leadT1ad

মাদ্রাসার আড়ালে ‘বিস্ফোরক তৈরি’: কে এই শেখ আল আমিন

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

মাদ্রাসাটি থেকে মালামাল জব্দ করছেন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা

অনাথ ও কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য ভাড়ায় নেওয়া মাদ্রাসাটি ছিল যেন এক ভয়ঙ্কর দাহ্য পদার্থের গোডাউন। একে একে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দাহ্য রাসায়নিক ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড’, ‘এসিটোন’ জাতীয় পদার্থসহ আরও অনেক রকমের রাসায়নিক।

ঘটনাস্থল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ হাউজিং এলাকার ‘উম্মুল ক্বুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা’। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) বেলা ১১টার দিকে এই মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে নারী-শিশুসহ চারজন আহত হয়েছেন।

শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো পরীক্ষা ও উদ্ধারমূলে রেকর্ড করছেন। কী পরিমাণ, কী কী দাহ্য রাসায়নিক উদ্ধার হয়েছে; সে বিষয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

এই ইউনিটের দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের ভাষ্য, উদ্ধার হওয়া প্রত্যেকটি রাসায়নিক পদার্থ বোমা তৈরির কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। এখান থেকে তাজা বোমাও উদ্ধার হয়েছে। এসব আলামত দেখে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, মাদ্রাসার আড়ালে এখানে বোমা তৈরি করে বাইরে সরবরাহ করা হতে পারে। এমন আলামত মিলেছে।

বিস্ফোরণের পর মাদ্রাসাটির সামনের দৃশ্য
বিস্ফোরণের পর মাদ্রাসাটির সামনের দৃশ্য

ঢাকা জেলা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ আল আমিন নামে মাদ্রাসাটির একজন পরিচালক আছেন, তিনি বর্তমানে পলাতক। তার বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের বিভিন্ন থানায় সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। তিনি নিষিদ্ধ-ঘোষিত উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ আছে। এই বিস্ফোরণে তার নিজের দুই শিশু সন্তানও আহত হয়েছে।

এ ঘটনার পর শেখ আল আমিনের স্ত্রীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছেন, শেখ আল আমিনের স্ত্রী আছিয়া, আছিয়ার বড় ভাইয়ের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার ও আছিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী আসমানি খাতুন ওরফে আসমা (৩৪)।

বিস্ফোরণে ভেঙ্গে পড়েছে ভবনের দেয়াল। সংগৃহীত ছবি
বিস্ফোরণে ভেঙ্গে পড়েছে ভবনের দেয়াল। সংগৃহীত ছবি

শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘পলাতক শেখ আল আমিনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই তার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। এত রাসায়নিক দিয়ে তিনি কী করতেন, বোমা তৈরি করে বাইরে সরবরাহ করতেন কিনা; এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘উদ্ধার হওয়া রাসায়নিকগুলো পরীক্ষা করছেন পুলিশের বিভিন্ন এক্সপার্ট টিম। তাদের মতামত পাওয়ার পর বিষয়টি চূড়ান্তভাবে বলা যাবে। ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, এসিটোন জাতীয় পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল উদ্ধার হয়েছে, যা তিনি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। এগুলো কেন সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং এর পেছনের উদ্দেশ্য কী; তা তদন্ত করা হচ্ছে।’

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, নিষিদ্ধ-ঘোষিত উগ্রপন্থী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে শেখ আল-আমিনের যোগাযোগ রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।

গত ২৬ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে ওই মাদ্রাসায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ভূমিকম্পের মতো কম্পন অনুভূত হয় আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে। বিস্ফোরণে মাদ্রাসার পাকা ভবনের দেয়াল, ছাদ ও সিঁড়ির একাংশ ধসে পড়ে। আহত হন একাধিক ব্যক্তি, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।

বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে
বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে

শনিবার বিকেলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসপি মিজানুর রহমান জানান, ‘২০২২ সাল থেকে শেখ আল-আমিন (৩২) মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করেন। দুটি কক্ষে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান চলত। বাকি দুটি কক্ষে তিনি তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের নিয়ে বসবাস করতেন। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে ১০ ও ৭ বছর বয়সী দুই শিশু বিস্ফোরণে আহত হয়। তাদের প্রথমে স্থানীয় আদ-দ্বীন হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিস্ফোরণের সময় আল আমিন ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তবে ঘটনার পরপরই তিনি পালিয়ে যান।

এসপি মিজানুর রহমান বলেন, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট, পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটসহ (এটিইউ) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত শুরু করেছে।

মাদ্রাসাটি থেকে জব্দ হওয়া বিভিন্ন উপকরণ
মাদ্রাসাটি থেকে জব্দ হওয়া বিভিন্ন উপকরণ

শেখ আল-আমিনের স্ত্রী আছিয়াকে (২৮) পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাটের মোল্লাহাট থানার গাওলা বাজার এলাকার সারুলিয়া বারইগাতি গ্রাম। আছিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাসনাবাদ এলাকা থেকেই ইয়াসমিন আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া শনিবার রাজধানীর বাসাবো এলাকা থেকে আসমানি খাতুন ওরফে আসমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, শেখ আল-আমিন এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চার কক্ষবিশিষ্ট একতলা ভবনের পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে। সব কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছেন।

রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সংগৃহীত ছবি
রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সংগৃহীত ছবি

বিস্ফোরণে পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালেও ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। একটি অটোরিকশা গ্যারেজের টিনের ছাউনিও উড়ে গেছে। গ্যারেজের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছিল যে কানে তালা লেগে যায়। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলাম। পরে বের হয়ে দেখি মাদ্রাসার ভেতরে আগুন জ্বলছে।’

প্রত্যক্ষদর্শী গ্যারেজ মালিক মোশাররফ হোসেন বলেন, বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। তাঁর গ্যারেজের দুই অটোচালক ভবন থেকে দুই শিশুকে উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, ‘এক নারী ও এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল-আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।’

জেলা পুলিশের সংবাদ সম্মেলন
জেলা পুলিশের সংবাদ সম্মেলন

মাদ্রাসাটির পাশের একটি পাঁচতলা ভবনের বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে মনে হয়েছিল ভূমিকম্প হয়েছে। সব ভবন কেঁপে উঠেছিল।’ তিনি জানান, শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানি হয়নি।

ঘটনাস্থলে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। তিনি জানান, ভবনটি তাঁর পৈত্রিক জমিতে ২০২২ সালে তৈরি করা হয়। পরে মুফতি হারুন অর রশীদ নামে এক ব্যক্তি মাসিক ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে এখানে মাদ্রাসা চলছিল। হারুন তাঁর শ্যালক আল-আমিন ও তাঁর স্ত্রীকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত