নেলসন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁকে প্রশ্ন করার মতো তেমন কেউ ছিল না। ওই সময় কার্টুনিস্ট জোনাথন শাপিরো তাঁকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। সেখানে দেখা যায়, ম্যান্ডেলার মাথার চারপাশে হেইলো (পবিত্রতার আভা)। কার্টুনটি প্রকাশের পর শাপিরো কিছুটা ভয়ে ছিলেন। হঠাৎ একদিন ম্যান্ডেলা তাঁকে কলও করেন। শাপিরো তখন ভাবলেন, নিশ্চয়ই বকাঝকা শুনতে হবে। কিন্তু ওপাশ থেকে ম্যান্ডেলা বলে ওঠেন, ‘ওয়েলডান শাপিরো’ (সাবাশ শাপিরো)!
জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ শনিবার (৬ ডিসেম্বর) এক আলোচনা সভায় বাস্তব এই ঘটনা শোনানোর পর প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহীদুল আলম বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা ম্যান্ডেলা যেখানে ব্যঙ্গচিত্রকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, সেখানে বাংলাদেশে মিম বা স্যাটায়ারের জন্য মামলা দেওয়া হচ্ছে।’
‘স্যাটায়ার, মিম ও কার্টুন : মতপ্রকাশ নাকি মর্যাদাহানি’ শীর্ষক এই সভার আয়োজন করে নাগরিক কোয়ালিশন ও স্যাটায়ার ম্যাগাজিন ‘ইয়ার্কি’। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া সভাটি সঞ্চালনা করেন ইয়ার্কির প্রধান সিমু নাসের।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েম ‘ইয়ার্কি’সহ স্যাটায়ারভিত্তিক বেশ কয়েকটি পেজের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলার প্রেক্ষাপটে বাক-স্বাধীনতা ও আইনি সুরক্ষার দাবিতে এ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে শহীদুল আলম বলেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চেয়েও বড় সমস্যা হলো ক্ষমতাশালীদের প্রশ্ন করা নিয়ে। যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের প্রশ্ন করলেই সমস্যা তৈরি হয়। অথচ প্রশ্ন না করা হলেই বরং দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা বাড়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সমাজ যদি ভিন্নমত বা স্যাটায়ার সহ্য করতে না পারে (টলারেন্স), তবে সেটি ভয়ংকর। সহনশীলতা না থাকলে সমাজের পচন ত্বরান্বিত হয়। ২০২৪ সালে আমরা এক নিপীড়ক সরকারকে প্রশ্ন করেছিলাম বলেই তাদের পতন হয়েছে।’
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মনে করিয়ে দিয়ে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘শুধু আইন তৈরি বা নির্বাচন করাই গণতন্ত্র নয়। অন্যের মত গ্রহণ করাও গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা মানহানির মতো পুরোনো আইনগুলো ব্যবহার করে এখনো মানুষের মুখ বন্ধ করা হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীকে প্রশ্ন করার অন্যতম মাধ্যম হলো মিম বা স্যাটায়ার। পুরোনো হাতিয়ার ব্যবহার করে কেন নতুন দিনে কাউকে দমন করা হবে?’
লেখক ও সংগঠক ফিরোজ আহমেদ স্যাটায়ারের কারণে অতীতে নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দেশে স্যাটায়ারের সংখ্যা কমে যায়। শুধু কার্টুন আঁকার কারণে কিশোরের (আহমেদ কবির কিশোর) মতো মানুষকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এখন কার্টুনের সঙ্গে নারী হয়রানিকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা কি আবার বিগত ফ্যাসিবাদের রীতির দিকেই ফিরে যাচ্ছি? শাসক যখন কিছুই সহ্য করতে পারেন না তখন বুঝতে হবে বিপদ আসন্ন।’
স্যাটায়ারের জন্য মামলাকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে উন্মাদ-এর সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব বলেন, ইয়ার্কির বিরুদ্ধে মামলা করাটা একদমই ঠিক হয়নি। কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখকদের পাশে থাকার আশ্বাসও দেন তিনি।
কার্টুনিস্ট মেহেদী হক বলেন, ‘স্যাটায়ার হলো সভ্যতার সর্বোচ্চ স্তর। একটি সমাজ কতটা সভ্য, তার নির্দেশক হলো সেই সমাজের মানুষ কতটা স্যাটায়ার নিতে পারে।’
মিম গবেষক সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘মিম হলো সবচেয়ে গণতান্ত্রিক হাতিয়ার। কৌতুকের মাধ্যমে মানুষের ক্ষোভ কমে। মিম সহ্য করতে না পারলে জনগণও আপনাদের সহ্য করবে না।’
আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন শিক্ষাবিদ সুমন রহমান ও রাজনৈতিক কর্মী সৈয়দ হাসিব উদ্দীন হাসিব। তাঁরা মিম ও কার্টুনের জন্য হয়রানিমূলক মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানান। একসঙ্গে কনটেন্ট নির্মাতা, শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।