leadT1ad

রণাঙ্গনের যোদ্ধা তিন গারো কন্যা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

সন্ধ্যারাণী সাংমা ও তুশি হাগিদক। স্ট্রিম কোলাজ

একাত্তরের রণাঙ্গন শুধু সমতলে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও। বিশেষ করে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আদিবাসী নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করার কাজে ঝাপিয়ে পড়েন। কখনো সম্মুখ সমরে অস্ত্র হাতে, কখনো সেবা আর মানবিকতা দিয়ে দেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিন গারো নারী মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যারা অস্ত্র হাতে নয় বরং তাদের সেবাপরায়নতা দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।

গারো সম্প্রদায়ের সেই তিন অকুতোভয় নারী—ভেরেনিকা সিসংমা, সন্ধ্যারানী সাংমা এবং তুশি হাগিদক। তাদের হাতে কোনো স্টেনগান ছিল না, কিন্তু তারা একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্যে যে যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন, সেটিও কোনো অংশে কম ছিল না।

ভেরেনিকা সিসংমা

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া গ্রাম। ছবির মতো সাজানো এই গ্রামেই বেড়ে উঠেছিলেন ভেরেনিকা সিসংমা। রেভারেন্ড সুধীর চিসিমের সহধর্মিণী হিসেবে তাঁর জীবন কাটছিল বেশ শান্তিতেই। কিন্তু একাত্তরের এপ্রিলে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হালুয়াঘাটে নারকীয় তান্ডব শুরু করল, তখন ভিটেমাটি ছেড়ে হাজারো মানুষের সঙ্গে তিনিও পাড়ি জমালেন ভারতের মেঘালয়ে। কিন্তু শরণার্থী জীবনের অনিশ্চয়তা তাঁকে ঘরবন্দি করে রাখতে পারেনি। চোখের সামনে তিনি দেখতেন রক্তাক্ত শরীরে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের। কারো হাত উড়ে গেছে, কারো শরীরে পচন ধরেছে। এই দৃশ্য ভেরেনিকাকে স্থির থাকতে দেয়নি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই ভাইদের বাঁচাতেই হবে।

ভারতের তুরা সিভিল হাসপাতালে ডা. জেড আই চৌধুরীর অধীনে ভেরেনিকা দ্রুত নার্সিং প্রশিক্ষণ নিলেন। এরপর যোগ দিলেন বিশুয়িখলা ক্যাম্পে। সেখানে প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি পরম মমতায় সেবা করতেন। অনেক সময় আহতদের ক্ষতস্থান গ্যাংগ্রিন হয়ে যেত, দুর্গন্ধ ছড়াত। ভেরেনিকা মুখ না ফিরিয়ে নিজের হাতে সেই ক্ষত পরিষ্কার করতেন। তিনি জানতেন, তাঁর একটু মমতার স্পর্শই হয়তো এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে আবার যুদ্ধের ময়দানে পাঠাবে।

২০১৮ সালের আগস্টে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন এই মহীয়সী নারী।

সন্ধ্যারাণী সাংমা

ভেরেনিকার মতো আরেক জীবনযোদ্ধা ছিলেন সন্ধ্যারানী সাংমা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের মুন্সিরহাট গ্রামের এই নারীও যুদ্ধের সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন মেঘালয়ে। স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যেখানে মুখ্য হতে পারত, সেখানে সন্ধ্যারানী বেছে নিয়েছিলেন সেবার কঠিন পথ। তিনিও ভেরেনিকার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ফিল্ড হাসপাতালে। সে সময় ক্যাম্পগুলোতে শুধু গুলিবিদ্ধ রোগীই আসত না, ছিল কলেরার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্ধ্যারানী দিনরাত এক করে কলেরা রোগী আর আহতদের সেবা করে গেছেন। ওষুধের তীব্র সংকট, খাবারের অভাব, সব কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন শুধু দেশমাতৃকার টানে।

তুশি হাগিদক

এই দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তুশি হাগিদক। স্বভাবে চঞ্চল তুশি হাগিদক যুদ্ধের সময় ছিলেন একেবারে তরুণী। তারুণ্যের দীপ্ত সাহস নিয়ে তিনিও নাম লিখিয়েছিলেন নার্সিং স্কোয়াডে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা ও ডালু অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে তুশি ছিলেন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত নিরলস এক কর্মী। যখনই কোনো বড় অপারেশনের পর ট্রাকভর্তি আহত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসতেন, তুশি সবার আগে ছুটে যেতেন। রক্তমাখা ব্যান্ডেজ খোলা, ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জোগানো—সবই করতেন তিনি। যুদ্ধের পর তিনি ফিরে যান চিরচেনা পাহাড়ি জীবনে।

ভেরেনিকা, সন্ধ্যারানী বা তুশি হাগিদক; কেউই আর আমাদের মাঝে নেই। কালের বিবর্তনে তাঁদের অবদানও ম্লান হয়ে গেছে ইতিহাসের বুকে। পাহাড়ের মানুষ, যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে গেছে পাহাড়ে। কিন্তু যে মানবিকতার প্রদীপ জ্বালিয়ে এই তিন পাহাড়ি কন্যা হাজারো মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছিলেন, সেই আলোতেই এই দেশ পেয়েছে স্বাধীনতা, আমরা পেয়েছি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার আনন্দ।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত