leadT1ad

একাত্তরে নদী ছিল পাকিস্তানের গলার ফাঁস

মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণত জনযুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ কিংবা সম্মুখসমর হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সামরিক বিজ্ঞানের আতশি কাচ দিয়ে দেখলে, এই যুদ্ধটি ছিল আদতে ‘মানুষ বনাম প্রকৃতি’ এবং ‘প্রকৃতি বনাম অস্ত্রের’ লড়াই।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

নদীর বুকে মুক্তিযোদ্ধারা। সংগৃহীত ছবি

কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের দুটি জরাজীর্ণ বোটকে মডিফাই করে বানানো হয় ‘বিএনএস পদ্ম’ ও ‘বিএনএস পলাশ’। এতে বসানো হয় বিমানবিধ্বংসী কামান। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনায় এই গানবোট দুটির ওপর ভুলবশত মিত্রবাহিনী বিমান হামলা চালায়। ঘটনাটি ভুলবশতই ঘটে। ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার রুহুল আমিন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা পলাশের ইঞ্জিনরুম ছাড়েননি। জাহাজটি যাতে সচল থাকে সেই চেষ্টাই করেন তিনি। রুহুল আমীনের আত্মত্যাগই প্রমাণ করে, নদীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া তাঁদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সেই রুহুল আমিন, যিনি আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন।

একাত্তরের নদীভিত্তিক যুদ্ধের শেষ অধ্যায়টি ছিল কনভেনশনাল বা প্রথাগত নৌযুদ্ধ। গেরিলা আক্রমণ থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সরাসরি গানবোট নিয়ে আক্রমণ শুরু করে এই সময়ে। ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের চূড়ান্তলগ্নে যৌথ কমান্ড এক নতুন কৌশল নেয়। যা পুরোপুরি ছিল নদীর ওপর নির্ভরশীল। একে বলা হয় ‘বাইপাস স্ট্র্যাটেজি’।

জেনারেল নিয়াজি ভেবেছিলেন, যুদ্ধ হবে সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে। তাই সব শক্তি সীমান্তে নিয়োগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু মিত্রবাহিনী প্রধান সড়ক ও সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলো এড়িয়ে গ্রামীণ পথ, বিল ও ছোট নদী ব্যবহার করে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে।

সবচেয়ে বড় উদাহরণ মেঘনা নদী। আশুগঞ্জ ব্রিজ উড়িয়ে দেয় পাকিস্তানিরা। ভেবেছিল, ভারতীয় বাহিনী আটকে যাবে। কিন্তু জেনারেল সাগাত সিং হেলিকপ্টার ও স্থানীয় নৌকা ব্যবহার করে মেঘনা পার হন। নদীকে বাধা মনে না করে ‘মাধ্যম’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন সাগাত সিং। এই কৌশলই ঢাকার পতন ত্বরান্বিত করেছিল।

প্রকৃতি বনাম অস্ত্রের লড়াই

নদীকে একটি জীবন্ত সত্ত্বা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন আরডিআরসি-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেছেন, একাত্তরের যুদ্ধে ৫৭৪টি নদী হারিয়ে গেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়, যা ৫৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হারানোর শামিল। একাত্তরের যুদ্ধে মানুষের রক্ত আর নদীর পানি একাকার হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান শুধু অস্ত্রের কাছে হারেনি, তারা হেরেছিল এই বদ্বীপের ভূগোলের কাছে, বর্ষার কাছে এবং সেই নদীর কাছে— যে নদী তার সন্তানদের চেনে, কোনো দখলদারদের ক্ষমা করে না।

মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণত জনযুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ কিংবা সম্মুখসমর হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সামরিক বিজ্ঞানের আতশি কাচ দিয়ে দেখলে, এই যুদ্ধটি ছিল আদতে ‘মানুষ বনাম প্রকৃতি’ এবং ‘প্রকৃতি বনাম অস্ত্রের’ লড়াই। পাকিস্তানের পরাজয়ের নকশাটি শেষ পর্যন্ত শুধু কোনো জেনারেলের টেবিলে আঁকা হয়নি। এঁকে রেখেছিল বাংলার ভূগোল। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি। বিশেষ করে বাংলার ‘নদীব্যবস্থা’ ছিল এই যুদ্ধের অঘোষিত ‘সুপ্রিম কমান্ডার’।

১৯৭১-এর রণকৌশল যদি বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যায়— নদী কেবল একটি জলাধার ছিল না; নদী ছিল একটি ‘অ্যাক্টিভ কমব্যাট্যান্ট’ বা সক্রিয় যোদ্ধা। ২৫ হাজার ১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথ এবং ১ হাজার ২শ ৭৪টি নদীর এই জালটি পাকিস্তানের যান্ত্রিক বাহিনীকে ‘লজিস্টিকল নাইটমেয়ার’ বা রসদ সরবরাহের দুঃস্বপ্নে ফেলে দিয়েছিল। যা থেকে তারা আর বের হতে পারেনি।

নদীও একাত্তরে নিয়েছিল যোদ্ধার ভূমিকা। সংগৃহীত ছবি
নদীও একাত্তরে নিয়েছিল যোদ্ধার ভূমিকা। সংগৃহীত ছবি

নিরাপত্তা বলয় বা সেফ জোন

আমাদের সেক্টর কমান্ডারেরা যখন যুদ্ধের মানচিত্র আঁকছিলেন, তাঁদের কলম চলেছিল নদীর গতিপথ ধরে। ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার’-এর গবেষণায় ১৯৭১ সালের স্যাটেলাইট ইমেজের বিশ্লেষণ এক বিস্ময়কর তথ্য সামনে আনে। সেক্টরগুলোর সীমানার প্রায় ৮৭ শতাংশ এলাকাই নির্ধারিত হয়েছিল নদী ও জলাশয় দিয়ে। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। বরং এটি ছিল এক সুচিন্তিত ‘রিভার-সেন্ট্রিক ডিফেন্স মেকানিজম’।

  • সেক্টর ১ (চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) এর সীমানার ১০০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছিল নদী দ্বারা (ফেনী ও মুহুরী নদী)। অর্থাৎ, এই সেক্টরে ঢুকতে বা বের হতে হলে নদী পার হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। যা ডিফেন্সের জন্য ছিল আদর্শ।
  • সেক্টর ২ (ঢাকা-কুমিল্লা-নোয়াখালী) এর সীমানার ৮২.৯১ শতাংশ ছিল নদীবেষ্টিত (মেঘনা, তিতাস, গোমতী)। মেঘনা নদী ঢাকাকে কার্যত পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। যা ছিল পাকিস্তানি সাপ্লাই চেইনের জন্য বড় বাধা।
  • সেক্টর ৮ (কুষ্টিয়া-যশোর-খুলনা) এর ৯০.২৩% সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল গঙ্গা, মধুমতী ও কপোতাক্ষ নদ দ্বারা।
  • সেক্টর ১১ (ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল) এর ৮৫.৬৯% সীমানা ছিল যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র দ্বারা বেষ্টিত।

এই পরিসংখ্যান দেখায় মুক্তিযোদ্ধারা স্থলভাগে যুদ্ধ করলেও তাদের ‘নিরাপত্তা বলয়’ বা ‘সেফ জোন’ ছিল নদী। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী আর্টিলারি বা ট্যাংক এই নদীমাতৃক বাউন্ডারি ক্রস করতে গিয়ে বারবার থমকে গেছে।

রসদ সরবরাহের সুযোগ

আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় ‘ওয়ার অব লজিস্টিকস’ তত্ত্বে বলা হয়—যুদ্ধ অস্ত্রের লড়াই নয়, বরং রসদ সরবরাহের প্রতিযোগিতা। যে পক্ষ সাপ্লাই চেইন সচল রাখতে পারে, বিজয় তাদেরই হয়।

একাত্তরে এই তত্ত্বটিই পাকিস্তানের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সেই ফাঁসির দড়িটি ছিল—বাংলাদেশের নদী।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল ১০০০ মাইল। ভারতের আকাশসীমা নিষিদ্ধ হওয়ার পর পাকিস্তানের রসদ সরবরাহের একমাত্র পথ ছিল সমুদ্রপথ ও নদীপথ। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে জাহাজ ভিড়লে সেই রসদ দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছানোর জন্য নদীপথই ছিল প্রধান ভরসা।

কারণ মুক্তিযোদ্ধারা স্থলভাগের রেল ও সড়ক সেতুগুলো (মোট ২৩১টি সেতু ও ১২২টি রেললাইন) ধ্বংস করে দিয়েছিল। বর্ষাকালে (জুন-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের ৬৭ শতাংশ ভূখণ্ড প্লাবিত থাকত। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় সড়ক পরিবহন অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাধ্য হয়ে তাঁদের সৈন্য ও রসদ পরিবহনের জন্য পুরোপুরি নৌপথের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাঁরা। আর ঠিক এই সুযোগটিই নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানিরা যখন নদীতে নামল, তাঁরা অজান্তেই কুমিরের ঘরে পা দিল।

মোহাম্মদ এজাজ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, নদীগুলো শত্রুর যাতায়াত সীমিত করে দিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল শুষ্ক ও মরু অঞ্চলের মানুষ। তাঁরা সাঁতার জানত না, নদীর জোয়ার-ভাটা বুঝত না। বর্ষার উত্তাল নদী তাঁদের কাছে ছিল সাক্ষাৎ যমদূত। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ‘চাষি শ্রেণির সন্তান’। পানির প্রবাহ, স্রোতের গতি এবং নদীর বাঁক—সবই ছিল তাঁদের নখদর্পণে।

পাকিস্তানের সামরিক বিশ্লেষণে পূর্ব পাকিস্তানকে বলা হয়েছিল একটি ‘স্যালিয়েন্ট’ বা অভিক্ষিপ্ত অংশ। যা তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। জেনারেল নিয়াজির ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশল ব্যর্থ হয়েছিল মূলত নদীর কারণেই।

পানিতে ডুবে যাওয়া কোনো পথ দিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সংগৃহীত ছবি
পানিতে ডুবে যাওয়া কোনো পথ দিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সংগৃহীত ছবি

দেশের বড় নদীগুলো অর্থাৎ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বাংলাদেশকে চারটি বিচ্ছিন্ন সামরিক কম্পার্টমেন্টে ভাগ করে ফেলেছিল।

  • রাজশাহীর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল যমুনা নদীর কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। ১০ মাইল প্রশস্ত যমুনার ওপর কোনো সেতু ছিল না।
  • খুলনা হয়ে যায় গঙ্গা ও মধুমতীর কারণে বিচ্ছিন্ন। কলকাতা থেকে আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তু।
  • ঢাকার কেন্দ্রীয় সেক্টর ছিল প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে সুরক্ষিত, আবার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। মেঘনা ও যমুনা একে রক্ষা করছিল, কিন্তু এই নদীগুলো পার হওয়া পাকিস্তানি রিইনফোর্সমেন্টের জন্যও অসম্ভব ছিল।
  • আর পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর ছিল মেঘনার পূর্ব পাশে অবস্থিত।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতাকে কাজে লাগায়। পাকিস্তানিরা এক সেক্টরের সৈন্য অন্য সেক্টরে নিতে পারছিল না, কারণ মাঝখানে ছিল উত্তাল নদী। আকাশ ও নদীপথের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই ‘পার্শ্বভিমুখী স্থানান্তর’ ত্থা ল্যাটারাল মুভমেন্ট ছিল অসম্ভব। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ছোট ছোট পকেটে আটকা পড়ে যায়।

প্রতীকী প্রতিশোধ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১০ নম্বর সেক্টর। এর কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিল না। সমগ্র জলসীমা ছিল এর রণাঙ্গন। কিন্তু এর পেছনের কৌশলটি ছিল অত্যন্ত গভীর।

নদীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় ভাগীরথী নদীর তীরে। ঐতিহাসিক পলাশীতে। এটি ছিল ‘প্রতীকী প্রতিশোধ’। ১৭৫৭ সালে পলাশীতে যে সূর্য অস্ত গিয়েছিল, ১৯৭১ সালে সেই পলাশীতেই ‘সি-২পি’ ক্যাম্পে নৌ-কমান্ডো তৈরির মাধ্যমে নতুন সূর্যের উদয় ঘটানো হয়।

ফ্রান্সের ‘পিএনএস ম্যাংগ্রো’ সাবমেরিন থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন বাঙালি নাবিক ছিলেন এই বাহিনীর নিউক্লিয়াস। তাঁদের নেতৃত্বে ৫১৫ জন কমান্ডোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের অস্ত্র ছিল লিমপেট মাইন আর কৌশল ছিল—‘জলজ ইঁদুর’ বা ‘ওয়াটার র‍্যাটস’-এর মতো জাহাজের তলায় আঘাত করা।

১৫ আগস্ট ১৯৭১-এর অপারেশন জ্যাকপট ছিল একটি ‘গ্লোবাল সিগন্যাল’। চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে হামলা চালিয়ে ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

এই হামলায় ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী:

  • লয়েডস রেজিস্টার অব শিপিং-এর মতে, মাত্র কয়েক মাসে ১ লাখ টন মালামাল ডুবিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে।
  • বিদেশি জাহাজগুলো বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দেয়। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হতে থাকে।
  • পাকিস্তানি সেনারা নদীতে নামতে ভয় পেতে শুরু করে। তাদের মনে হতো, প্রতিটি কচুরিপানার নিচেই হয়তো মৃত্যুদূত অপেক্ষা করছে।
Ad 300x250

সম্পর্কিত