leadT1ad

শরিফ ওসমান হাদি, আপনি ‘অপর’ থেকে ‘অমর’ হলেন

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ১১
শরিফ ওসমান হাদি। স্ট্রিম গ্রাফিক

মৃ্ত্যু সব সময় কেবলই শূন্যতা নয়, কখনো কখনো তা এক ভয়ংকর পূর্ণতা। শরিফ ওসমান হাদি সেই পূর্ণতার নাম। তিনি চেয়েছিলেন একটি ‘গ্লোরিয়াস ডেথ’—বীরোচিত মৃত্যু। হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় বার্ধক্যের জরাজীর্ণতায় ধুঁকে ধুঁকে মরা নয়; হাদি চেয়েছিলেন মিছিলে, স্লোগানে, অন্যায়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে থাকা অবস্থায় একটি বুলেট এসে থামিয়ে দিক তার হৃৎপিণ্ড। সময় টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ন্যূনতম একটা ইনসাফের জীবন কাটিয়ে যেতে চাই।’

নিয়তি কী নির্মম অথচ কী মহাকাব্যিক! সৃষ্টিকর্তা তাঁর সেই ফরিয়াদ কবুল করেছেন। গুলিটা এসেছে। খুলিটা ঝাঁঝরা হয়েছে। বিজয়নগরের রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে হাদি তার ‘গ্লোরিয়াস ডেথ’ বুঝে নিয়েছেন। মাত্র বত্রিশ বছরের জীবন। মহাকালের ক্যানভাসে এই সময়টুকুর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু হাদি প্রমাণ করে গেলেন, শহীদি অমরতার জন্য পঞ্চাশ-ষাট বছরের দীর্ঘ-ক্লান্তিকর একঘেয়ে জীবনের দরকার হয় না, বারুদের মতো জ্বলে ওঠা বত্রিশটি বছরই যথেষ্ট।

হাদি ছিলেন আমাদের এই পোড়া ভূখণ্ডের ‘অপর’। তিনি ছিলেন ব্রাত্য, প্রান্তিক, ‘সাবঅল্টার্ন’ বা নিম্নবর্গের এক প্রবাদপুরুষ। ঝালকাঠির নলছিটির এক মাদ্রাসাপড়ুয়া তরুণ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেক্যুলার’ ও তথাকথিত ‘এলিট’ চত্বরে পা রেখেছিলেন, তখন এই সমাজ তাঁকে স্বাগত জানায়নি। তথাকথিত প্রগতিশীল ও উচ্চবর্ণের শিক্ষকেরা তাঁকে ইংরেজি উচ্চারণের জন্য ক্লাসের ভরা মজলিসে মকারি করেছেন, ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে তুলে তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন লাস্ট বেঞ্চে। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, ক্লাসরুমের পেছনের বেঞ্চে বসা সেই ছেলেটিই একদিন ইতিহাসের ফার্স্ট বেঞ্চ দখল করে নেবে। তাঁরা জানতেন না, হাদি একদিন ‘অপর’ থেকে ‘অমর’ হবেন।

জুলাই বিপ্লব ছিল একটি মোড়ক উন্মোচনের কাল। এই বিপ্লবের ‘ফসল’ ঘরে তুলে যখন কথিত ছাত্রনেতারা অঢেল টাকা কামিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছেন, শত শত গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউন করছেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়, তখন হাদি নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন পায়ে হেঁটে, রিকশায় চড়ে, সাধারণ মানুষের টাকায়। তিনি ফেসবুকে সেই টাকার পাই-পয়সার হিসাব দিয়েছেন। বিপ্লব যখন বাণিজ্যে পরিণত হয়, হাদি তখনো বিপ্লবকেই ধারণ করেছিলেন। তাঁর এই সরলতা, এই সততা ছিল বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ‘বিদ্রোহ’। আর এই বিদ্রোহই তাঁকে চক্ষুশূল করেছিল।

হাদি বলেছিলেন, তিনি মরে গেলে তার লড়াই চালিয়ে যাবে তাঁর শিশুপুত্র। এ এক মিথিক্যাল বা পৌরাণিক সাহসের কথা। কিন্তু হাদি কি কেবল তার ছেলের জন্য লড়াই রেখে গেলেন? তিনি রেখে গেলেন গোটা এক প্রজন্মের জন্য।

হাদি প্রশ্ন করতেন। দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত সেই জগদ্দল ‘পাওয়ার স্ট্রাকচার’ বা ক্ষমতাকাঠামোকে প্রশ্ন করতেন। তিনি ছিলেন ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের’ বিরুদ্ধে এক জীবন্ত প্রাচীর। ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের মাধ্যমে তিনি যে ‘বাংলাদেশপন্থী’ রাজনীতির বয়ান তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তা অনেকের গাত্রদাহের কারণ ছিল। গুজব শোনা যাচ্ছে, হাদির হত্যাকারী, সেই ভাড়াটে শুটার ফয়সাল, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়েছে। কী চমৎকার আইরনি! যে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে হাদি সারাজীবন লড়লেন, তাঁর হত্যাকারী সেই প্রভুর কোলেই আশ্রয় নিল। আর আমাদের রাষ্ট্র? আমাদের ‘লাজুক স্বভাবা অন্তরীণ’ ইন্টেরিম সরকার তাকে ধরতে পারল না। এটি ব্যর্থতা, নাকি নীরব সম্মতি—ইতিহাস সেই প্রশ্ন তুলবে।

হাদি বলেছিলেন, তিনি মরে গেলে তার লড়াই চালিয়ে যাবে তাঁর শিশুপুত্র। এ এক মিথিক্যাল বা পৌরাণিক সাহসের কথা। কিন্তু হাদি কি কেবল তার ছেলের জন্য লড়াই রেখে গেলেন? তিনি রেখে গেলেন গোটা এক প্রজন্মের জন্য। নলছিটির গ্রাম থেকে উঠে আসা হাদি আজ আর কোনো নির্দিষ্ট ভূগোলের বাসিন্দা নন, তিনি একটি চেতনার নাম।

ওসমান হাদি সব সময় ইনসাফের কথা বলতেন। ইনসাফ বা ন্যায়বিচার—এই শব্দটা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক তামাশার নাম। কিন্তু হাদির কাছে এটি ছিল প্রার্থনার মতো। তিনি জানতেন, রক্ত ছাড়া ইনসাফ কেনা যায় না। তাই তিনি রক্ত দিয়েই দাম চুকিয়ে গেলেন।

আজ ওসমান হাদি নেই। কিন্তু তিনি কি সত্যিই নেই? তিনি এক বিশাল মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছেন এই প্রজন্মকে। তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, কুটিল রাজনীতির মারপ্যাচ আর এনজিও-মার্কা সুশীলতার বাইরে দাঁড়িয়েও ‘হিরো’ হওয়া যায়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, মাদ্রাসার ছাত্রটিও রাষ্ট্রের মালিকানা দাবি করতে পারে, চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে পারে।

শরিফ ওসমান হাদি, আপনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন বটে, কিন্তু যে মায়া আপনি বুনে দিয়ে গেলেন, তা আমাদের ঘুমুতে দেবে না। আপনার খুলিভেদী বুলেটটি আসলে আমাদের বিবেকের দেয়ালে বিঁধেছে। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এই বিচারব্যবস্থা—সবাই এখন আপনার রক্তের কাছে ঋণী।

বিদায় কমরেড, বিদায় মুজাহিদ। আপনার স্বপ্নের ‘গ্লোরিয়াস ডেথ’ আপনাকে অমর করেছে। এবার আমাদের পালা—আপনার রেখে যাওয়া ইনসাফের পতাকাটা মাটি থেকে তুলে ধরার।

মারুফ ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত