leadT1ad

বেগম রোকেয়ার দেখানো পথে সফল পায়রাবন্দের নারীরা

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
রংপুর

মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ এলাকার একটি কারখানায় কাজ করছেন নারীরা। স্ট্রিম ছবি

নারী অগ্রযাত্রার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম এলাকায় বহন করছে সংগ্রামী নারীদের অদম্য সংগ্রামের গল্প। রংপুরের মিঠাপুকুরে বহু নারী উদ্যোক্তা নিজেদের শক্তিতে দাঁড়িয়ে বদলে দিচ্ছেন জীবনের গতিপথ। সামাজিক বাধা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পারিবারিক প্রতিকূলতাও তাঁদের আটকে রাখতে পারেনি।

সেসব সংগ্রামী নারীদের একজন দিলারা খাতুন। শুধু নিজের নন, গ্রামের শতাধিক নারীর জীবনে আলো জ্বেলেছেন তিনি। উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের পুটিমারি গ্রামের গৃহবধূ দিলারা খাতুন সংসারের জন্য কিছু করার চিন্তা করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট বোন সুরাইয়া আক্তার সুরভি তাঁকে অনলাইনের ব্যবসার পরামর্শ দেন। এইচএসসি উত্তীর্ণ দিলারা খাতুন ২০১৮ সালে ‘দেশি পণ্য’ নামে ফেসবুক-পেজ খুলে পাট ও বাঁশের তৈরি পণ্য বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন। একসময় বাড়তে থাকে অর্ডার। বর্তমানে তাঁর দুটি কারখানায় বাঁশের পর্দা, বাঁশের ল্যাম্প, ঝুরিসহ নানা ধরনের পাট পণ্য তৈরি করছেন। এ কাজে যুক্ত হয়েছেন তাঁর ছোট বোনসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তাসনুভা ইয়াসমিন ও মোনালিসা।

দিলারা খাতুন বলেন, ‘একসময় পণ্যের চাহিদা বাড়ায় গ্রামের অন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্ত করেছি। দুটি কারখানা গড়েছি। এখন মাসে আয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। আমার অধীনে ৩০০ নারী কাজ করছেন। সংগ্রাম করে আজ সচ্ছল হয়েছে। গ্রামের অন্য নারীরাও বসে না থেকে কাজ করে সফল হয়েছেন।’

বিয়ের পর সংসারে শুধু অভাবই দেখেছেন জামিলা বেগম। পায়রাবন্দ ইউনিয়নের বৈরাগীগঞ্জ পূর্ব চহর গ্রামের দিনমজুর আনিছুর রহমানের স্ত্রী তিনি। একসময় স্থির করেন সংসারের অভাব মোচনের। বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে নকশা তোলার প্রশিক্ষণ নেন। ২০০৭ সালে শুরু করেন নিজের কাজ। বর্তমানে তাঁর অধীনে ৫০ জন নারী শাড়ি, নকশিকাঁথা, থ্রি-পিসে নকশা তোলার কাজ করছেন।

জমিলা বেগম বলেন, ‘এখন দুধে-ভাতে দিন যাচ্ছে। আমার সঙ্গে অন্য নারীরাও নকশা তোলার কাজ করে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করছেন। গ্রামে কোনো ঝামেলা নেই।’

মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ এলাকার একটি কারখানায় কাজ করছেন নারীরা। স্ট্রিম ছবি
মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ এলাকার একটি কারখানায় কাজ করছেন নারীরা। স্ট্রিম ছবি

বিদেশেও যাচ্ছে কুটিরশিল্প

বেগম রোকেয়ার জন্ম এলাকা পায়রাবন্দের মেয়ে আছিরন নেছার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাঁর বাল্যবিবাহের পরই। দিন গড়ানো সঙ্গে বেড়েছে যৌতুকের চাপ ও মানসিক নির্যাতন। এরই মধ্যে তাঁর কোলজুড়ে আসে কন্যাসন্তান। কিন্তু সংসার টেকেনি। দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে ফেরেন বাবার ভিটেয়। নিজের হয়েছিল বাল্যবিবাহ, মেয়েকেও বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হন তিনি। এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পেরে কাজের খোঁজে ঢাকায় গিয়েছিলেন। পরের বাড়ি কাজ করেছেন। সেই স্মৃতি ভোলেন না তিনি। পরে গ্রামে ফিরে এসে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

আমার জীবনটা খুব ছোট বয়সেই কঠিন হয়ে যায়। খাবারের অভাব ছিল, বাবাও ছিলেন না। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়িতে গায়ের রং আর যৌতুক নিয়ে প্রতিদিন কথা শুনতে হতো। সহ্য করতে না পেরে একসময় দুই বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে সব ছেড়ে ফিরে আসি নিজের গ্রামে। এখন আমি সচ্ছল। মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচি। বিউটি আক্তার, বিক্রয়কর্মী, বেগম রোকেয়া হ্যান্ডিক্রাফট

একটি সেলাই মেশিন দিয়ে ১৯৯৮ সালে নতুন জীবনের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন আছিরন নেছা। পাট দিয়ে হস্তশিল্প পণ্য তৈরি করতেন তিনি। এখন তাঁর ‘অনেক আশা কুটির শিল্প’ নামক প্রতিষ্ঠানে তৈরি পণ্য দেশের পাশাপাশি জাপান, জার্মানি ও ইতালিতে রপ্তানি হচ্ছে। উপজেলার জয়রামপুর, খোর্দ মুরাদপুরসহ কয়েকটি গ্রামের দুই শতাধিক নারীকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করেছেন তিনি।

আছিরন নেছা বলেন, ‘একসময় অন্য বাড়িতে কাজ করেছি। কষ্ট কি জিনিস তা খুব কাছ থেকে দেখেছি। এখন আমার সঙ্গে ৫২ জন নারী ও দুজন পুরুষ কাজ করছেন। ২০০টির বেশি পণ্য তৈরি হচ্ছে। গ্রামের নারীদের তৈরি পণ্য দেশের বাইরে যাচ্ছে, এটা গর্বে। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগে। আমার মাধ্যমে তাঁদের রুটি রুজি হচ্ছে।’

বিক্রয়কর্মী থেকে উদ্যোক্তা

বাল্যবিয়ের শিকার বিউটি আক্তার ফিরে এসেছিলেন দুই বছরের সন্তান নিয়ে। শ্বশুরবাড়িতে নানা অপমান ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাঁকে। তাই ভাইয়ের সংসারে ‘বোঝা’ হয়ে থাকার চেয়ে নিজেই কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিভিন্ন জায়গায় কাজও করেন। সাফল্য পেয়েছেন উদ্যোক্তা হিসেবে। তাঁর বাড়ি উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ মুরাদপুর গ্রামে।

২০১৫ সালে ‘বেগম রোকেয়া হ্যান্ডিক্রাফটে’ বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন বিউটি। ২০১৯ সালে দোকানটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে তিনি নিজেই তা ভাড়া নেন। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব পুঁজি। বর্তমানে তাঁর দোকানে ওয়ালম্যাট, ডাইনিং ম্যাট, পাপোশ, খেলনা ও শতরঞ্জিসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। পর্যটকেরা বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দে এসে এসব পণ্য কিনছেন।

বিউটি আক্তার বলেন, ‘আমার জীবনটা খুব ছোট বয়সেই কঠিন হয়ে যায়। খাবারের অভাব ছিল, বাবাও ছিলেন না। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়িতে গায়ের রং আর যৌতুক নিয়ে প্রতিদিন কথা শুনতে হতো। সহ্য করতে না পেরে একসময় দুই বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে সব ছেড়ে ফিরে আসি নিজের গ্রামে। এখন আমি সচ্ছল। মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচি।’

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে বেড়াতে আসা মুরাদপুর এলাকার গৃহবধূ লিলি আক্তার বলেন, ‘বিউটি শত দুঃখ কষ্ট পেরিয়ে এখন সফল। সে পারলে আমরাও পারব। আমরা বেগম রোকেয়ার ভিটের নারী। সংগ্রাম আমাদের রক্তে মিশে আছে।’

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মিঠাপুকুরে নারী উদ্যোক্তাদের ৭টি নিবন্ধিত সংগঠন রয়েছে। কয়েক হাজার নারী এর অধীনে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। উপজেলা মহিলাবিষয়ক দপ্তরের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়।

মিঠাপুকুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শাহনাজ ফারহানা আফরোজ বলেন, ‘মিঠাপুকুরের নারীরা সংগ্রামী। এখানকার নারীরা নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আত্মনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোগ, হস্তশিল্প ও ঘরভিত্তিক আয়মুখী কাজে নারীরা এগিয়ে আসছেন। অনলাইন ব্যবসায় তাঁর পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান রাখছেন। এই ধরনের সফল নারী উদ্যোক্তারা অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠছেন।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত