আজ দশ বছর হতে চললো জহির নেই। দীর্ঘ দশটি বছর, অথচ মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। এ. জে. করদারের সহকারী হিশেবে কাজ করছে জহির রায়হান। প্রথমে পরিচয়। তারপর ঘনিষ্ঠতা। পঞ্চাশের শেষের দিকেই হবে সম্ভবত। জহির তুমুল উৎসাহে স্ক্রিপ্ট করছে, ‘‘কখনো আসেনি’’-র স্ক্রিপ্ট। ছবি হবে। পয়সা কোত্থেকে আসবে জনি না, আমাদের উৎসাহের কমতি নেই তবু। খান আতা ছবির জন্য গান লিখলেন, সূর করলেন।
এদিকে আমাদের পকেটে খাবার পয়সা নেই। আমি নয়া পল্টন থেকে পুরান ঢাকায় যাই, পায়ে হেটে, সাইকেলে কখনোবা। শেষে একদিন খোঁজ এলো নারায়ণগঞ্জের এক পাটের ব্যবসাদার ছবিতে টাকা ইনভেস্ট করবেন। জহিরকে নিয়ে গেলাম। সারাদিন বসে থাকলাম। কিন্তু, কোথায় কি। সন্ধ্যের দিকে ভদ্রলোক এলেন। পাড় ব্যবসায়ী, বোঝা গেলো, কাজ হবে না। আমরা ফিরে এলাম। নিরুৎসাহ হইনি কিন্তু। পাথরে বাধা পেলে নদী কি থামে? এ সময় কি একটা ছবির রেকর্ডিং-য়ের কাজে খান আতাকে লাহোর যেতে হোল। কয়দিন পর খান আতার টেলিগ্রাম—হাজার ছয় টাকা হলে গানগুলো রেকর্ড করিয়ে ফেলা যায়। ভোরবেলা জহির আমাকে টেনেহিচড়ে বিছানা থেকে তুললো। রিকশায় তুলে নিয়ে ফেললো তারই বাসার ড্রয়িংরুমে। একটু পর চটির আওয়াজ। জহিরতো আমাকে ফেলে রেখেই হাওয়া। এদিকে একা একা আমি ভয়ে, ঘেমে অস্থির। বুড়ো ভদ্রলোক জহিরের বাবাঃ কি ব্যাপার। আমি বিড়বিড় করে কোনক্রমে বিবৃত করলাম। ভদলোক কোন কথা বললেন না। ভেতর থেকে ঘুরে এসে ছ’হাজার টাকার একটা চেক বাড়িয়ে দিলেন। গম্ভীরমুখে কি কি যেন বললেন। আর কিছু শুনিনি। জহির উল্লাসে ফেটে পড়লো দেখলাম, পরে অবশ্য এক পরিবেশক এগিয়ে এলেন টাকা ইনভেস্ট করতে। জহির ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছবির স্যুটিং নিয়ে। আমি আমার পত্রিকা নিয়ে। ‘‘কখনো আসেনি’’ পরে বিখ্যাত ছবি হয়েছিলো।
এখনকার ‘‘শেষ বিকেলের মেয়ে’’ ধারাবাহিকভাবে প্রথম আমিই সন্ধানীতে ছাপি। উপন্যাস হিশেবে সেটাই তাঁর প্রথম লেখা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার কাছ থেকে লেখার স্লিপগুলো আদায় করতাম। পরে কাইয়ুমের কভারে (কাইয়ুম চৌধুরীর কভার তাঁর ভারী পছন্দের) আমার প্রকাশনী থেকেই বই হয়ে বেরোয়। এ সময়ই ‘‘হাজার বছর ধরে’’ উপন্যাস লিখার পরিকল্পনা তার মগজে ঢোকে। ঠিক সে সময় জহির রায়হান আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁর ‘‘সঙ্গম’’ ছবি নিয়ে। একেবারে ভিন্ন ভাষায় সম্পূর্ণ রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’’। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি। সে হিসেবে, ব্যাপারটা জহিরের কাছে চ্যালেঞ্জের মত দাড়িয়ে যায়। বেশ দায়িত্বপূর্ণ কাজ। দিনরাত স্যুটিং। এদিকে সন্ধানীর বর্ষশুরু সংখ্যা বের হচ্ছে। জহির ভায়ের লেখা আমার চাই-ই। একদিন, দুদিন, তিনদিন।
স্টুডিওতে জহিরের পেছন পেছন। বহু লোকজনের মধ্যে জহির বসে থাকেন। আমাকে দূর থেকে দেখে শুধু হাত নাড়েন। আমার গোঁ চেপে গেল। লেখা আমাকে পেতেই হবে। তখনো বুঝিনি যে, এই চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গোপনে ‘হাজার বছর ধরে’ লিখছেন। কয়দিন পর দেখি তিনি চারটে স্লিপ এগিয়ে দিচ্ছেন। তারপর আরো। এভাবে গোটা উপন্যাসটিই বর্ষশুরু সংখ্যায় ছাপা হলো। আজ ভেবে অবাক হই একটি উর্দু ছবির পরিচালনার এত ব্যস্ততার মধ্যে, কিভাবে তার পক্ষে গ্রামীণ পটভূমিকায়, সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে হাজার বছর ধরে’র মত সিরিয়াস লেখা সম্ভব হয়েছিলো। শুধুমাত্র জহির বলেই এটা সম্ভব হয়েছিলো।
জহির রায়হান। ছবি: সংগৃহীতহাজার বছর ধরে ‘আদমজী পুরস্কার’ পায়। সে ঘটনাও বিচিত্র। বললাম জহিরকে ‘হাজার বছর ধরে’ বই আকারে বের করবো। জহির তখন ছবি নিয়ে আরো বেশী জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, ছবি নিয়ে জড়ালে হবে কি, সাহিত্যের জন্যে তাঁর টান অত্যন্ত আন্তরিক। আমাকে বললেন: খামোখা পয়সা খরচ করে হবে কি, বাজারে চলবে না। ‘‘আপনার আর্থিক ক্ষতি হবে অনেক।’’
অনেকটা আমি নিজেই গায়ে পড়ে উদ্যোগ নিলাম। আজো মনে আছে, তড়িঘড়ি করে ছাপা শেষ করে কোন রকমে ছ’কপি বাঁধাই করে এখনকাব সন্ধানী অফিসের আঙিনায় রৌদ্রে আঠা শুকাবার জন্য মেলে দেয়া হয়েছে। বারোটা পর্যন্ত বই জমা দেয়ার সময়। ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর পার হচ্ছে। ভেজা আঠা শুকোয়নি তখনো—দৌড়ে গিয়ে জমা দিলাম। আদমজী পুরস্কারের জন্য সেবারে সেটাই ছিল শেষ জমাকৃত বই। ‘হাজার বছর ধরে’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিশেবে সেবার পুরস্কৃত হয়। জহির বলেছিলেনঃ ‘‘সমস্ত প্রশংসা, কৃতিত্ব আপনার। পুরস্কার আপনারই নেয়া উচিত।’’ মনে আছে, তিনি পুরস্কার নিতেও যাননি। নিয়েছিলেন শহীদভাই (শহীদুল্লাহ কায়সার)।
অত্যন্ত ইমোশনাল ছিলেন জহির। ডিসিশন নিতেন দ্রুত, একদম যে কথা সেই কাজ। শিল্পীসুলভ অস্থিরতা ছিলো তার, হঠাৎ করে ক্ষেপে যেতেন। কাজ করতেন দিনরাত। এত কাজপাগলা লোক আর কেইবা আছে? কখনোবা দিনের পর দিন স্টুডিওতে পড়ে আছেন, স্যুটিং, এডিটিং নিয়ে ব্যস্ততা। এর মধ্যেই আমাকে খবর দিলেন। স্টুডিওতে গিয়ে দেখি, জহির অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। আসছে একুশের মধ্যে ‘আরেক ফাল্গুন’ বই আকারে বের করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের ওপর লিখিত জহিরের এই চমৎকার লেখাটি সন্ধানীতেই ছাপা হয়েছিলো। জহির ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে একটু বিচলিত হলামঃ হাতে টাকা পয়সা নেই। উন সত্তরের গণআন্দোলন চলছে তখন। জহির অভয় দিলেন। কয়দিন পর অনুজ জাকারিয়া হাবিবকে দিয়ে একটা খাম পাঠালেন। খাম খুলে দেখি, একটা চেক আর ছোট চিরকুটঃ ‘‘এখন কাগজ কিনে কাজ শুরু করেন।’’ সেবার একুশে ফেব্রুয়ারীর আগেই ‘‘আরেক ফাল্গুন’’ বই হয়ে বেরিয়েছিলো।
সত্তরে যখন সাপ্তাহিক ‘এক্সপ্রেস’ বের করি তখন জহির রায়হান ছিলেন। ছিলেন সক্রিয়ভাবে। আমি ছিলাম প্রকাশক সম্পাদক আর জহির ম্যানেজিং এডিটর। সেইসব দিনগুলি ভোলা যায় না। আমি, কাইয়ুম চৌধুরী, জহির রায়হান, আলমগীর কবীর, শফিক রেহমান, সৈয়দ শামসুল হক। ঝজ, কাজ আর কাজ। তাঁর প্ল্যান ছিলো এক্সপ্রেসকে ডেইলী করবেন। এ সময়ই একটা বাংলা সাপ্তাহিক বের করার পরিকল্পনা তার মাথায় ঢোকে। এমনিতেও ইংরেজীর চেয়েও বাংলায়ই তাঁর আগ্রহ বেশী ছিল। আর একটা প্ল্যান ছিলো তার। ‘লেট দেয়ার বি লাইটে’র প্ল্যান। ছবিটির জন্যে তিনি খেটেছিলেন খুব। দুঃখ, ছবিটি শেষ হয়নি। তারপর? তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ। মার্চের শেষের দিকে জহির বললেনঃ ভয় নেই, আমরা ১৫/২০ দিনের মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাচ্ছি। ১৫/২০ দিন পার হলো, অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ এপ্রিলের ২০ তারিখের দিকে জহির ওপার বাংলায় চলে গেলেন। আর অনেকদিন খোঁজ নেই। আমি অনেক কষ্টে দেশ ছেড়ে চলে গেলাম, ব্যস্ত হয়ে রইলাম। হংকং-এ বাংলাদেশ মিশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে রইলাম। বংলাদেশের ওপর সেমিনারেরও আয়োজন করছি। উদ্দেশ্যঃ বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা। স্টপ জেনোসাইড ও জহিরকে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। আয়োজন করতে করতেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
বাংলাদেশে ফিরি ২৭শে জানুয়ারী (১৯৭২)। জহিরের সংগে দেখা হলো ২৯শে জানুয়ারী। দেখলাম জহির আরো উত্তজিত। এক্সপ্রেসকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা তাঁর মাথায়। কথা ছিলো, ৩০ তারিখ দুপুরবেলা আমরা একসাথে খাবো আর পরিকল্পনা হবে। ৩০ তারিখ সকাল ১০টার দিকে জহির বাসা থেকে বেরুলেন। আর ফিরলেন না। সুচন্দা আমাকে ফোন করলেন। না, জহিরের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের অন্তর্ধানের সংবাদে অত্যধিক উত্তেজিত ছিলেন তিনি। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন। কোনদিন আর দুপুরবেলা জহিরের সংগে বসা হবে না।
জহির নেই, আমি এ কথা ভাবতে পারি না। জীবনের যে কোন সংকট মুহূর্তে জহির এসে আমার কাছে উপস্থিত হতেন, সকাল, সন্ধ্যা, রাত্রে। কতদিন দুপুরবেলা আমরা একসাথে খেয়েছি! কত কথা, জীবনের কত অপ্রকাশিত অন্ধকার অংশ জহির আমাকে জানিয়েছে। জহিরের স্মৃতির ঋণ এখনো আমাকে কুরে কুরে খায়। ভাবছি, জহির রায়হানের সমস্ত লেখাগুলো নিয়ে রচনাবলী বের করবো। খুব শীঘ্রি কাজ শুরু করবো।
আজো মনে পড়ে, আমি যে ঘরটায় থাকতাম, সেখানে দরজায় একটা গোপন সূতো ছিল। বাইরে থেকে সাধারণের বোঝার উপায় নেই, টান দিলে বাইরে থেকেই দরজা খোলা যেতো। কয়েকজনের জানা ছিলো সুতোর রহস্যটুকু। জহির তাদের একজন। আর যারা জানতেন তাদের প্রায় সবাই বেঁচে আছেন। কেবল জহির নেই। ধীরে-সুস্থে আরো অনেকে সরে যাবেন। আমাদের সুতোর স্মৃতি কি মুছে যাবে? কিছুই কি থাকে না?
(লেখাটিতে সচিত্র সন্ধানীর বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)