হোসেন জিল্লুর রহমান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে ২০০৭ সাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। আমরা যেটাকে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ বা ‘২০০৭-এর বাংলাদেশ’ বলি, তখন একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশ ভিন্ন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। সেই সময় থেকে ২০২১ পেরিয়ে এখন আমরা ২০২৬-এর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ এই সফরে বেশ কয়েকটি নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তন আমরা দেখেছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে, এই দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিকভাবে আমরা কতটুকু পরিপক্বতা অর্জন করতে পেরেছি? আমাদের রাজনৈতিক প্রাপ্তিযোগটাই বা আসলে কী? এই প্রশ্নগুলো আজ খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় কিছু শক্তির জায়গা অবশ্যই আছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে এবং তাদের এক ধরনের শক্তিশালী জনভিত্তিও আছে। তারা দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে প্রতিযোগিতা করে এসেছে, তাদের অভিজ্ঞতাও কম নয়। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী মাঠের নিয়মাবলী নিয়ে কখনোই এক জায়গায় আসতে বা একমত হতে পারেনি। রাজনীতির মাঠে খেলা হবে, খেলোয়াড়রাও প্রস্তুত, কিন্তু সেই খেলার নিয়ম কী হবে—তা নিয়ে ঐকমত্যের অভাব আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনকালীন যে একজন নিরপেক্ষ ‘রেফারি’র প্রয়োজন, সেটিরও কোনো টেকসই সমাধান রাজনৈতিক দলগুলো করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে এর এক ধরনের সমাধান হয়েছিল। সেটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্ভাবন, যা তৎকালীন বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু তারপর সেই সমাধানটিকে অকার্যকর করার জন্য নানা ধরনের রাজনৈতিক উদ্যোগ ও অপকৌশল শুরু হয়। প্রায় এক দশক পার হওয়ার পর, ২০০৬ সালের দিকে আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে—রেফারি কে হবে বা নিয়মাবলী কেমন হবে, এসব নিয়ে আবারও জটিলতা তৈরি হলো। রেফারির দরকার আছে কি না—সেটি তর্কের বিষয় হতে পারে, কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য দলগুলো বলছিল যে দরকার আছে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দায়িত্বে বিষয়টির সমাধান করতে পারল না, ফলে সেখানে আবারও একটা চরম অচলাবস্থা তৈরি হলো।
ঠিক তখনই যেটাকে আজকাল ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার’ বলা হয়, সেটি ক্ষমতায় এল। তারা ঘোষিত দুই বছরের সময়কালের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করল এবং দুই বছর শেষে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাল। তখন পর্যন্ত কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি বহাল ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এল। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তারা সেই ‘রেফারি’র প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান আইনে ছিল, তা বাদ দেওয়ার জন্য এক ধরনের অপকৌশল নেওয়া হলো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির এক ধরনের বিতর্কিত রায়ের সূত্র ধরে পার্লামেন্টের মাধ্যমে সেটি বাতিল করা হলো। এর ফলে নিরপেক্ষ রেফারির বিষয়টি আবারও অমীমাংসিত থেকে গেল এবং রাজনীতির মাঠ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা ‘রেফারি’ ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হলো, সেগুলোকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। বিশেষ করে ২০১৪ সালে, সেখানে অন্যান্য প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের অংশ না নেওয়ার কারণটি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক—সেই নিরপেক্ষ রেফারির অভাব। তত দিনে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আবারও প্রমাণ করল যে কেন নিরপেক্ষ রেফারির প্রয়োজন। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনটি সম্পন্ন হলো। এটাও সত্য যে, এসব করার ক্ষেত্রে তারা প্রতিবেশী একটি দেশের সমর্থন বা প্রশ্রয় পেয়েছিল, যা তাদের এক ধরনের ‘আশকারা’ দিয়েছিল।
২০১৮ সালে এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পর্যায়ে চলে গেল। নানা বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে প্রতিযোগীদের নির্বাচনে আনার চেষ্টা করা হলেও, সার্বিকভাবে প্রশাসনকে অপব্যবহার করে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো, যেটা পরিচিতি পেল ‘রাতের ভোট’ নামে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই ১৫০টিরও বেশি আসন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, ১৫৩ জনের মতো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। তাই সেই অর্থে এগুলোকে কোনোভাবেই নির্বাচন বলা যায় না; নির্বাচনী খেলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত নির্বাচন ছিল না। ২০২৪ সালেও একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪—এগুলোর কোনোটিই মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ তৈরির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেনি। এর সাথে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছিল—একটি অত্যন্ত নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা বা মডেল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। গুম, খুনের মতো বিষয়গুলো আমরা দেখেছি। এসবের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে বিশাল পট পরিবর্তন হলো, তা এক অর্থে আকস্মিক মনে হতে পারে। কিন্তু এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল গত দেড় দশকের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। এই পট পরিবর্তনের পর একটি জরুরি ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। যদিও এখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বা কন্টিনিউটি রক্ষার চেষ্টা আছে, কিন্তু আগের প্রচলিত নিয়মে ঠিক তারা আসেনি। আর সেজন্যই এটাকে আমরা ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বলছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম অধ্যায়টি ছিল মূলত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অধ্যায়। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের ধস বা মেল্টডাউন হচ্ছিল—রিজার্ভের পতন, ডলার সংকট ইত্যাদি। এই সামাল দেওয়ার কাজটি মোটামুটি এই সরকার সফলভাবে করেছে। তবে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল আরও গভীরে।
সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। ৫ আগস্টের পর সমাজের বিভিন্ন পর্যায়—রাজনৈতিক দল, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, আমলা বা ব্যবসায়ী—সবার মধ্যেই একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছিল পরিবর্তন মেনে নেওয়ার। যেহেতু এত বড় পরিবর্তন এবং এত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এটি এসেছে, তাই আশা ছিল দুর্নীতির চক্রগুলো ভেঙে যাবে। কিন্তু ২০২৫ সাল শুরু হতে হতে সবাই দৃশ্যত দেখতে পেল যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্ষমতায় সাংঘাতিক ঘাটতি রয়েছে। যারা সরকার পরিচালনা করছেন, তারা খুব জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারছেন—এই আস্থাটা মানুষের মন থেকে আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করল। ফলে দেখা গেল, আমাদের পুরোনো প্রাতিষ্ঠানিক অপতৎপরতাগুলো আবারও ফিরে এসেছে। দৃশ্যমান দুর্নীতি কিছুটা কমলেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি আবার জেঁকে বসল। কারণ, যারা এসব করে, তারা বুঝে গেল যে তাদেরকে বড় ধরনের কোনো ধাক্কা দেওয়ার সামর্থ্য এই সরকারের নেই।
২০০৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের রাজনীতি বা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো—রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। যে কারণে আমরা দেখলাম, ‘জুলাই সনদ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সমাধান না হয়ে সরকারের ওপর ন্যস্ত হলো। রাজনৈতিক দলগুলোর এই অনৈক্যের মূল কারণ হচ্ছে তাদের কিছু সংকীর্ণ চিন্তা, যা তাদের কাছে বৃহত্তর চিন্তার চেয়ে প্রাধান্য পায়। তারা শুধুই ক্ষমতায় যেতে চায়। তবে এ জন্য আমি শুধু রাজনীতিবিদদের এককভাবে দায়ী করতে চাই না। তারা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা শুধু ক্ষমতায় যেতে চায় বলে তাদের সংকীর্ণ চিন্তা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গে অন্যান্য যে শক্তি আছে—যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, অথবা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেক্ষাপটে যদি বলি—সামাজিক শক্তিগুলোরও ভূমিকা আছে।
বাংলাদেশ বা যেকোনো দেশের পরিবর্তনের পথটা কিন্তু এককভাবে শুধু রাজনীতিবিদরা তৈরি করেন না। এখানে সামাজিক শক্তিরাও আছে, অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিরাও আছে। আবার বাইরের কিছু ব্যবস্থাপত্রও থাকে। আর বাইরের এই ব্যবস্থাপত্রগুলো আসার ক্ষেত্র রাজনৈতিক দলগুলোই পথ তৈরি করে দেয়, যেমনটা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শক্তিগুলোও করে। মূল বিষয়টি হলো—সংকীর্ণ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে দাঁড় করানোর যে চ্যালেঞ্জ, সেটা নিতে না পারাটাই বড় ব্যর্থতা। সমস্যাটা শুধু ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা যদি বলি, তারা তো সাংঘাতিক একটা রাজনৈতিক পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তাদের প্রতি ছিল জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন। ২০২৪ সালের আগস্টের কথা চিন্তা করুন। সবাই একবাক্যে দাঁড়িয়ে ছিল সমর্থন করার জন্য যে, একটি শুভ কাজ শুরু হবে, সবাই এতে জড়ো হবো এবং সমর্থন দেব। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত এক বছর ধরে সেই রাজনৈতিক পুঁজিটা একেবারেই সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না; বরং টোটালি অপচয় হলো। তারা সংস্কারের যে একটি আলোচনা শুরু করেছেন, এখন দেখা যাচ্ছে সেটা খুব একটা সিরিয়াস আলোচনা ছিল না। অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে গভীরতা বা সিরিয়াসনেসের ঘাটতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। কারণ সিরিয়াসনেস মানে হলো 'ফলো থ্রু' (ধারাবাহিক বাস্তবায়ন)। এখানে আমরা সিদ্ধান্তহীনতার একটা বড় বিষয় লক্ষ্য করছি। আমলাতন্ত্র সবসময় প্রয়োজন সেবা প্রদানের (ডেলিভারি) জন্য, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক শাসনের প্রয়োজন নেই। অথচ পরোক্ষভাবে আমরা সেই আমলাতান্ত্রিক শাসনেরই একটি বাস্তবতা দেখলাম।
সরকার সংস্কারের কথা বলেও শেষ পর্যন্ত পুরোনো বা অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের ফিরিয়ে এনে প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়েছে। শুরুতেই আসলে গোলায় অনেকগুলো গলদ ছিল। গত সতেরো বছরে বা এই দীর্ঘ সময়ে যে আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। কিন্তু উনাদের হিসাব-নিকাশে (ক্যালকুলেশন) দেখা গেল, যাদের ওপর তারা আস্থা রাখলেন, তারা তো নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ঢুকে গেলেন। এটা ছিল হিসাবে ভুল, টোটালি হিসাবে ভুল। আমলারা, যাদের ওপর প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিলেন, তারা প্রথমেই নিজেদের সুযোগ-সুবিধার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিল।
চব্বিশের যে পট পরিবর্তন হলো, সেখানে তরুণ শক্তিটা একটা বড় ধরনের শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই শক্তির একটি অংশ রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখল। কিন্তু তরুণদের প্রধান দুটি বিষয় ছিল—মানসম্মত শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান। এই দুটি বিষয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়েছে। তরুণদেরকে নিয়ে এক অর্থে আমরা তারুণ্যের জয়গান গেয়েছি, কিন্তু সেটা ছিল ‘ভুল জয়গান’। কারণ, তাদের সক্ষমতা অর্জনের জন্য যে কঠোর পরিশ্রম করা দরকার বা তাদের জন্য যে সুযোগ তৈরি হওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু ভালো কাজ হয়েছে, যেমন 'প্রকিউরমেন্ট' বা কেনাকাটা নিয়ে একটা ভালো সংস্কার হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার এবং সামাজিক শক্তিগুলো তরুণদের শেখাল যে, মূল খেলাটা আসলে ক্ষমতারই। অনুশীলন ছাড়াই তাদের সরাসরি ক্ষমতার খেলার মাঠে নামিয়ে দেওয়া হলো, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য এবং দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইতিহাস এবং ‘বয়ান’ বা ‘ন্যারেটিভ’ পরিবর্তনের রাজনীতি আমাদের দেশে নতুন নয়। গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে আমরা দেখেছি তারা ইতিহাস চর্চাকে সম্পূর্ণ ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধ বা একাত্তরের মতো মহান বিষয়গুলোকেও সম্পূর্ণ বিতর্কিত করে ফেলেছিল শুধুমাত্র দলীয় বা সংকীর্ণ স্বার্থে। চব্বিশের পর এখন নতুন ‘বয়ান’-এর কথা উঠছে, কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে দাবিদার সাজার বিষয়টিই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগে যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে অনেকে নিহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন—তাদের স্বীকৃতি এবং চিকিৎসার বিষয়টি এখনো অবহেলিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ঘাটতি হচ্ছে—যেই মানুষের শক্তির বদৌলতে চব্বিশের পরিবর্তন হলো, সেই সর্বস্তরের মানুষই গত এক বছর ধরে মূলত দর্শক হয়ে বসে রইল। তারা উপেক্ষিত থাকল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আহতদের চিকিৎসা বা পুনর্বাসনের বিষয়টিও উপেক্ষিত হচ্ছে। যারা জীবন বাজি রেখে পরিবর্তন আনল, তারা শেষ পর্যন্ত দর্শক হয়েই রইল।
অর্থনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বর্তমানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমরা পিপিআরসি থেকে গবেষণা করে দেখেছি, দারিদ্র্য পরিস্থিতি আগের তুলনায় সহনীয় হয়েছে—এটা বলা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এর কারণ হলো অনিশ্চয়তা। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এই সার্বিক অনিশ্চয়তার ভাব। আগে আমরা নির্বাচনী মাইলফলক নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটিয়েছি, এখন অর্থনীতি নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছে না। সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একাধিক ‘বিনিয়োগ সম্মেলন’ বা ‘রোড শো’ করছে। কিন্তু বিনিয়োগ সম্মেলন এবং প্রকৃত বিনিয়োগ—দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বিনিয়োগকারীরা ম্যাগাজিন দেখে বিনিয়োগ করে না। তারা হিসাব করে—জমিটা ঠিকমতো পাওয়া যাবে কি না, গ্যাস বা সার কবে পাওয়া যাবে, চাঁদাবাজির শিকার হতে হবে কি না। এগুলো নিশ্চিত না হলে রোড শো করে কোনো লাভ নেই।
এর মধ্যে অদ্ভুতভাবে দেখলাম, সরকার ফিলিপ মরিস নামে একটি সিগারেট কোম্পানিকে ‘নিকোটিন পাউচ’ উৎপাদনের অনুমোদন দিল। নিকোটিন পাউচ তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং এটি তাদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। একদিকে তরুণদের কথা বলা, অন্যদিকে এমন ক্ষতিকর পণ্যের অনুমোদন দেওয়া—এই বিচ্যুতিগুলো খুব চোখে লাগছে এবং সরকারের সদিচ্ছা ও বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
প্রশাসনের স্থবিরতার আরেকটি কারণ হলো সিদ্ধান্তহীনতা। বর্তমানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বা আইনশৃঙ্খলা সামাল দিচ্ছেন, তারা ভাবছেন ভবিষ্যতে তাদের কী হবে বা এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলে তারা প্রয়োজনীয় সমর্থন বা 'ব্যাকিং' পাবেন কি না। এই দ্বিধায় পড়ে তারা চুপচাপ বসে আছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনজীবনের ওপর। আপনি যদি কোনো দপ্তরে যান, দেখবেন সচিব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, উপদেষ্টাও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, ফলে ফাইল নড়ছে না।
এই অচলাবস্থা কাটানোর জন্য একটি নির্বাচন হওয়া খুব দরকার। নির্বাচনের অভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা, সিদ্ধান্তহীনতা ও টিমওয়ার্কের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর অবসান হওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনেক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আমরা তাদের ওপর ততটুকুই আস্থা রাখব, যতটুকু তারা বাস্তবে প্রমাণ দিতে পারবে। তবে ভোট হয়ে গেলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। নাগরিকদের—সেটা পেশাজীবী, ব্যবসায়ী বা তৃণমূলের মানুষ যেই হোক না কেন—তাদের নাগরিক সক্রিয়তা সম্পূর্ণ অব্যাহত রাখতে হবে। শুধুমাত্র একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যাবে না।
আমরা নব্বইয়ের পর ১৯৯১ সালেও গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন অর্থনীতির গভীর পরিবর্তন ঘটেছিল, বাজার অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তার হয়েছিল। সুতরাং, রাজনৈতিক দল আসা মানেই আমরা পেছনের দিকে হাঁটব—এভাবে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তবে এখানে ‘এলিট নাগরিক গোষ্ঠী’র একটি সমস্যা আছে। তারা রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সমস্যার মূল মনে করে। কিন্তু এই এলিট গোষ্ঠী তো অন্তর্বর্তীকালীন সময়েরও একটি বড় অংশজুড়ে ছিল এবং তারাও আহামরি কোনো ছাপ রাখতে পারেনি। তাই আস্থা শুধু নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর ওপর নয়, আস্থা রাখতে হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর। আমাদের সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য বা কমিশন নিয়ে আলোচনার সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টি হলো—তারা যমুনার (প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন) আলোচনার কক্ষের জানালার বাইরে তাকায়নি, মানুষ কী ভাবছে তা বোঝার চেষ্টা করেনি।
দীর্ঘ দেড় যুগের এই সংগ্রাম ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জাতি হিসেবে আমরা রাজনৈতিকভাবে কতটুকু পরিশোধিত হতে পারলাম, তা বলা কঠিন। তবে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের শিক্ষা পেয়েছে। শক্তি যত বেশিই হোক, কাঠামোগত শক্তি যত মজবুতই হোক কিংবা যত বিদেশি শক্তির সহায়তাই থাকুক না কেন—‘ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়’। এই শিক্ষাটা আমরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে পেয়েছি।
রাষ্ট্রের সংস্কারের আলোচনায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি। আগে আমাদের সমস্যা ছিল একজন ‘অতি-ক্ষমতায়িত’ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু এর পাশাপাশি ‘এমপি-রাজ’ বা সংসদ সদস্যদের অঘোষিত রাজত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রতিটা নির্বাচনী এলাকায় একজন করে ক্ষুদে প্রধানমন্ত্রী তৈরি হয়েছিল, যাদের সামনে অন্য কেউ কথা বলতে পারত না। এই ‘এমপি-রাজ’-এর পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। এজন্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা দরকার। আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে এমপির আজ্ঞাবহ করে রাখার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য বা ‘ব্যালেন্স অফ পাওয়ার’ প্রতিটা স্তরেই থাকা প্রয়োজন।
দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলতে গেলে, আমরা শুধু আর্থিক দুর্নীতির কথা বলি, কিন্তু ‘পেট্রোনেজ’ বা পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি ভুলে যাই। বিভিন্ন সেক্টরে সিন্ডিকেট বা অনিয়ম রয়েই গেছে কারণ এই পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থাটা ভাঙা হয়নি। ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা গণপরিবহন খাতের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে কোনো শুভ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল তারা এই সিন্ডিকেটগুলো ভাঙবে, কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, ২০০৭ থেকে আজ পর্যন্ত বারবার বাধার সম্মুখীন হওয়ার পেছনে কোনো ‘অদৃশ্য শক্তি’ কাজ করছে কি না। আমি বলব, এটা কোনো বাইরের অদৃশ্য শক্তি নয়, এটা আমাদের নিজেদের মধ্যেই বিদ্যমান। এর মূল বিষয় হচ্ছে ‘রাজনৈতিক পুঁজি’র অপব্যবহার। রাজনৈতিক পুঁজি মানে শুধু রাজনীতিবিদদের পুঁজি নয়; ‘নাগরিক সক্রিয়তা’ও রাজনৈতিক পুঁজিরই একটি অংশ। এই পুঁজিটা ব্যবহার করতে আমাদের নিজেদেরই শিখতে হবে। সমাজকে কীভাবে পরিবর্তন করব—এই প্রশ্নটি আমাদের নিজেদের কাছেই করতে হবে। এটি একটি চলমান যুদ্ধ এবং এখানে সবার সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
সবশেষে, আমার একটি গভীর মানবিক অভিযোগ আছে। জুলাই-আগস্টে সমাজ শুধু তরুণদের মাধ্যমে নয়, সার্বিকভাবে একটি ভয়ানক ট্রমা বা মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। ট্রমা থেকে একটি সমাজকে উদ্ধার করতে হলে শুধু ওষুধ বা চিকিৎসা যথেষ্ট নয়। সেখানে দরকার সহমর্মিতার হাত বাড়ানো, একটু কথা বলা, কাউন্সেলিং বা এক ধরনের ‘হিলিং’ (নিরাময়)। গত এক বছরে আমি এই ‘হিলিং’ শব্দটি শুনিনি। এক বছরের বেশি সময় পার হলো, কিন্তু হিলিং বা ক্ষত নিরাময়ের কোনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক উদ্যোগ কেউ নেয়নি। আমাদের দেশের মানুষ রাষ্ট্র থেকে পকেটে এক লাখ টাকা সাহায্য চায় না। মানুষ চায়, তাদের প্রতি যেন আর কোনো অনৈতিক আচরণ না হয়, তাদের কথা যেন শোনা হয়। এই হিলিংটা হয়নি।
নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেই এই হিলিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যায় না। হিলিং বা ক্ষত নিরাময়ের কাজে আমাদের সবারই সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। এটি সবচেয়ে বেশি দরকার শুধু ঢাকা শহরে নয়, বরং ঢাকার বাইরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে। আমি মনে করি, এটি আমাদের অন্যতম প্রধান একটি কাজ হওয়া উচিত। রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের যত বড় পরিকল্পনাই আমরা করি না কেন, মানুষের মনের ক্ষত যদি না সারে, যদি সমাজের গভীরে জমে থাকা বেদনা ও ক্ষোভের উপশম না হয়, তবে কোনো পরিবর্তনই টেকসই হবে না। তাই আগামীর বাংলাদেশে আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হতে হবে এই সামাজিক নিরাময় বা হিলিং, যাতে আমরা বিভেদ ভুলে, ট্রমা কাটিয়ে একটি সুস্থ ও মানবিক সমাজ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি।
অনুলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে ২০০৭ সাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। আমরা যেটাকে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ বা ‘২০০৭-এর বাংলাদেশ’ বলি, তখন একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশ ভিন্ন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। সেই সময় থেকে ২০২১ পেরিয়ে এখন আমরা ২০২৬-এর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ এই সফরে বেশ কয়েকটি নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তন আমরা দেখেছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে, এই দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিকভাবে আমরা কতটুকু পরিপক্বতা অর্জন করতে পেরেছি? আমাদের রাজনৈতিক প্রাপ্তিযোগটাই বা আসলে কী? এই প্রশ্নগুলো আজ খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় কিছু শক্তির জায়গা অবশ্যই আছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে এবং তাদের এক ধরনের শক্তিশালী জনভিত্তিও আছে। তারা দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে প্রতিযোগিতা করে এসেছে, তাদের অভিজ্ঞতাও কম নয়। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী মাঠের নিয়মাবলী নিয়ে কখনোই এক জায়গায় আসতে বা একমত হতে পারেনি। রাজনীতির মাঠে খেলা হবে, খেলোয়াড়রাও প্রস্তুত, কিন্তু সেই খেলার নিয়ম কী হবে—তা নিয়ে ঐকমত্যের অভাব আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনকালীন যে একজন নিরপেক্ষ ‘রেফারি’র প্রয়োজন, সেটিরও কোনো টেকসই সমাধান রাজনৈতিক দলগুলো করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে এর এক ধরনের সমাধান হয়েছিল। সেটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্ভাবন, যা তৎকালীন বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু তারপর সেই সমাধানটিকে অকার্যকর করার জন্য নানা ধরনের রাজনৈতিক উদ্যোগ ও অপকৌশল শুরু হয়। প্রায় এক দশক পার হওয়ার পর, ২০০৬ সালের দিকে আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে—রেফারি কে হবে বা নিয়মাবলী কেমন হবে, এসব নিয়ে আবারও জটিলতা তৈরি হলো। রেফারির দরকার আছে কি না—সেটি তর্কের বিষয় হতে পারে, কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য দলগুলো বলছিল যে দরকার আছে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দায়িত্বে বিষয়টির সমাধান করতে পারল না, ফলে সেখানে আবারও একটা চরম অচলাবস্থা তৈরি হলো।
ঠিক তখনই যেটাকে আজকাল ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার’ বলা হয়, সেটি ক্ষমতায় এল। তারা ঘোষিত দুই বছরের সময়কালের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করল এবং দুই বছর শেষে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাল। তখন পর্যন্ত কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি বহাল ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এল। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তারা সেই ‘রেফারি’র প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান আইনে ছিল, তা বাদ দেওয়ার জন্য এক ধরনের অপকৌশল নেওয়া হলো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির এক ধরনের বিতর্কিত রায়ের সূত্র ধরে পার্লামেন্টের মাধ্যমে সেটি বাতিল করা হলো। এর ফলে নিরপেক্ষ রেফারির বিষয়টি আবারও অমীমাংসিত থেকে গেল এবং রাজনীতির মাঠ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা ‘রেফারি’ ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হলো, সেগুলোকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। বিশেষ করে ২০১৪ সালে, সেখানে অন্যান্য প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের অংশ না নেওয়ার কারণটি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক—সেই নিরপেক্ষ রেফারির অভাব। তত দিনে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আবারও প্রমাণ করল যে কেন নিরপেক্ষ রেফারির প্রয়োজন। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনটি সম্পন্ন হলো। এটাও সত্য যে, এসব করার ক্ষেত্রে তারা প্রতিবেশী একটি দেশের সমর্থন বা প্রশ্রয় পেয়েছিল, যা তাদের এক ধরনের ‘আশকারা’ দিয়েছিল।
২০১৮ সালে এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পর্যায়ে চলে গেল। নানা বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে প্রতিযোগীদের নির্বাচনে আনার চেষ্টা করা হলেও, সার্বিকভাবে প্রশাসনকে অপব্যবহার করে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো, যেটা পরিচিতি পেল ‘রাতের ভোট’ নামে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই ১৫০টিরও বেশি আসন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, ১৫৩ জনের মতো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। তাই সেই অর্থে এগুলোকে কোনোভাবেই নির্বাচন বলা যায় না; নির্বাচনী খেলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত নির্বাচন ছিল না। ২০২৪ সালেও একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪—এগুলোর কোনোটিই মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ তৈরির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেনি। এর সাথে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছিল—একটি অত্যন্ত নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা বা মডেল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। গুম, খুনের মতো বিষয়গুলো আমরা দেখেছি। এসবের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে বিশাল পট পরিবর্তন হলো, তা এক অর্থে আকস্মিক মনে হতে পারে। কিন্তু এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল গত দেড় দশকের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। এই পট পরিবর্তনের পর একটি জরুরি ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। যদিও এখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বা কন্টিনিউটি রক্ষার চেষ্টা আছে, কিন্তু আগের প্রচলিত নিয়মে ঠিক তারা আসেনি। আর সেজন্যই এটাকে আমরা ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বলছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম অধ্যায়টি ছিল মূলত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অধ্যায়। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের ধস বা মেল্টডাউন হচ্ছিল—রিজার্ভের পতন, ডলার সংকট ইত্যাদি। এই সামাল দেওয়ার কাজটি মোটামুটি এই সরকার সফলভাবে করেছে। তবে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল আরও গভীরে।
সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। ৫ আগস্টের পর সমাজের বিভিন্ন পর্যায়—রাজনৈতিক দল, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, আমলা বা ব্যবসায়ী—সবার মধ্যেই একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছিল পরিবর্তন মেনে নেওয়ার। যেহেতু এত বড় পরিবর্তন এবং এত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এটি এসেছে, তাই আশা ছিল দুর্নীতির চক্রগুলো ভেঙে যাবে। কিন্তু ২০২৫ সাল শুরু হতে হতে সবাই দৃশ্যত দেখতে পেল যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্ষমতায় সাংঘাতিক ঘাটতি রয়েছে। যারা সরকার পরিচালনা করছেন, তারা খুব জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারছেন—এই আস্থাটা মানুষের মন থেকে আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করল। ফলে দেখা গেল, আমাদের পুরোনো প্রাতিষ্ঠানিক অপতৎপরতাগুলো আবারও ফিরে এসেছে। দৃশ্যমান দুর্নীতি কিছুটা কমলেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি আবার জেঁকে বসল। কারণ, যারা এসব করে, তারা বুঝে গেল যে তাদেরকে বড় ধরনের কোনো ধাক্কা দেওয়ার সামর্থ্য এই সরকারের নেই।
২০০৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের রাজনীতি বা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো—রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। যে কারণে আমরা দেখলাম, ‘জুলাই সনদ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সমাধান না হয়ে সরকারের ওপর ন্যস্ত হলো। রাজনৈতিক দলগুলোর এই অনৈক্যের মূল কারণ হচ্ছে তাদের কিছু সংকীর্ণ চিন্তা, যা তাদের কাছে বৃহত্তর চিন্তার চেয়ে প্রাধান্য পায়। তারা শুধুই ক্ষমতায় যেতে চায়। তবে এ জন্য আমি শুধু রাজনীতিবিদদের এককভাবে দায়ী করতে চাই না। তারা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা শুধু ক্ষমতায় যেতে চায় বলে তাদের সংকীর্ণ চিন্তা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গে অন্যান্য যে শক্তি আছে—যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, অথবা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেক্ষাপটে যদি বলি—সামাজিক শক্তিগুলোরও ভূমিকা আছে।
বাংলাদেশ বা যেকোনো দেশের পরিবর্তনের পথটা কিন্তু এককভাবে শুধু রাজনীতিবিদরা তৈরি করেন না। এখানে সামাজিক শক্তিরাও আছে, অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিরাও আছে। আবার বাইরের কিছু ব্যবস্থাপত্রও থাকে। আর বাইরের এই ব্যবস্থাপত্রগুলো আসার ক্ষেত্র রাজনৈতিক দলগুলোই পথ তৈরি করে দেয়, যেমনটা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শক্তিগুলোও করে। মূল বিষয়টি হলো—সংকীর্ণ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে দাঁড় করানোর যে চ্যালেঞ্জ, সেটা নিতে না পারাটাই বড় ব্যর্থতা। সমস্যাটা শুধু ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা যদি বলি, তারা তো সাংঘাতিক একটা রাজনৈতিক পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তাদের প্রতি ছিল জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন। ২০২৪ সালের আগস্টের কথা চিন্তা করুন। সবাই একবাক্যে দাঁড়িয়ে ছিল সমর্থন করার জন্য যে, একটি শুভ কাজ শুরু হবে, সবাই এতে জড়ো হবো এবং সমর্থন দেব। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত এক বছর ধরে সেই রাজনৈতিক পুঁজিটা একেবারেই সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না; বরং টোটালি অপচয় হলো। তারা সংস্কারের যে একটি আলোচনা শুরু করেছেন, এখন দেখা যাচ্ছে সেটা খুব একটা সিরিয়াস আলোচনা ছিল না। অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে গভীরতা বা সিরিয়াসনেসের ঘাটতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। কারণ সিরিয়াসনেস মানে হলো 'ফলো থ্রু' (ধারাবাহিক বাস্তবায়ন)। এখানে আমরা সিদ্ধান্তহীনতার একটা বড় বিষয় লক্ষ্য করছি। আমলাতন্ত্র সবসময় প্রয়োজন সেবা প্রদানের (ডেলিভারি) জন্য, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক শাসনের প্রয়োজন নেই। অথচ পরোক্ষভাবে আমরা সেই আমলাতান্ত্রিক শাসনেরই একটি বাস্তবতা দেখলাম।
সরকার সংস্কারের কথা বলেও শেষ পর্যন্ত পুরোনো বা অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের ফিরিয়ে এনে প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়েছে। শুরুতেই আসলে গোলায় অনেকগুলো গলদ ছিল। গত সতেরো বছরে বা এই দীর্ঘ সময়ে যে আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। কিন্তু উনাদের হিসাব-নিকাশে (ক্যালকুলেশন) দেখা গেল, যাদের ওপর তারা আস্থা রাখলেন, তারা তো নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ঢুকে গেলেন। এটা ছিল হিসাবে ভুল, টোটালি হিসাবে ভুল। আমলারা, যাদের ওপর প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিলেন, তারা প্রথমেই নিজেদের সুযোগ-সুবিধার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিল।
চব্বিশের যে পট পরিবর্তন হলো, সেখানে তরুণ শক্তিটা একটা বড় ধরনের শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই শক্তির একটি অংশ রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখল। কিন্তু তরুণদের প্রধান দুটি বিষয় ছিল—মানসম্মত শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান। এই দুটি বিষয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়েছে। তরুণদেরকে নিয়ে এক অর্থে আমরা তারুণ্যের জয়গান গেয়েছি, কিন্তু সেটা ছিল ‘ভুল জয়গান’। কারণ, তাদের সক্ষমতা অর্জনের জন্য যে কঠোর পরিশ্রম করা দরকার বা তাদের জন্য যে সুযোগ তৈরি হওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু ভালো কাজ হয়েছে, যেমন 'প্রকিউরমেন্ট' বা কেনাকাটা নিয়ে একটা ভালো সংস্কার হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার এবং সামাজিক শক্তিগুলো তরুণদের শেখাল যে, মূল খেলাটা আসলে ক্ষমতারই। অনুশীলন ছাড়াই তাদের সরাসরি ক্ষমতার খেলার মাঠে নামিয়ে দেওয়া হলো, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য এবং দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইতিহাস এবং ‘বয়ান’ বা ‘ন্যারেটিভ’ পরিবর্তনের রাজনীতি আমাদের দেশে নতুন নয়। গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে আমরা দেখেছি তারা ইতিহাস চর্চাকে সম্পূর্ণ ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধ বা একাত্তরের মতো মহান বিষয়গুলোকেও সম্পূর্ণ বিতর্কিত করে ফেলেছিল শুধুমাত্র দলীয় বা সংকীর্ণ স্বার্থে। চব্বিশের পর এখন নতুন ‘বয়ান’-এর কথা উঠছে, কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে দাবিদার সাজার বিষয়টিই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগে যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে অনেকে নিহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন—তাদের স্বীকৃতি এবং চিকিৎসার বিষয়টি এখনো অবহেলিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ঘাটতি হচ্ছে—যেই মানুষের শক্তির বদৌলতে চব্বিশের পরিবর্তন হলো, সেই সর্বস্তরের মানুষই গত এক বছর ধরে মূলত দর্শক হয়ে বসে রইল। তারা উপেক্ষিত থাকল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আহতদের চিকিৎসা বা পুনর্বাসনের বিষয়টিও উপেক্ষিত হচ্ছে। যারা জীবন বাজি রেখে পরিবর্তন আনল, তারা শেষ পর্যন্ত দর্শক হয়েই রইল।
অর্থনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বর্তমানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমরা পিপিআরসি থেকে গবেষণা করে দেখেছি, দারিদ্র্য পরিস্থিতি আগের তুলনায় সহনীয় হয়েছে—এটা বলা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এর কারণ হলো অনিশ্চয়তা। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এই সার্বিক অনিশ্চয়তার ভাব। আগে আমরা নির্বাচনী মাইলফলক নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটিয়েছি, এখন অর্থনীতি নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছে না। সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একাধিক ‘বিনিয়োগ সম্মেলন’ বা ‘রোড শো’ করছে। কিন্তু বিনিয়োগ সম্মেলন এবং প্রকৃত বিনিয়োগ—দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বিনিয়োগকারীরা ম্যাগাজিন দেখে বিনিয়োগ করে না। তারা হিসাব করে—জমিটা ঠিকমতো পাওয়া যাবে কি না, গ্যাস বা সার কবে পাওয়া যাবে, চাঁদাবাজির শিকার হতে হবে কি না। এগুলো নিশ্চিত না হলে রোড শো করে কোনো লাভ নেই।
এর মধ্যে অদ্ভুতভাবে দেখলাম, সরকার ফিলিপ মরিস নামে একটি সিগারেট কোম্পানিকে ‘নিকোটিন পাউচ’ উৎপাদনের অনুমোদন দিল। নিকোটিন পাউচ তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং এটি তাদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। একদিকে তরুণদের কথা বলা, অন্যদিকে এমন ক্ষতিকর পণ্যের অনুমোদন দেওয়া—এই বিচ্যুতিগুলো খুব চোখে লাগছে এবং সরকারের সদিচ্ছা ও বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
প্রশাসনের স্থবিরতার আরেকটি কারণ হলো সিদ্ধান্তহীনতা। বর্তমানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বা আইনশৃঙ্খলা সামাল দিচ্ছেন, তারা ভাবছেন ভবিষ্যতে তাদের কী হবে বা এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলে তারা প্রয়োজনীয় সমর্থন বা 'ব্যাকিং' পাবেন কি না। এই দ্বিধায় পড়ে তারা চুপচাপ বসে আছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনজীবনের ওপর। আপনি যদি কোনো দপ্তরে যান, দেখবেন সচিব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, উপদেষ্টাও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, ফলে ফাইল নড়ছে না।
এই অচলাবস্থা কাটানোর জন্য একটি নির্বাচন হওয়া খুব দরকার। নির্বাচনের অভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা, সিদ্ধান্তহীনতা ও টিমওয়ার্কের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর অবসান হওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনেক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আমরা তাদের ওপর ততটুকুই আস্থা রাখব, যতটুকু তারা বাস্তবে প্রমাণ দিতে পারবে। তবে ভোট হয়ে গেলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। নাগরিকদের—সেটা পেশাজীবী, ব্যবসায়ী বা তৃণমূলের মানুষ যেই হোক না কেন—তাদের নাগরিক সক্রিয়তা সম্পূর্ণ অব্যাহত রাখতে হবে। শুধুমাত্র একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যাবে না।
আমরা নব্বইয়ের পর ১৯৯১ সালেও গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন অর্থনীতির গভীর পরিবর্তন ঘটেছিল, বাজার অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তার হয়েছিল। সুতরাং, রাজনৈতিক দল আসা মানেই আমরা পেছনের দিকে হাঁটব—এভাবে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তবে এখানে ‘এলিট নাগরিক গোষ্ঠী’র একটি সমস্যা আছে। তারা রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সমস্যার মূল মনে করে। কিন্তু এই এলিট গোষ্ঠী তো অন্তর্বর্তীকালীন সময়েরও একটি বড় অংশজুড়ে ছিল এবং তারাও আহামরি কোনো ছাপ রাখতে পারেনি। তাই আস্থা শুধু নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর ওপর নয়, আস্থা রাখতে হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর। আমাদের সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য বা কমিশন নিয়ে আলোচনার সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টি হলো—তারা যমুনার (প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন) আলোচনার কক্ষের জানালার বাইরে তাকায়নি, মানুষ কী ভাবছে তা বোঝার চেষ্টা করেনি।
দীর্ঘ দেড় যুগের এই সংগ্রাম ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জাতি হিসেবে আমরা রাজনৈতিকভাবে কতটুকু পরিশোধিত হতে পারলাম, তা বলা কঠিন। তবে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের শিক্ষা পেয়েছে। শক্তি যত বেশিই হোক, কাঠামোগত শক্তি যত মজবুতই হোক কিংবা যত বিদেশি শক্তির সহায়তাই থাকুক না কেন—‘ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়’। এই শিক্ষাটা আমরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে পেয়েছি।
রাষ্ট্রের সংস্কারের আলোচনায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি। আগে আমাদের সমস্যা ছিল একজন ‘অতি-ক্ষমতায়িত’ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু এর পাশাপাশি ‘এমপি-রাজ’ বা সংসদ সদস্যদের অঘোষিত রাজত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রতিটা নির্বাচনী এলাকায় একজন করে ক্ষুদে প্রধানমন্ত্রী তৈরি হয়েছিল, যাদের সামনে অন্য কেউ কথা বলতে পারত না। এই ‘এমপি-রাজ’-এর পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। এজন্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা দরকার। আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে এমপির আজ্ঞাবহ করে রাখার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য বা ‘ব্যালেন্স অফ পাওয়ার’ প্রতিটা স্তরেই থাকা প্রয়োজন।
দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলতে গেলে, আমরা শুধু আর্থিক দুর্নীতির কথা বলি, কিন্তু ‘পেট্রোনেজ’ বা পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি ভুলে যাই। বিভিন্ন সেক্টরে সিন্ডিকেট বা অনিয়ম রয়েই গেছে কারণ এই পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থাটা ভাঙা হয়নি। ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা গণপরিবহন খাতের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে কোনো শুভ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল তারা এই সিন্ডিকেটগুলো ভাঙবে, কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, ২০০৭ থেকে আজ পর্যন্ত বারবার বাধার সম্মুখীন হওয়ার পেছনে কোনো ‘অদৃশ্য শক্তি’ কাজ করছে কি না। আমি বলব, এটা কোনো বাইরের অদৃশ্য শক্তি নয়, এটা আমাদের নিজেদের মধ্যেই বিদ্যমান। এর মূল বিষয় হচ্ছে ‘রাজনৈতিক পুঁজি’র অপব্যবহার। রাজনৈতিক পুঁজি মানে শুধু রাজনীতিবিদদের পুঁজি নয়; ‘নাগরিক সক্রিয়তা’ও রাজনৈতিক পুঁজিরই একটি অংশ। এই পুঁজিটা ব্যবহার করতে আমাদের নিজেদেরই শিখতে হবে। সমাজকে কীভাবে পরিবর্তন করব—এই প্রশ্নটি আমাদের নিজেদের কাছেই করতে হবে। এটি একটি চলমান যুদ্ধ এবং এখানে সবার সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
সবশেষে, আমার একটি গভীর মানবিক অভিযোগ আছে। জুলাই-আগস্টে সমাজ শুধু তরুণদের মাধ্যমে নয়, সার্বিকভাবে একটি ভয়ানক ট্রমা বা মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। ট্রমা থেকে একটি সমাজকে উদ্ধার করতে হলে শুধু ওষুধ বা চিকিৎসা যথেষ্ট নয়। সেখানে দরকার সহমর্মিতার হাত বাড়ানো, একটু কথা বলা, কাউন্সেলিং বা এক ধরনের ‘হিলিং’ (নিরাময়)। গত এক বছরে আমি এই ‘হিলিং’ শব্দটি শুনিনি। এক বছরের বেশি সময় পার হলো, কিন্তু হিলিং বা ক্ষত নিরাময়ের কোনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক উদ্যোগ কেউ নেয়নি। আমাদের দেশের মানুষ রাষ্ট্র থেকে পকেটে এক লাখ টাকা সাহায্য চায় না। মানুষ চায়, তাদের প্রতি যেন আর কোনো অনৈতিক আচরণ না হয়, তাদের কথা যেন শোনা হয়। এই হিলিংটা হয়নি।
নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেই এই হিলিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যায় না। হিলিং বা ক্ষত নিরাময়ের কাজে আমাদের সবারই সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। এটি সবচেয়ে বেশি দরকার শুধু ঢাকা শহরে নয়, বরং ঢাকার বাইরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে। আমি মনে করি, এটি আমাদের অন্যতম প্রধান একটি কাজ হওয়া উচিত। রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের যত বড় পরিকল্পনাই আমরা করি না কেন, মানুষের মনের ক্ষত যদি না সারে, যদি সমাজের গভীরে জমে থাকা বেদনা ও ক্ষোভের উপশম না হয়, তবে কোনো পরিবর্তনই টেকসই হবে না। তাই আগামীর বাংলাদেশে আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হতে হবে এই সামাজিক নিরাময় বা হিলিং, যাতে আমরা বিভেদ ভুলে, ট্রমা কাটিয়ে একটি সুস্থ ও মানবিক সমাজ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি।
অনুলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

ঢাকার ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভিন্ন আবহে পালিত হয় ৫৪তম মৈত্রী দিবস। এতে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে স্থিতিশীল, ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক চায়।
১ দিন আগেবাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্সের এবারের আলোচনার শিরোনাম ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। আমরা সবাই এখন এই বিষয়টি নিয়েই ভাবছি।
১ দিন আগে
পেরুর বিচারক লুজ দেল কারমেন ইবানিয়েজ কারাঞ্জর ওপর গত জুনে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ, তিনি ২০০৩ সালের পর আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অপরাধ তদন্তের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে গত এক বছরে ছয়জন আইসিসি বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
১ দিন আগে
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেলাম। তিনি আমার ওপর বেশ মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। বললেন, ‘আমি আপনাকে বলে দিলাম...আর আপনি সব লিখে দিলেন!’
৩ দিন আগে