখন তিনি থাকতেন টিটেনহার্স্ট পার্কের বাড়িতে। সেই সময় তিনি প্রায় প্রতিদিনই পিয়ানোতে বসতেন। কিছু লিখতেন, আবার কেটে দিতেন, সুর বদলাতেন। ইমাজিন গানের প্রথম লাইন থেকে প্রথম কর্ড—সবই তৈরি হয়েছে এই নিয়মিত চেষ্টা আর ধীরে ধীরে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায়। লেনন পরে নিজেই বলেছিলেন, গানটি কোনো হঠাৎ আবেগ থেকে আসেনি; তিনি এটিকে কবিতার মতো করে ভেবে ভেবেই বানিয়েছিলেন।

এই গান তৈরির প্রসঙ্গে এলেই চলে আসে লেননের স্ত্রী ইয়োকো ওনোর নাম। ইমাজিন লেননের নিজের গান, এটা ঠিক। কিন্তু লিরিকের ভাবনা এসেছে ইয়োকোর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত কনসেপ্টুয়াল আর্টবই ‘গ্রেপফ্রুট’ থেকে। বইতে ‘ইমাজিন’ শব্দটি বারবার ফিরে এসেছে। সেখানে ছোট ছোট নির্দেশনামূলক কবিতাও ছিল। যেমন ‘ভাবো তুমি কেমন পৃথিবী দেখতে চাও’, ‘ভাবো পৃথিবীতে কোনো সীমানা নেই’, ‘ভাবো যুদ্ধ নেই’। এই ভাবনাগুলোই পরে লেননের গানে শব্দ ও সুরের মধ্যে মিলেমিশে যায়।

লেননও পরে স্বীকারও করেছিলেন, গানের বড় অংশের ধারণা ও অনুপ্রেরণা এসেছিল ইয়োকোর লেখা থেকেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইয়োকোর নাম অফিসিয়ালি সহ–গীতিকার হিসেবে যোগ করা হয় অনেক পরে, ২০১৭ সালে। গবেষকেরা মনে করেন, তখন লেনন নিজেও কিছুটা ‘সেলফিশ’ আর ‘মাচো’ হয়ে ছিলেন, তাই কৃতিত্ব ভাগ করে নেওয়ার বিষয়ে তিনি সেভাবে ভাবেননি।

ইমাজিন যেন একটি বিরতি। গানটি বলছে, দাঁড়াও, একটু ভাবো। পৃথিবী তোমার কল্পনার চেয়ে অন্যরকমও হতে পারে। এ কারণেই এই গানের প্রাসঙ্গিকতা কখনো কমে না, বরং প্রতিটি সংকটের পর আবার নতুন করে জন্ম নেয়।

এই গল্পে কিন্তু আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের নাম আসবে। তিনি কিংবদন্তি মিউজিক প্রডিউসার ফিল স্পেক্টর। ইমাজিনের অ্যারেঞ্জমেন্টের দায়িত্ব লেনন তাঁকে দিয়েছিলেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, স্পেক্টর হয়তো তাঁর সেই বিখ্যাত বিশাল অর্কেস্ট্রেশন ব্যবহার করবেন। কিন্তু তিনি করলেন উল্টো কাজ। লেননের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরো অ্যারেঞ্জমেন্টকে মিনিমাল রাখলেন। অতিরিক্ত কিছু নেই, শুধু সুর আর বার্তাটাই যেন স্পষ্টভাবে শোনা যায়। পিয়ানোর সেই উষ্ণ টোন আর হালকা স্ট্রিংসের ব্যবহার মিলিয়ে তৈরি হলো অনন্য এই সাউন্ডস্কেপ।

ইমাজিন গানে জন লেনন যা বলতে চেয়েছেন

কোমল সুরে গাওয়া ইমাজিন গানের লিরিক আসলে এমনসব প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, যা সমাজের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। বাইশ লাইনের মধ্যে লেনন যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তা আজও অবাক করে। পৃথিবীর রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, বিভাজনের সময় এমন একটি গান প্রকাশ পাওয়াটাই ছিল এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ। তবে সমালোচনা উঠল, অনেক রক্ষণশীল গোষ্ঠী গানটি নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলল। কিন্তু লেনন বারবার ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি বিরোধিতা করেছেন সেই প্রতিযোগিতা, সেই বিভেদ, সেই অহংকারের যেখানে মানুষ নিজের ধর্মকে অন্যের চেয়ে বড় দেখাতে গিয়ে ঘৃণা আর হিংসার জন্ম দেয়। তাঁর ভাবনা ছিল, আজকের পৃথিবীতে মানুষ যেন শান্তিতে বাঁচতে পারে। এই ধারণাই অনেকের কাছে অসহনীয় মনে হয়েছিল।

১৯৬৪ সালে জন দ্য বিটলসের সদস্যরা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
১৯৬৪ সালে জন দ্য বিটলসের সদস্যরা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এরপর গানে বলেছিলেন, ‘ভাবো, দেশ বলে কিছু নেই।’ লেনন ও ইয়োকো সে সময় জোরেশোরে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। সীমান্ত, জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার নামে যখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষ মরছিল, তখন এই লাইন ছিল সেই বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক দেশের মানুষকে অন্য একটি দেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ধারণাকেই তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সীমান্তরেখা যদি মানবিকতার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তবে সে রেখা নিয়েই ভাবা উচিত, এই বার্তাই তিনি দিয়েছেন।

গানটি শোনার সময় ভাবতে ভাবতে শ্রোতারা যখন একটু থমকে থাকে, ঠিক তখনই লেনন ছুড়ে দেন আরও কঠিন প্রশ্ন। ভাবো, এমন এক পৃথিবী যেখানে কারও ব্যক্তিগত মালিকানা নেই; যেখানে ‘আমার–তোমার’ সম্পদের ভেদাভেদ নেই। গানটি প্রকাশের পরপরই এই লাইন সবচেয়ে বড় বিতর্ক তোলে। সমালোচকেরা বলেন, বিলাসী জীবনযাপনকারী একজন শিল্পী কীভাবে সম্পদহীন জীবনের আহ্বান জানান? বিদ্রূপ, কটাক্ষ সবই ছুটে আসে তাঁর দিকে। লেনন জানতেন প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু তিনি প্রশ্ন তুলতে চেয়েছিলেন।

লেনন শুধু মানুষকে কল্পনা করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন, পৃথিবী কেমন হতে পারে যদি বিভেদ একটু কমে? যদি মালিকানার অহংকার একটু কম হয়? যদি মানুষ মানুষকেই বড় করে দেখে?

তাহলে কি লেনন সত্যিই চেয়েছিলেন পৃথিবী থেকে দেশ, ধর্ম, সম্পদের ধারণা একেবারে মুছে যাক? তিনি নিজেই বহুবার বলেছেন, না। তিনি কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা দিচ্ছিলেন না। সেটি করা তাঁর পক্ষে সম্ভবও না। তিনি কাউকে নির্দেশও দিচ্ছিলেন না। তিনি শুধু মানুষকে কল্পনা করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন, পৃথিবী কেমন হতে পারে যদি বিভেদ একটু কমে? যদি মালিকানার অহংকার একটু কম হয়? যদি মানুষ মানুষকেই বড় করে দেখে?

এই কারণেই গানটির শক্তি এত গভীর। এটি নির্দেশ দেয় না, সমাধানও দেয় না। বরং প্রশ্ন তোলে। কেউ গানটিকে অতিরিক্ত আদর্শবাদী বলে, কেউ আবার অসম্ভব স্বপ্ন মনে করে। কিন্তু যত মতই থাকুক, অস্বীকারের উপায় নেই, এই গান মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গানটি যেন আমাদের বারবার জিজ্ঞেস করে, এই পৃথিবীকে একটু ভালো করা কি সত্যিই এত অকল্পনীয়?

ইমাজিন গানটি কেন আজও প্রাসঙ্গিক

ইমাজিন গানটি আজও প্রাসঙ্গিক। কারণ, গানটি কোনো সময়, যুগ বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আটকে নেই। এটি সরাসরি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে স্পর্শ করে। শান্তি, সমতা আর একে অপরকে মানুষ হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা। পৃথিবী বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, রাজনৈতিক মানচিত্র বদলেছে, কিন্তু বিভাজনের রূপ বদলায়নি। আর ঠিক সেই জায়গাটিতেই ইমাজিন বারবার ফিরে আসে, নতুন অর্থ খুঁজে পায়।

স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে জন লেনন। সংগৃহীত ছবি
স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে জন লেনন। সংগৃহীত ছবি

পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সংকটের সময়ে মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন এই গানটি যেন আবারও মনে করিয়ে দেয়, আমরা চাইলে অন্যরকম পৃথিবী কল্পনা করতে পারি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে এশিয়া—যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এখনও বাস্তবতা। ইমাজিন সেই বাস্তবতার মাঝেও স্বপ্ন দেখার সাহসের কথা বলে।

আরেকটি কারণ হলো, গানটি মানুষকে প্রশ্ন তুলতে শেখায়। এই প্রশ্ন করার ক্ষমতাই গানকে যুগ যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক রেখেছে। কয়েকটি লাইনেই লেনন এমন এক বিশ্বদর্শন তুলে ধরেছেন, যা একটি রাজনৈতিক তত্ত্বের বইও হয়তো করতে পারবে না। আর তাই বিশ্বজুড়ে স্কুলের শিশুদের মুখেও এই গান শোনা যায়, আবার শান্তি মিছিলে, অলিম্পিক উদ্বোধনে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মানুষ একত্র হলে, সব জায়গায় একই সুরের আবেদন।

এ ছাড়া এই সময়ের মানুষ আগের চেয়ে বেশি ক্লান্ত। এমন সময়ে ইমাজিন যেন একটি বিরতি। গানটি বলছে, দাঁড়াও, একটু ভাবো। পৃথিবী তোমার কল্পনার চেয়ে অন্যরকমও হতে পারে। এ কারণেই এই গানের প্রাসঙ্গিকতা কখনো কমে না, বরং প্রতিটি সংকটের পর আবার নতুন করে জন্ম নেয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত