leadT1ad

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর আইসিসি বিচারকের জীবন যেমন

যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিচারক লুজ দেল কারমেন ইবানিয়েজ কারাঞ্জের ব্যক্তিজীবনে নানান প্রতিকূলতা তৈরি হয়েছে। ২০০৩ সালের পর আফগানিস্তানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের অনুমতি দেওয়ায় তাকে লক্ষ্যবস্তু করে ট্রাম্প প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু এরপরও তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি; বরং মনে করেন, মানবতার পক্ষে কাজ করাই তার লক্ষ্য এবং এই নিষেধাজ্ঞাই প্রমাণ করে তার কাজ আন্তর্জাতিকভাবে অর্থবহ হয়ে উঠেছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচরাক লুজ দেল কারমেন ইবানিয়েজ কারাঞ্জ। ছবি: সংগৃহীত।

পেরুর বিচারক লুজ দেল কারমেন ইবানিয়েজ কারাঞ্জের ওপর গত জুনে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ, তিনি ২০০৩ সালের পর আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অপরাধ তদন্তের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে গত এক বছরে ছয়জন আইসিসি বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

ইবানিয়েজ ২০২০ সালে আইসিসির আপিল বিভাগে ছিলেন। সে সময় তিনি যে প্যানেলে ছিলেন, সেটি তালেবান, আফগান নিরাপত্তা বাহিনী, মার্কিন সেনা ও সিআইএ সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ তদন্তের পথ খুলে দেয়। যদিও ২০২১ সালে আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান তদন্তের অগ্রাধিকার পরিবর্তন করেন এবং মার্কিন নাগরিকদের যুক্ত থাকা মামলার গুরুত্ব কমান।

পরে তদন্ত মূলত আফগান নাগরিকদের ভূমিকার ওপর কেন্দ্রীভূত হয়। এখন পর্যন্ত তালেবানের দুই ঊর্ধ্বতন নেতার বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে লৈঙ্গিক নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

ইবানিয়েজ ২০১৮ সালের মার্চ থেকে আইসিসির আপিল বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। তার মেয়াদ ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত চলবে। গত শুক্রবার দ্য হেগে অনুষ্ঠিত ২৪তম অ্যাসেম্বলি অব স্টেটস পার্টিজের শেষ দিনে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই তার সাক্ষাৎকার নেয়। সেই অধিবেশনে আইসিসির পরিচালনা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে বিবৃতি দেয় এবং নিষেধাজ্ঞায় পড়া কর্মকর্তাদের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে।

নীচে সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত অংশ তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্র সরকার কেন আপনার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে?

বিচারপতি ইবানিয়েজ: আমি নিষেধাজ্ঞাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখি না। আমি মনে করি, আমাকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে আইসিসির বিচারক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের কারণে। আরও পাঁচজন সহকর্মীও একই কারণে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভয়াবহ অপরাধের বিচার করছি। আমাদের লক্ষ্য এসব অপরাধের দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করা এবং কোটি মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এই কাজ ঠিকভাবেই চলছে বলেই হয়তো এটি ঘটেছে।

প্রশ্ন: নিষেধাজ্ঞার কারণে আপনার ব্যক্তিগত জীবন ও বিচারকের দায়িত্ব পালন কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে?

নিষেধাজ্ঞার ফলে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা মূলত সম্পদ জব্দ ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেওয়ারও ঝুঁকি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে আমার তেমন হিসাব নেই, কিন্তু ইউরোপে থাকা হিসাবেও প্রভাব পড়ে।

শুরুতে ব্যাংক আমাকে জানায় যে আমার ক্রেডিট কার্ড বাতিল করা হচ্ছে এবং ডলারে থাকা হিসাব স্থগিত। সেই অর্থ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পরে দেখা যায় আমি উবারও ব্যবহার করতে পারছি না—না খাবার অর্ডারে, না যাতায়াতে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমেও দেশে অর্থ পাঠাতে পারছি না। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই তারা লেনদেন স্থগিত করেছে।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো নিষেধাজ্ঞা শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরিবারের ওপরও পড়ছে। আমার মেয়ের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন আন্তর্জাতিক আইনজীবী, পেশাগত প্রশিক্ষণ, সম্মেলন বা ব্যবসায়িক কাজে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছেন না। সহকর্মীদের পরিবারের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে।

আমি লাতিন আমেরিকা থেকে এসেছি, আমরা অনলাইন লেনদেনের ওপর খুব নির্ভরশীল নই। আমার পেপাল বা অ্যামাজন অ্যাকাউন্ট নেই। কিন্তু যাদের আছে, তারা এখন তা ব্যবহার করতে পারছেন না। পেরুতেও আমি ডলার হিসাব পরিচালনা করতে পারছি না। বলা হচ্ছে আমি অযোগ্য। বিমানের টিকিট কেনার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছি। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনকেই কঠিন করে তুলেছে।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলায় আপনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? ডাচ সরকারের কোনো সহায়তা কি পেয়েছেন?

আমি ইউরোপে থাকি। কিন্তু আমার পরিচয় লাতিন আমেরিকান। আমি পেরুর নাগরিক। আমাদের দেশে মানুষ সাধারণত খুবই কৌশলী ও টিকে থাকার পথ খুঁজে নিতে জানে। তাই আমিও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছি, যদিও তা প্রকাশ করতে চাই না। তবে সত্য হলো, ইউরোপে নগদ অর্থের ব্যবহার কম। ফলে ব্যাংকিং সিস্টেম ছাড়া দৈনন্দিন লেনদেন চালানো কঠিন।

এর পরেও আমরা বিচারকরা আমাদের কাজ থেকে পিছু হটিনি। নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, কিন্তু আমরা স্বাধীনতা ছাড়িনি। বরং বিচারকদের মধ্যে ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে। কাজের পরিবেশ, কর্মীদের মনোবল এবং আদালতের কার্যক্রমে কিছু প্রভাব পড়েছে, তবুও আমরা সর্বোচ্চ দক্ষতা দিয়ে দায়িত্ব পালন করছি। এখন পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো। আদালত ও বিচারকদের দৃঢ়তা এতে প্রমাণিত হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা কি পেয়েছেন? কমিশনের প্রতি আপনার বার্তা কী?

প্রথমে পরিস্থিতি বেশ কঠিন ছিল। আমরা আক্রান্ত বিচারকরা নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করি এবং বাস্তব সহায়তা চাই। বৈঠকে আমি বলেছিলাম, যদি সরকার কিছুই করতে না পারে এবং ব্যাংকগুলো শুধু নিষেধাজ্ঞা মেনে চলে, তাহলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কোথায়? ব্যাংকগুলো স্বাধীন হলেও কেন তাদের মার্কিন নীতির অধীন হতে হবে?

আমরা আমাদের সমস্যা তুলে ধরার পর মনে হলো কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয়। পরদিনই আমার ব্যাংক থেকে জানানো হয় যে অন্তত ডলার হিসাব ইউরোতে রূপান্তর করে ব্যবহার করতে পারব। এটি ইতিবাচক অগ্রগতি ছিল। পরে আদালতের রেজিস্ট্রারের উদ্যোগে ইউরোতে লেনদেন চালানো সম্ভব হয়েছে, যদিও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

এই সপ্তাহের অধিবেশনে সবাই প্রকাশ্যে আমাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন শুধু আশ্বাস নয়, বাস্তব পদক্ষেপ। আমরা বৈশ্বিক সহায়তা চাই, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। শুধু সংহতি প্রকাশ যথেষ্ট নয়; আইনগত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

কারণ নিষেধাজ্ঞা কেবল বিচারকদের নয়, রোম স্ট্যাটিউট ও আদালতের কাঠামোকেই লক্ষ্য করেছে। আমরা ব্যক্তি হিসেবে অস্থায়ী, কিন্তু আদালতের ভূমিকা স্থায়ী, যারা সবচেয়ে অসহায় ও উপেক্ষিত ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। মূল ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। তাই শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বব্যাপী—এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদেরও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া উচিত।

আপিল আদালতের বিচারক হিসেবে আপনার ভূমিকা কী এবং কেন তা নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো?

আমি ২০১৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আপিল বিভাগে স্থায়ী বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। প্রায় আট বছর ধরে আমি এই চেম্বারে কাজ করছি। ২০১৯ সালে পাঁচ বিচারকের একটি বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে আফগানিস্তানে সংঘটিত নৃশংস অপরাধ তদন্তের অনুমতি দেয়। আমাদের এখতিয়ার আফগানিস্তানের ভূখণ্ডে, অপরাধী যে-ই হোক—তালেবান, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা আন্তর্জাতিক বাহিনী। মামলাটি কখনোই যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে ছিল না। এটি ছিল আফগানিস্তানের মাটিতে সংঘটিত মারাত্মক অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, আপনার তদন্ত কার্যক্রমের কারণে—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র বা এর মিত্র দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য—আপনাকে এবং অন্যান্য বিচারকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার সংবাদ শুনে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

আমার কর্মজীবনে হুমকি ও আক্রমণের অভিজ্ঞতা নতুন নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আসার আগে আমি দেশে ৩৫ বছর প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করেছি। শেষ ১৫ বছর আমি সন্ত্রাসবাদ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করেছি। আমি শাইনিং পাথের নেতা আবিমায়েল গুজমানসহ উচ্চপর্যায়ের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিচার পরিচালনা করেছি। সে সময় আমাকে ও আমার পরিবারকে লক্ষ্য করে একাধিক হুমকি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাও পরিচালনা করেছি। তাই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকি আমার জন্য অচেনা নয়।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার দুই বছর আগে, যখন আমি আইসিসির প্রথম সহ-সভাপতি ছিলাম, রাশিয়া আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। যদিও আমি পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা প্রি-ট্রায়াল চেম্বারের সদস্য ছিলাম না। প্রথমে তিন বিচারকের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হলেও পরে তা সম্প্রসারিত করে আদালতের প্রেসিডেন্সি সদস্যদের বিরুদ্ধেও জারি করা হয়, যার মধ্যে আমি ছিলাম।

এই অভিজ্ঞতার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আমাকে অবাক করেনি। সিদ্ধান্তটি অন্যায় ও অযৌক্তিক, তবে আমি এটিকে একটি স্বীকৃতি হিসেবে দেখেছি। কারণ আগে পূর্বাঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র আমাকে লক্ষ্য করেছে, এবার পশ্চিমের আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। এর অর্থ আমার কাজ আন্তর্জাতিকভাবে অর্থবহ হয়েছে এবং আদালতের কার্যক্রম মূল্য পেয়েছে।

আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই—এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের থামাতে পারেনি। আমার বিশ্বাস, বিচারকের পদ আমার জন্য লাভের উৎস নয়; এটি মানবতার জন্য আমার দায়িত্ব। আইসিসির কাজ মানবতার জন্য। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, আইসিসির লক্ষ্যই মানবতার লক্ষ্য। তাই আমরা দৃঢ় আছি, ঐক্যবদ্ধ আছি। তবে শুধু বিচারক নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ আমরা শান্তি ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য কাজ করছি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত