জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে ‘অবৈধ শিক্ষার্থীদের’ (নন-এলোটেড ও সাবেক শিক্ষার্থী) মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ খাবারের (ফিস্ট) কুপন না দেওয়ার অভিযোগে প্রাধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে হলের একদল শিক্ষার্থী। এ ঘটনার সংবাদ প্রকাশের জেরে ক্যাম্পাসের এক সাংবাদিককে ধাওয়া এবং অন্য সাংবাদিকদের ওপর মব সৃষ্টি করে আক্রমণ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে হলটির কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।
বিজয় দিবসের দিন মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ২টার দিকে কামালউদ্দিন হলের প্রধান ফটকে এ ঘটনা ঘটে। পরে ভোর পৌনে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে মৌখিক অভিযোগ এবং বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকালে লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী তানজীর হোসাইন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং একটি অনলাইন পোর্টালের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি।
অভিযোগপত্র, প্রত্যক্ষদর্শী ও হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই হলের অবৈধ শিক্ষার্থীদের (নন-এলোটেড ও সাবেক শিক্ষার্থী) মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ফিস্টের কুপন না দেওয়ায় মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে হলের প্রভোস্টসহ হল প্রশাসনকে অবরুদ্ধ করে হলের একদল শিক্ষার্থী। হলের ডাইনিংয়ে অবরুদ্ধের এক পর্যায়ে ‘হল সংসদের ভিপি রায়হান কবির প্রশাসনের সুরে কথা বলছেন’—এমন অভিযোগ তুলে অবরুদ্ধ শিক্ষক ও হল সংসদের ভিপি-জিএস বসে থাকা টেবিলের দিকে লক্ষ্য করে পানির বোতল ছুড়ে মারেন এক শিক্ষার্থী।
এরপর তারা প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকে ও প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এসময় হলের ভেতরে প্রবেশ করা সাংবাদিকসহ অন্য কেউ বের হতে চাইলেও বের হতে দেওয়া হয়নি। পরে রাত দেড়টার দিকে হলে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। এসে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী সাংবাদিক জানান, এই ঘটনা চলাকালে রাত পৌনে ২টার দিকে সংবাদ প্রকাশ করেন সাংবাদিক তানজীর। সংবাদ প্রকাশের পরও তিনি ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিলেন। এ সময় রসায়ন বিভাগের ৪৯ তম শিক্ষার্থী আহমেদ শামীমের নেতৃত্বে ৫ থেকে ৭ জন, ‘ওই যে ওই নিউজ করছে, ওরে ধর, আটকা, মারব’ ইত্যাদি বলে ভুক্তভোগী সাংবাদিককে ধাওয়া দেন। এক পর্যায়ে ‘চোর চোর’ বলে তারা ধাওয়া দিতে শুরু করেন। এ সময় আত্মরক্ষার্থে সাংবাদিক দৌড় দিলে তারা পিছু পিছু ধাওয়া দিয়ে হলের প্রধান ফটকে গিয়ে আটকান এবং কেন সংবাদ প্রকাশ করেছে জানতে চেয়ে অভিযুক্ত শামীম ও দর্শন বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী কামরুল রামিম কয়েকজন ওই সাংবাদিককে হলে ঢোকানোর চেষ্টা করেন।
এ সময় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মেহেদী মামুন ভুক্তভোগী সাংবাদিককে বাঁচানোর চেষ্টা করেন এবং ভুক্তভোগী সাংবাদিক ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। এরপর তারা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মেহেদী মামুন ও উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন এবং ‘ও (ভুক্তভোগী) তো চোর, ওরে কেন পালাইতে দিলেন?’ বলে ঘিরে ধরে মব তৈরি করে আক্রমণের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে অভিযুক্ত শামীম সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মেহেদী মামুনকে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিক তানজীর হোসাইন বলেন, ‘‘আমি সংবাদ প্রকাশের পর ঘটনাস্থলে ছিলাম। আমার এক পাশে গিয়ে আহমেদ শামীম ভাইসহ কয়েকজন সাইড টক করে যে—‘ওই যে ওইটা নিউজ করছে, ধরতে হবে, ওরে মার’ ইত্যাদি টোন করলে আমার ওপর আক্রমণ হতে পারে এমন আশঙ্কা করে আমি হেঁটে চলে যেতে শুরু করি। তখন তারা এই ‘চোর, ওরে ধর, ও নিউজ করছে’ বলে ধাওয়া দেয়। আমি আত্মরক্ষার্থে দৌড় দিলে তারা পিছু পিছু ধাওয়া দেয় এবং এক পর্যায়ে ধরে ফেলে আমাকে মারধরের উদ্দেশ্যে দর্শন বিভাগের রামিম ভাই, শামীম ভাইসহ কয়েকজন হলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমাকে টানা-হেঁচড়া করেন। পরে আমার সহকর্মীরা আমাকে উদ্ধার করে। এই ঘটনায় আমি বিচার চাই এনং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত আহমেদ শামীম বলেন, ‘হলে একটি ছেলে ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে আমরা চিনি না, সে চোর নাকি শিক্ষার্থী। তাকে এই তুমি কে বলে ডাকলে সে দৌড় দেয়। পরে তাকে আমরা পেছনে ধরার জন্য যাই। পরে তাকে ধরে হলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম পরিচয় জিজ্ঞেস করা জন্য। স্বাভাবিকভাবে হলে কেউ থাকলে তাকে না চিনলে, সে যে চোর না কীভাবে বুঝব; এই ঘটনাটা ঘটছে।’
‘সাংবাদিক নিউজ করেছে’ বলে ওকে ধাওয়া দেওয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাকে তো চিনিই না—সে সাংবাদিক নাকি কে। তাহলে এমন কেন বলব? সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মেহেদী মামুন যখন তাকে (ভুক্তভোগী সাংবাদিক) সাইড করে দেয় (চলে যেতে সাহায্য) তখন তার কাছে আমরা জিজ্ঞেস করি কেনো চলে যেতে দেওয়া হলো সে কে। এছাড়া কোনো মবের ঘটনা ঘটেনি।’
এ বিষয়ে জাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মেহেদী মামুন বলেন, ‘আমার এক সহকর্মী নিউজ করার ফলে তাকে পুরো হল দৌড়ানি দিয়ে মারধরের চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের আচরণ ছিল তাকে ধরে হলে নিতে পারলেই যেন মেরে ফেলবে। সংবাদ প্রকাশের পর কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা নিয়মনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে কিন্তু এভাবে একজন সাংবাদিককে ধাওয়া দেওয়া এবং পরবর্তীতে অন্যান্য সাংবাদিকদের ওপরও মব তৈরি কখনোই কাম্য নয়।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা জেনেছি। লিখিত অভিযোগ পেয়েছি আমরা সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করেছি। অভিযোগপত্রটি উপাচার্য মহোদয়ের কাছে পাঠিয়েছি।’